উনিশ শতকের বাঙালি তখন সদ্য কবজিতে বেঁধেছে ঘড়ি। আর খবরের কাগজে বেঁধেছে মন। পুরনো জীবনের চৌকাঠ থেকে তাকে টেনে বের করে এনেছে সাদা-শাসকের দেখানো সভ্যতা। তবে, শাসক তো ধর্মে শাসকই। বাঙালির চাকুরীজীবী হওয়ার সুযোগ থাকল বটে, কিন্তু ঊর্ধ্বতন পদ সবই ভিনদেশির কবজায়। আকস্মিক এই জীবন পরিবর্তন বাঙালিকে ঘিরে ফেলল নিত্যনতুন সংকটে। সবার আগে তার শান্তি গেল চুরি। অর্থ আছে, কিন্তু সেই অর্থ যেন চাহিদা মেটাতে পারে না। সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা আর ঊর্ধ্বতনের গঞ্জনা নিয়ে এই সাধারণ বাঙালি জীবনের এমন কোনও গুপ্ত সুড়ঙ্গ ছিল না, যেখানে সে দু’দণ্ডের অবসর খুঁজে নেবে। সমাজ সংস্কার তখন শুরু হয়েছে যুগপুরুষদের হাত ধরে। সময়ের চৈতন্য বদলাচ্ছে। কিন্তু এই ছাপোষা বাঙালির চেতনাকে চৈতন্য করে দেবে কে!
বাঙালির সান্টা কে? প্রথমে ভেবেছিলাম রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু দেখলাম, শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়া আর কেউই হতে পারেন না। তিনিই তো কল্পতরুর প্রবক্তা। সান্তার গিফট, তা তো দ্রব্য, আত্মায় মিশে যায় না। অনুভূতির বস্তু না। মনোজগতের বিরাট পরিবর্তন হয় না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ কী করলেন? বললেন, তোমাদের চৈতন্য হোক। এই আশীর্বাদই তো পাওয়া। বাঙালির বেঁচে থাকার চিরকালীন আলোকমন্ত্র।
আসলে, বাঙালির কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক কে? বিরাট শিশু কিংবা অপরূপ পাগল। উনিশ শতকের বাঙালি তখন সদ্য কবজিতে বেঁধেছে ঘড়ি। আর খবরের কাগজে বেঁধেছে মন। পুরনো জীবনের চৌকাঠ থেকে তাকে টেনে বের করে এনেছে সাদা-শাসকের দেখানো সভ্যতা। তবে, শাসক তো ধর্মে শাসকই। বাঙালির চাকুরীজীবী হওয়ার সুযোগ থাকল বটে, কিন্তু ঊর্ধ্বতন পদ সবই ভিনদেশির কবজায়। আকস্মিক এই জীবন পরিবর্তন বাঙালিকে ঘিরে ফেলল নিত্যনতুন সংকটে। সবার আগে তার শান্তি গেল চুরি। অর্থ আছে, কিন্তু সেই অর্থ যেন চাহিদা মেটাতে পারে না। সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা আর ঊর্ধ্বতনের গঞ্জনা নিয়ে এই সাধারণ বাঙালি জীবনের এমন কোনও গুপ্ত সুড়ঙ্গ ছিল না, যেখানে সে দু’দণ্ডের অবসর খুঁজে নেবে। সমাজ সংস্কার তখন শুরু হয়েছে যুগপুরুষদের হাত ধরে। সময়ের চৈতন্য বদলাচ্ছে। কিন্তু এই ছাপোষা বাঙালির চেতনাকে চৈতন্য করে দেবে কে! কে তাদের ক্রমশ বিপর্যস্ত জীবনকে একেবারে আমূল পরিবর্তনের মুখে না এনেও বদলে দেবেন একটু একটু করে। সন্দেহ নেই, দক্ষিণেশ্বর গঙ্গার ধারের সেই পাগল ঠাকুরই তাই যেন উপশম। তিনি সংসারে সন্ন্যাসী। শিখিয়েও দেন সংসারে সন্ন্যাস। অর্থের গুরুত্ব তিনি একেবারে অস্বীকার করেন না। নিজের পেশাগত জীবনেও করেননি। কিন্তু অনায়াসে বোঝাতে পারেন, টাকা মাটি মাটি টাকা। উনিশ শতকের বাঙালি জানল, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁদের ক্লিন্ন জীবনের নতুন পথের দিশারি। যে পথ সাম্য, সমন্বয়ের এবং ধর্মবোধে চিরায়ত ঐতিহ্যের অনুসারী হয়েও আধুনিক। নব্য বাঙালিজীবন তাঁকেই তাই দিল অন্তরের শ্রেষ্ঠতম আসন।
……………………………………………………
ক্ষেত্রবিশেষে চৈতন্য গৃহী ভক্তকে দু’-চারটে পরামর্শ কখনও দিয়েছেন। যার মূল দু’টি সূত্র চিহ্নিত করা যায় এইভাবে যে, ন্যূনতম যাপন আর ঈশ্বরস্মরণ। সামাজিক থাক ভাঙতে গিয়ে চৈতন্য হয়তো শ্রেণির প্রশ্নে সাম্যের জায়গায় তেমন গুরুত্ব দেননি। পরবর্তী কালের গবেষকের চোখে তাঁর এ দোষ হয়তো প্রতিভাত হবে। তবে, চৈতন্য এ কথা নিশ্চিত বুঝেছিলেন যে, ব্যক্তিস্তরে যাপনে লোভ, বিলাস, জীবনের যাবতীয় সারপ্লাসের ঝোঁক বর্জন করতে না শিখলে কমিউনিটি বোধ তৈরি হয় না। অতএব তাঁর মানবধর্মের গোড়াতেই এই কথাটি থাকল। সঙ্গে থাকল ঈশ্বরের ‘সা’ ছুঁয়ে থাকা।
……………………………………………………
চৈতন্যদেবের বাংলার মাটি সমন্বয়বাদের যে মোকাম চিনেছে, বাঙালির আত্মায় সে চিহ্ন লেগে থাকবেই। চৈতন্য নিজে কঠোর সন্ন্যাসব্রত পালন করেছেন। তাঁর জন্য কেউ আধখানা হরিতকী সঞ্চয় করে রাখুক, এ-ও তিনি চাননি। তাঁর হয়ে মানবধর্ম প্রচার করেছেন নিত্যানন্দ ও অন্যান্যরা। ক্ষেত্রবিশেষে চৈতন্য গৃহী ভক্তকে দু’চারটে পরামর্শ কখনও দিয়েছেন। যার মূল দু’টি সূত্র চিহ্নিত করা যায় এইভাবে যে, ন্যূনতম যাপন আর ঈশ্বরস্মরণ। সামাজিক থাক ভাঙতে গিয়ে চৈতন্য হয়তো শ্রেণির প্রশ্নে সাম্যের জায়গায় তেমন গুরুত্ব দেননি। পরবর্তী কালের গবেষকের চোখে তাঁর এ দোষ হয়তো প্রতিভাত হবে। তবে, চৈতন্য এ কথা নিশ্চিত বুঝেছিলেন যে, ব্যক্তিস্তরে যাপনে লোভ, বিলাস, জীবনের যাবতীয় সারপ্লাসের ঝোঁক বর্জন করতে না শিখলে কমিউনিটি বোধ তৈরি হয় না। অতএব তাঁর মানবধর্মের গোড়াতেই এই কথাটি থাকল। সঙ্গে থাকল ঈশ্বরের ‘সা’ ছুঁয়ে থাকা। বাঙালি জীবন যতবার অন্য বদলের পথে এগিয়েছে, ততবার সংঘাত বেধেছে এই মূল চরিত্রের সঙ্গেই। এই সংগতি সাধন না করে বদল আসে না। উনিশ শতকেও এই ঐতিহাসিক সমন্বয় জরুরি হয়ে পড়েছিল।
উল্লেখ থাক, শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেও গ্রাম ছেড়ে এসেছিলেন শহরে। পেশার তাগিদে। জগৎসভায় আদৃত হওয়ার বাসনা ছিল তাঁরও। এ বুঝি সময়েরই ধর্ম। সাধনের পথে এগিয়ে তিনি সমন্বয়ের বিন্দুগুলো স্পর্শ করলেন। কিন্তু সেই অর্জন কেবলমাত্র ব্যক্তির স্তরে সীমাবদ্ধ রাখলেন না। বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা তাঁর ধেয়ানে মিশে যে নতুন ধারার জন্ম দিচ্ছে, তা বাঙালির জীবনবদলের সঙ্গে এবং অতীতের সংগতিপূর্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ বাস করলেন শহরেই। তাঁর কথায়– ভাষা, উপমা প্রয়োগে– ধরে রাখলেন গ্রামকে। গ্রামীণ জীবনের সরলতার দৃষ্টান্তগুলোকে। অর্থাৎ, উপমায় ছবি এঁকে তিনি বাঙালির সম্মিলিত স্মৃতিতে দিলেন নাড়া। মাটি হারানো চাকুরিজীবী শ্রেণি তাতে স্বস্তি পান। নগরজীবন তাকে যে অপরাধবোধ দেয়, তা থেকে মুক্তি আসে। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণও তো নগরজীবনবিমুখ নন। আচারক্লিষ্ট জীবন এই সময়ের কাম্য নয়। চাকুরির অনেক শর্ত আছে। কঠোর সন্ন্যাসও সকলের জন্য নয়। এই ঘর আর ঈশ্বর– দুই-ই থাকবে কোন মন্ত্রে? সন্ন্যাসী আর গৃহীর জন্য নিজেকে আলাদা করে ফেললেন শ্রীরামকৃষ্ণ। নরেনের রামকৃষ্ণ আর গিরিশের রামকৃষ্ণ তা-ই এক নন; মধ্যবিত্ত জায়মান চেতনার নির্মাণে সহায়ক হল শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন। বেতন আর চাহিদার ফারাক ঘোচাতে না পারা চাকুরিজীবী শ্রেণিকে তিনি ফিরিয়ে আনলেন সেই ন্যূনতম যাপনে। টাকা টাকা হয়েও মাটি হতে পারে। সংসার সংসার হলেও সেখানে পাঁকাল মাছটি হয়ে থাকা যায়। অর্থাৎ এই ক্লেদ-কিন্ন জীবনের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারার এক সাধনা। আসক্তিতে জড়িয়ে না পড়ে জীবনে এক নির্মোহ চেতনার খোঁজ। এই ব্যক্তিচেতনা জাগ্রত হয়ে কি সার্বিক কোনও চৈতন্যে অন্বিত হতে পারে? সন্ন্যাসী ভক্তদের তো বহুদিন আগেই এগিয়ে দিয়েছিলেন সে পথে। কিন্তু সমাজ নির্মাণ না হলে মুক্তধারা বয় না। মাতিয়ে তোলার আগে পাকিয়ে তোলা জরুরি। ধনঞ্জয় বৈরাগী পরে বুঝলেন, গদাধর বৈরাগী আগেই বুঝেছিলেন। অতএব একদিন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে হাটে হাঁড়ি ভেঙেই দিলেন। উপহার দিলেন সেই চৈতন্য। গৃহী আর সন্ন্যাসী ভক্তরা এবার এক মহাসম্মিলনে বইয়ে দেবেন নতুন জীবনধারা। তা আত্মিক উন্নতির যতখানি, ততখানিই সার্বিক উন্নতির। একটিকে ছাড়া অপরটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায় না। এই গণচৈতন্য নির্মাণ আর তার বহমান ধারাটিই শ্রীরামকৃষ্ণ উপহার দিলেন বাঙালিকে।
শুরুতে তাকে বাঙালির সান্টা ভেবেছিলাম। তিনি হয়তো তাতে আপত্তি করতেন না। তবে, আক্ষেপ করতেন। সান্টা যদি বহুজাতিকের আমদানিও হয়, তবু তার ভিতরেও কিছু দেওয়ার সূত্রটি থেকেই যায়। থেকে যায় অন্যের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে উপহারে বদলে দেওয়ার কথাটি। অপর থেকে বেরিয়ে আপন করে নেওয়ার মঙ্গলচিহ্ন। সেলিব্রেশন আর কার্নিভালের গলে গলে পড়া আলো কি সে কথা মনে রেখেছে!
২৫ থেকে ১, দিন সাতেক। বস্তুর উৎসব পেরিয়ে অন্তর্গত আনন্দের উৎসবে এসে পড়া। চৈতন্য থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ হয়ে চৈতন্যের উপহারে। আর এই পথটুকুএই কাশীপুরের কল্পতরু যেন তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। যে আমরা বিচ্ছিন্ন, আত্মরতিপ্রবণ, শিশ্নোদরপরায়ণ সভ্যতার নালেঝোলে একশা। বস্তুসুখের বিপন্নতা আর ক্লান্তি পেরিয়ে একবার কি অন্তত নিজেরাই আমরা বলব না, আমাদের চৈতন্য হউক!
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে