ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা শাড়িত্যাগ করে পেশোয়াজ পরবে, ম্লেচ্ছ হওয়ার আর কী বাকি রইল! দিকে দিকে এই নিন্দে রটেছে। বাঙালি মেয়ের মান-ইজ্জত ধুলোয় লুটোচ্ছেন ব্রাহ্ম দেবেন্দ্রনাথ– হিন্দুশ্রেষ্ঠ প্রসন্নকুমার ঠাকুর নিন্দের ঢ্যাঁরা পিটোচ্ছেন যেখানে পারছেন। দেবেন্দ্রর মেজ ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস. হওয়ার জন্য লন্ডন যাত্রা করার দিন থেকে প্রসন্নকুমার ঈর্ষায় জ্বলছেন। নিত্য গঙ্গাস্নান করেও সেই জ্বালা জুড়চ্ছে না।
৫.
আজ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে মহোৎসব। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদেশ, ঠাকুরবাড়ির একালের মেয়েরা সব একসঙ্গে দাঁড়াবে পেশোয়াজ পরে। সাহেব ফোটোগ্রাফার এসেছে ধর্মতলার ছবি তোলার সাহেবি দোকান ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ থেকে। কালো পর্দা টানা, সিন্দুকের মতো বড় দামি ক্যামেরার মধ্যে মাথা গুঁজে ফোটোগ্রাফার ছবি তুলবে কাচের প্লেটে। এক একটা ছবির অনেক দাম। জোড়াসাঁকোর বাড়ির ছাদে ছবি তোলার স্টেজ হয়েছে। ছবি তোলা হবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামনে। বাবামশায় দেখবেন, পেশোয়াজে কেমন খোলতাই হয়েছে ঠাকুরবাড়ির একালের মেয়ে-বউমারা।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা শাড়িত্যাগ করে পেশোয়াজ পরবে, ম্লেচ্ছ হওয়ার আর কী বাকি রইল! দিকে দিকে এই নিন্দে রটেছে। বাঙালি মেয়ের মান-ইজ্জত ধুলোয় লুটোচ্ছেন ব্রাহ্ম দেবেন্দ্রনাথ– হিন্দুশ্রেষ্ঠ প্রসন্নকুমার ঠাকুর নিন্দের ঢ্যাঁরা পিটোচ্ছেন যেখানে পারছেন। দেবেন্দ্রর মেজ ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস. হওয়ার জন্য লন্ডন যাত্রা করার দিন থেকে প্রসন্নকুমার ঈর্ষায় জ্বলছেন। নিত্য গঙ্গাস্নান করেও সেই জ্বালা জুড়চ্ছে না। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউগুলোকেও এবার উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছেন দেবেন্দ্র, এ-কথা বলতে প্রসন্নর মুখে বাধা নেই। প্রসন্নকুমার নাকি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এইসব অশালীন আদিখ্যেতার শেষ দেখে ছাড়বেন। বাড়ির মেয়েদের মুসলমানি পোশাক পেশোয়াজ পরানোর সমাজবিরোধী আস্পর্ধার কথা সুযোগ বুঝে প্রসন্নকুমার বিদ্যাসাগরের কানেও তুলেছেন। কিন্তু তিনি মুচকি হেসে গা করেননি। যেমন গা করেননি ওই বেহেড মাতাল, চরিত্রহীন, বেশ্যাসক্ত কালীপ্রসন্নকে দিয়ে মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করানোর ব্যাপারে বাঙালি সমাজের নিষেধে। শাড়ি পরতে বাঙালি মেয়ের লজ্জা? তাই পরপুরুষের সামনে তারা পেশোয়াজ পরে লজ্জা ঢাকবে? বাইজি মহলে ওই পোশাক চলতে পারে। ভদ্র বাঙালি বাড়ির মেয়েরা পেশোয়াজ পরবে? অসম্ভব। প্রতিবাদের ঝড় উঠল।
সেই প্রতিরোধ ও সমালোচনার ঝড়ের মধ্যেই বেলজিয়ান গ্লাসের মহার্ঘ আয়নার সামনে বাবামশায়ের ডিজাইন করা মসলিনের পেশোয়াজ পরে দাঁড়াল কিশোরী জ্ঞানদানন্দিনী। একালের মেয়েদের জন্য কী সুন্দর একটি পোশাক ভাবতে পেরেছেন, ডিজাইন করেছেন, দর্জিকে দিয়ে বানিয়েছেন বাবামশায়! একটা আঁচলে কোনও রকমে লজ্জা ঢেকে বাঙালি মেয়ের দিন কাটে। আর এবার– এ পোশাক পরে বাঙালি নারীর শরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান!
পেশোয়াজ অনেকটাই বিদেশি মেয়েদের গাউনের মতো। আবার তফাতও আছে। খালি গায়ে শাড়ি দিয়ে কিছুতেই সবটুকু ঢেকে রাখার জো নেই। এদিক সামলাতে ওদিক ফসকে যায়। অন্যমনস্ক হওয়ার জো নেই। অন্তঃপুরে শাড়ি ঠিক আছে। কিন্তু পুরুষের সামনে শাড়িতে কিছুতেই লজ্জা ঘোচে না। অথচ বাঙালি পুরুষরা ওইভাবেই মেয়েদের রেখে দিয়েছে। অন্তঃপুরে চিরকাল মেয়েদের বন্দি রাখার ফন্দি নয় তো তাদের একফালি শাড়ি পরিয়ে রাখা? হতেও পারে বা, ভাবে কিশোরী জ্ঞানদা। আর কৃতজ্ঞ বোধ করে বাবামশায়ের কাছে তার অঙ্গের পেশোয়াজটির জন্য। কী সুন্দর, কোমরবন্ধ দেওয়া কোমরে টাইট করে বাঁধা এই পোশাক। সারা অঙ্গ, গলা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে এই পোশাক। হাত দুটোও সম্পূর্ণ ঢাকা। নড়লে-চড়লে এ পোশাক সরে যায় না, খসে যায় না। হলই বা মুঘল মেয়েদের পোশাক। তাতে দোষের কী আছে? বাবামশায় তো বিবাহিত মেয়েদের জন্য এই পোশাকে ঘোমটা বা মাথার উড়নিও যুক্ত করেছেন। তবু বাঙালির কী রাগ বাবামশায়ের ওপর তাঁর বাড়ির মেয়ে-বউদের গায়ে পেশোয়াজ পরানোর জন্য!
নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে আয়নায় দেখে জ্ঞানদা। কেমন দেখাচ্ছে তাকে? কার মুখে শুনতে চায় সে, কেমন দেখাচ্ছে? সে ঘর থেকে বেরিয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণের বারান্দায় মাঝখানে। তার সমস্ত ভেতরটা চিৎকার করে ওঠে– নতুন!
পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সৌদামিনী, জ্ঞানদার থেকে তিন বছরের বড় ননদ, সতেরো বছরের সুন্দরী। বড়বাজারের বিখ্যাত গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের সারদাপ্রসাদের স্ত্রী সৌদামিনী। সৌদামিনীর অঙ্গেও মসলিনের পেশোয়াজ। এত সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে, চোখ ফেরানো দায়। সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জ্ঞানদা।
–কী দেখছ বউঠান, অমন বিহ্বল হয়ে! হেসে প্রশ্ন করে সৌদামিনী।
–তোমার রূপ, বলে জ্ঞানদা।
–আমার বিয়ের গল্প মনে পড়ছে তো?
জ্ঞানদা লজ্জা পায়, সৌদামিনী যেভাবে বলেন ‘আমার বিয়ের গল্প’– এই তিনটি শব্দ। সৌদামিনীর মুখে কিছুই আটকায় না। বেথুনে পড়া, মেমসাহেবের কাছে ইংরেজি শেখা, বাবামশায়ের বড়মেয়েটি এমন কথা সহজে বলে, যে কথা পুরুষের মুখে আটকায়!
–এমন রূপ না থাকলে কি বড়বাজারের কুলীন ব্রাহ্মণসন্তান সারদাপ্রসাদকে ফুসলিয়ে বিয়ে করে, সারা কলকাতায় কেচ্ছা রটিয়ে, তাকে ঘরজামাই করে এই বাড়িতে আটকে রেখে দিব্যি কাটাতে পারতেন! তবে একটা কথা জ্ঞানদা– তোমাকে কিন্তু পেশোয়াজ পরে অনুচিত সুন্দর দেখাচ্ছে! ডেঞ্জারাসলি অ্যাট্রাকটিভ!
–বিপজ্জনক কেন?
–তোমার বর বিদেশে। আর তুমি এমন সুন্দর। তোমার দেওয়রগুলির বিপদের কথা ভাবতে হবে না? বিশেষ করে তোমার নতুন ঠাকুরপো! হেমেন্দ্র ভাইদের মধ্যে বিচক্ষণ। কিন্তু জ্যোতিটা বড্ড আবেগপ্রবণ। ততক্ষণে বারান্দা দিয়ে ছুটে আসছে ছোট্ট বালিকা স্বর্ণকুমারী। তার গায়েও খুদে পেশোয়াজ। যেন এক ছটফটে পুতুল পেশোয়াজ পরে ছুটে এল। বড়দিদি সৌদামিনী তাকে টপ করে কোলে তুলে দু’গালে দুটো চুমু দিল।
ততক্ষণে শাশুড়িমা সারদাদেবী এসে দাঁড়ালেন মেয়ে আর বউমার সামনে। দু’জনের দিকে মিষ্টি হেসে বললেন, ওঁকে এত মানুষ এত খারাপ কথা বলছে! কিন্তু তোমাদের দু’জনকে দেখে আমার হিংসে হচ্ছে। এমন পোশাক যদি যৌবনকালে আমরা পেতাম– কখনও কখনও নিজেকে কী যে অসম্মানিত লেগেছে শাড়িতে!
(চলবে)
তথ্যসূত্র: ‘স্মৃতিকথা’, জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুর