কলকাতা হাইকোর্ট তৈরি হয়েছিল বেলজিয়ামের ইপ্রেস শহরের তেরোশো শতাব্দীর একটি বাজার ভবন বা ‘ক্লথ হাউস’-এর আদলে। যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেখানের বাজার ভবনটি ধ্বংস হয়ে যায়। তাই এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে, স্থপতি গ্রানভিল ঠিক কতটা সেই ভবনের আদল অনুসরণ করেছিলেন হাইকোর্টের জন্য। এই বিচারালয়ের স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য– বিচারালয়ের জটিল নকশা সম্বলিত ক্যাপিটালস বা স্তম্ভের শীর্ষ অলংকরণ। এই অলংকরণের মধ্যে সবার অলক্ষে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইংরেজের ভাবমূর্তিকে।
৬.
কলকাতা হাইকোর্ট তৈরি হয়েছিল বেলজিয়ামের ইপ্রেস শহরের তেরোশো শতাব্দীর একটি বাজার ভবন বা ‘ক্লথ হাউস’-এর আদলে। যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেখানকার বাজার ভবনটি ধ্বংস হয়ে যায়। তাই একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে, স্থপতি গ্রানভিল ঠিক কতটা সেই ভবনের আদল অনুসরণ করেছিলেন হাইকোর্টের জন্য। এই বিচারালয়ের স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য– বিচারালয়ের জটিল নকশা সম্বলিত ক্যাপিটালস বা স্তম্ভের শীর্ষ অলংকরণ। এই অলংকরণের মধ্যে সবার অলক্ষে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইংরেজের ভাবমূর্তি। ক্যাপিটালগুলির নকশা ও অলংকার নরমান্ডির খনি থেকে তুলে আনা ক্রিম রঙের চুনাপাথর, যা ‘কাঁ স্তোন’ নামে পরিচিত, সেই পাথর থেকেই খোদাই করা হয়েছিল।
হাইকোর্ট ভবনের প্রত্যেকটি ক্যাপিটাল নকশাগতভাবে জটিল খোদাই কাজ দিয়ে অলংকারময় করা হয়েছে। যে কারণে প্রত্যেকটি থামের ক্যাপিটাল নিজের মতো করে সজ্জিত এবং স্বতন্ত্র চেহারা নিয়েই দাঁড়িয়ে। ভারী পত্রপল্লবের পুরু স্তর নিচের দিক থেকে উপরের দিকে উঠেছে এবং পাতার ও ফুলের গুচ্ছে শেষ হয়েছে। এই পাতার মধ্যেই শিল্পী সচেতনভাবে যুক্ত করেছেন মানবমূর্তি এবং নানা ধরনের পাখি ও সরীসৃপের মুখ। অষ্টভুজাকৃতির ক্যাপিটালে মূর্তিগুলি চরিত্র অনুসারে দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম স্তরের মুখগুলি অপেক্ষাকৃত জটিল খোদাই কাজ দিয়ে অলংকৃত। আর দ্বিতীয় স্তরের মুখগুলি প্রচুর পরিমাণে অলংকার ও নানা ধরনের মোটিফ দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে।
স্থাপত্য অলংকরণ হিসেবে মানবমূর্তি এবং প্রাণীর রূপ ব্যবহারের রীতি পাশ্চাত্যের শিল্পকলায় বহু পুরনো একটি ধারা। এই ধারার সব থেকে বেশি ব্যবহার দেখা যায় তেরোশো শতাব্দীর গথিক স্থাপত্যে, বিশেষত ফ্রান্সে। এই ধরনের স্থাপত্যের মূল চরিত্র হল রূপক ভিত্তিক নির্মাণ। যেখানে স্থাপত্যের ক্ষুদ্রতম অংশও হয়ে ওঠে নানা কারণে অর্থবহ। এই অর্থবহ নকশা ফুটে উঠেছে হাইকোর্ট ভবনে। এবং সামগ্রিক নকশার সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গথিক শৈলীর খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ এমিল মাল মনে করতেন, ‘মধ্যযুগে শিল্প ছিল শিক্ষামূলক। মানুষের যা যা জানা প্রয়োজন, যথা– পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাস, ধর্মীয় মতবাদ, সাধুদের উদাহরণ, গুণাবলির শ্রেণিবিন্যাস, বিজ্ঞান, শিল্প এবং কারুশিল্পের পরিসীমা– এগুলি সমস্তই শেখানো হত গির্জার জানালাগুলোর মাধ্যমে।’ আসতে ধীরে এই শিক্ষা প্রতীক মিশে যেতে থাকে স্থাপত্যের খিলানে ও নানা অঙ্গে।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
এই ধারাতেই হাইকোর্ট ভবনে ভারতের মানুষকে শেখাতে চেষ্টা করা হল, এ দেশকে ইংরেজ দেবে সুবিচার। সেই সুবিচারের বাণী লিপিবদ্ধ করে রাখা হবে উদাহরণ হিসেবে। এ দেশের বুকে ইংরেজ প্রতিষ্ঠা করবে ধর্মের জয়গান। ইংরেজ আরও বলল, এদেশের জমিকে ফুলে ফলে ভরিয়ে রাখবে ইংরেজ। এই ভাবনার প্রতিফলনেই থামের নকশায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে মিউজিশিয়ন, গ্রিন ম্যান, স্ক্রাইব ইত্যাদির মুখ। এভাবেও ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের কথা ভেবেছিল ইংরেজ।
তথ্য সূত্র: The High Court at Calcutta, 150 Years: An Overview
ছবি মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়
…. ভাবমূর্তি-র অন্যান্য পর্ব ….
পর্ব ৫। ইংরেজ ভাবনার জীর্ণ স্মৃতি নিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের রোমান ‘মিনার্ভা’
পর্ব ৪। ত্রিবেণী টোলের পণ্ডিত উজ্জ্বল করলেন হেস্টিংসের ভাবমূর্তি
পর্ব ৩। বঙ্গভঙ্গের ছায়া মুছতে অঙ্গমূর্তির পরিকল্পনা করেছিলেন লর্ড কার্জন
পর্ব ২। হেস্টিংসের মূর্তি আসলে অত্যাচারীরই নতুন ভাবমূর্তি
পর্ব ১। শাসককে দেবতা বানানোর অভিপ্রায়েই কলকাতায় পথে-প্রান্তরে ইংরেজরা বসিয়েছিল মূর্তি
কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে আমার যে গবেষণা কাজটি আছে শঙ্খ ঘোষের তত্ত্বাবধানে, সেটির শিরোনাম ‘শ্রীমতী হে’, মঞ্চে এই অনুষ্ঠান বারে বারে করে থাকি, একটি সিডিও বেরিয়েছিল ওই নামে হিন্দুস্থানের রেকর্ডস থেকে। সেটি আবার করেছিলাম দূরদর্শনের জন্য।