পিপল ফর অ্যানিম্যাল্স-এর প্রদর্শনী ছাড়াও আমার প্রদর্শনীতে উনি অনেক গ্যালারিতে এসেছেন নিজের ইচ্ছায়। তাতে বুঝতাম যে উনি আমার ছবি পছন্দ করেন। কলকাতার গ্যালারি ৮৮-এর শুরুর দিকে প্রীতীশ নন্দীর সঙ্গে কবিতা-ছবির একটা প্রদর্শনী করেছিলাম, সে কথা আগেও বলেছি, সেই শোয়ের পরের বছর আমি নিজের একটা এগজিবিশন করেছিলাম বেশ বড় সাইজের জলরঙের কাজ দিয়ে। সেখানে এসেছিলেন মেনকা গান্ধী এবং আমার ছবি কিনেছিলেন। সেটা ছিল জাহাঙ্গীরের আগে। সেই থেকেই আমার ছবির সঙ্গে ওঁর পরিচয়।
২৪.
মানুষ বোধহয় সবচেয়ে ভালবাসে নিজেকেই। আর মুখখানা যদি হয় চাঁদপানা তাহলে তো দেখতে হবে না। আয়নার সামনে থেকে সরবেই না। তবে যেমন মুখই হোক, নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে আশ মেটে না কারও। আগেকার দিনে ছিল ফোটো অ্যালবাম আর এখন হয়েছে সেলফি তোলার নেশা। শুধু তাই নয় নিজের ছবি আবার রোজ সোশাল নেটওয়ার্কে লাগিয়ে অন্যদের দেখানোরও আর একটা চল হয়েছে। আমি ছবিতে মুখ আঁকতে পছন্দ করি, কিন্তু পয়সা নিয়ে, যাকে বলে ‘পেশাদারি প্রতিকৃতি শিল্পী’, সেটা কখনওই হতে চাইনি। পয়সার প্রয়োজনে শুরুর দিকে, অল্প বয়সে মুখ আঁকিনি, তা নয়। ছাত্র জীবনে কলকাতার আর্ট ফেয়ারে পেনসিলে মুখ এঁকেছি অনেক। সে যেন ছিল ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতা।
সবচেয়ে মুশকিল হয় মেয়েদের মুখ আঁকতে। মনমতো মুখখানা আঁকার কাজ যেন আর শেষই হয় না। শুনেছি, মোনালিসার মুখ আঁকতে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কেটে গিয়েছে বহু বছর। সমস্যা নানা। তাদের মুখের কোনও কোনও অংশ এমনই পছন্দ যে আঁকার পরে সেটাতেই আটকে থাকে। ‘নাকটা না, ঠিক হয়নি’। ‘আমার নাকটা বেশ ঠিকলো, অমন জামরুলের মতো নয়’। কিংবা ‘ভুরুটা বড্ড মোটা হয়ে গেছে’ ইত্যাদি। মেয়েদের মুখের এই যে অংশ প্রীতি, ছবি না আঁকলে সেটা জানতাম না কোনও দিন। আবার টোটাল মুখমণ্ডলে অন্য ঝামেলা। ‘মুখটা একটু বেশি লম্বা লাগছে, গালটা কেমন চুপসে গেছে’ কিংবা ‘অত ফোলা ফোলা মুখ দেখে মনে হচ্ছে চালতা’।
গোলগাল বুদ্ধিদীপ্ত মুখখানাতে পাঠ করা চুল, বড় বড় চোখ, এমন একজন মহিলার মুখ এঁকেছিলাম। এঁকেছিলাম তিনবার। প্রথম দু’বার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার। তিন নম্বরটিতে নতুন অভিজ্ঞতা। তিনিও তাঁর নিজের মুখের ছবি দেখতে ভালোবাসেন। এই তিন নম্বর ছবিখানা আসলে এক নম্বর ছবির প্রতিলিপি। হুবহু কপি। প্রথম ছবিটা কোনও কারণে, বৃষ্টিভেজা দেওয়াল থেকে হয়তো, ছত্রাকে নষ্ট হয়ে যায়। সেই ছবিটাকে আরেকবার আঁকতে বললেন ভদ্রমহিলা। আমার নিজের ছবি, তাও জলরঙে আঁকা, কী করে আমি কপি করতে পারি হুবহু! কিন্তু কপি করতেই হবে তার কারণ, এবার আর নিজের মুখখানা নয়, ওই ছবির মুখখানাই তাঁর প্রিয় বলে। এমনও হয়!
আরেকটা নতুন ছবি চলবে না, ওই ছবিটার হুবহু নকল চাই। অদ্ভুত আবদার। এঁকেছিলাম সেই ছবি আর একবার। জলরঙে নিজের ছবির রং মিলিয়ে আবার একই ছবি। ভীষণ কঠিন ব্যাপার। উনি খুশি হলেন। সেই ছবির মুখখানা যাঁর, তিনি শ্রীমতী মেনকা গান্ধী। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর স্ত্রী।
মানেকা, মেনেকা, মেনকা। ওঁর নামের তিন রকম উচ্চারণ শুনে থাকি। এখানে আমরা ওঁকে মেনকা বলেই ডাকব, কিংবা মিসেস গান্ধী। বিয়ের আগে প্রথম জীবনে ফ্যাশন মডেল ছিলেন মেনকা গান্ধী। বিউটি কনটেস্টে যোগ দিয়েছেন। বয়স তখন ১৭, একটা বিজ্ঞাপনে ফ্যাশন মডেল হিসেবে কাজ করেছিলেন মেনকা এবং সেই বিজ্ঞাপনে দেখেই সঞ্জয় গান্ধীর পছন্দ, তার পরপরই বিয়ে। সঞ্জয় গান্ধীর চেয়ে ১০ বছরের ছোট। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ১৮ বছর বয়স তখন।
সেনা বিভাগে কর্মরত শিখ সম্প্রদায়ের পিতার কন্যা, মেনকা আনন্দ। দুর্ভাগ্যক্রমে সঞ্জয় গান্ধীর বিমান দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু এবং মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিধবা হলেন মেনকা, তখন তার পুত্র সন্তান মোটে তিন মাসের। তারপর নিজস্ব ‘একলা চলো’ জীবন। রাজনৈতিক কাজকর্মের বাইরে তিনি একজন বিদুষী মহিলা। লেখাপড়া শিখেছেন দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে। জার্মান ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। এবং তিনি সাংবাদিকতা ছাড়াও লেখক ছিলেন। বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে। শব্দের ব্যুৎপত্তি, অর্থ ও তার ইতিহাস, আইন এবং প্রাণীদের অধিকার।
অম্বিকা শুক্লার, মানে মেনকার বোনের বাড়ি সাউথ মুম্বইয়ে। এখানেই আমাদের সামনাসামনি দেখা হয় প্রথম মেনকা গান্ধীর সঙ্গে। আমরা তখন মুম্বইয়ে সেট করে গিয়েছি। মুম্বইয়ের ব্যস্ততার জীবনের সঙ্গেও ফিট করে গেছি। ছেলেপুলেকে পাশের বাড়িতে জমা করে দিয়ে আমি আর মধুমিতা মানে আমার স্ত্রী যেখানে খুশি, এমনকী, রাতবিরেতেও। পিপল ফর অ্যানিম্যাল্স। পশু হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, রাস্তার ছাড়া কুকুর, বিড়াল, গরু মোষ, পশু-পাখিদের অসুখ, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে সেদিন নতুন রকম আলোচনা হল। খানিকটা মাথায় ঢুকল, খানিকটা ঢুকল না। আমাকে কেন ডাকা হয়েছে সেটা পরে বুঝেছিলাম, সে কথায় পরে আসছি।
গরুর দুধের রাসায়নিক গুণ ও জ্ঞান অনেকটা হল আমাদের। উনি বলছিলেন যে ধরা যাক, আমাদের মানুষ প্রজাতির মায়েরা, তাদের বুকের দুধে যদি মায়ের স্তনের অসুখ থাকে, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ভয় থাকে সে দুধ মা দেবে না তার নিজের বাচ্চাকে। এই জ্ঞানটুকু যদি মানুষের হয়ে থাকে, তাহলে কী করে একটি সংকর জাতের গরু, অসুস্থ গরু যারা প্রায়শই প্যারা-ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগছে কিংবা এই যে হাইব্রিড গরুর দুধ, তাতে কী রাসায়নিক ব্যাপার আছে যা আমাদের শরীরে পুষ্টি দেবে। মুখের স্বাদ আর ফ্যাশনেবল মিষ্টি খেতেই আমরা শুধু কি অভ্যস্ত থাকব?
এত শত জ্ঞান কারওরই ভালো লাগবে না, আমারও লাগেনি। এত বড় বক্তৃতার মূল কারণ ছিল, আমাকে যে চা দেওয়া হয়েছে তাতে দুধ দেওয়া হবে না। আমি তখন চায়ে দুধ খেতাম। দয়া করে আমাকে এক চামচ দুধ দাও। সে দুধ যদি দুধ না হয় তাও চলবে, চায়ের রংটা চাই। মেনকার বোন, দয়াবতী মহিলা আমাকে দিতে চাইলেন দুধ। কিন্তু মিসেস গান্ধী তার জেদবশত আমাকে সেদিন চায়ে কোনওক্রমেই এক চামচ দুধ দেননি। তবে দুঃখ ভুলে গিয়েছিলাম ওঁর বক্তৃতার শেষ লাইনে। বললেন, ‘মনে রাখতে হবে, গরুর দুধ কিন্তু আমাদের জন্য নয়, ওটা ওর বাছুরের জন্য’।
পশু কল্যাণ কেবলমাত্র প্রাণীদের জন্য নয়, এটি আমাদের মানুষের জন্যও। আমাদের জীবনযাত্রার, আমাদের সন্তানদের আর পৃথিবীর হিতার্থে। প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা কখনও শান্তিপূর্ণ সমাজ, মনের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং পরিবেশের কল্যাণ করে না। অনেক কিছুই আমরা শুনি, বোঝার চেষ্টা করি না। এমনই একটা ভাবনা থেকে ১৯৯২ সালে, মিসেস গান্ধী ‘পিপল ফর অ্যানিম্যাল্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা এখন ভারতের বৃহত্তম প্রাণী অধিকার সংস্থা। দেশব্যাপী ২৬টা হাসপাতাল, ১৬৫টি ইউনিট, ৬০টি মোবাইল ইউনিট এবং ২.৫ লক্ষ সদস্যের নেটওয়ার্ক নিয়ে অসুস্থ ও অভাবী প্রাণীদের উদ্ধার এবং পুনর্বাসনের পরিষেবা। আন্তর্জাতিক প্রাণী উদ্ধারের পৃষ্ঠপোষক মেনকা গান্ধী এবং নীতিগত, স্বাস্থ্যগত কারণে একজন নিরামিষাশী। বাণিজ্যিক শোষণের কারণে প্রাণীদের দুর্দশা, এ বিষয়ে একটি সাপ্তাহিক টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘হেডস অ্যান্ড টেইলস’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল তখন। একই নামে একটা বইও আছে।
প্রাণীদের বিপদ থেকে উদ্ধার করা বলতে মনে পড়ছে, জ্যান্ত আগ্নেয়গিরি দেখতে গিয়েছিলাম ইন্দোনেশিয়ায়। এখনও পাহাড়ের চুড়ো থেকে হালকা ধোয়া ওঠে। আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি দৃশ্য দেখতে আমরা সুরক্ষিত দূরত্বে অন্য আর একটি পাহাড়ে অনেকটা উচ্চতায় একেবারে ভ্যালির পাশে। যাওয়ার পথে একটা জায়গায় আমরা নেমেছিলাম। একেবারে আকাশের নিচে শুধু ছাউনির তলায় বড় একটা শেল্টার। কোনও দুর্ঘটনা থেকে বা বিপদ থেকে বাঁচিয়ে আনা পশু-পাখিদের রাখার এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা। দেখে ছোটদের তো ভালো লাগবেই আমারও ভালো লেগেছিল। একটা বেশ বড়সড়ো কুচকুচে কালো রংয়ের স্বাস্থ্যবান বাদুড় ওপরে পা আটকে মাথা নিচু করে ঝুলছে। মাঝে মাঝে হালকা পাখনা নাড়ছে। আরও মজার, মেঝেতে বসে ওদেরই বাচ্চা পড়াশোনা করছিল, সে দেখলাম হোমওয়ার্ক করছে তার খাতাপত্তর নিয়ে একটি নিচু গোলটেবিলের ওপর। পরে দেখলাম ওটা টেবিল নয়, একটি প্রকাণ্ড ময়াল সাপ গোল করে পেচিয়ে শুয়ে আছে আর শিশুটি তার ওপরে বইপত্র রেখে পড়াশোনা করছে। পশুদের বিপদ থেকে রক্ষা এবং তাদের একেবারে মানুষের সঙ্গে রেখে ভালোবেসে, গায়ে মাথায় চড়ে খেলা করছে– এমন দৃশ্য জীবনে ভোলার নয়।
আর একবার আফ্রিকার কেনিয়াতে গিয়ে ‘কেনিয়ান সাফারি ক্লাব’-এর পাশে চমৎকার পরিচ্ছন্ন একটা বিরাট এলাকা জুড়ে দুর্গত পশুদের সুরক্ষা এবং তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা দেখেছিলাম। সেখানে একদিন সকালে ছোটদের মতো আমিও গেছিলাম ওই এলাকায় ঘুরতে আর অদ্ভুত দুষ্প্রাপ্য পাখির রঙিন পালক কুড়োতে। ওই কেনিয়া জায়গাটার অবস্থান, জিরো ল্যাটিটিউডে মানে পৃথিবীর শূন্য অক্ষাংশে।
১৯৯৫, মুম্বাইয়ের জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে পিপল ফর অ্যানিম্যাল্স-এর পশু হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদির ফান্ডিং-এর জন্য ছবির শো হল বড় করে। আমার একক প্রদর্শনী। ৬৩ খানা ছবির সেই শো। অম্বিকা শুক্লা, প্রীতীশ নন্দী, মেনকা গান্ধী তো ছিলেনই উদ্যোক্তাদের মধ্যে, আর ছিল আমাদের বন্ধু, তখনকার পিএফএ-র মুম্বই শাখার সেক্রেটারি প্রেমল সাংভি। এঁদের উসকানিতে আমিও উত্তেজিত। তখন অবশ্য বয়স কম, পরিশ্রমের কোনও কমতি নেই। অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল, যেটা ভাবতে এখনও আমি ভয় পাই। জলরঙে যদিও চটজলদি কাজ করা যায়, তাও একটা অভাবনীয় কম সময়ের মধ্যে অন্তত ৬০ খানা ছবি এঁকে ফেলেছিলাম, আর দু’-তিনটে ছবি বড়, সেগুলো আগের। সেই ছবিগুলো আঁকার জন্য আমি দিন কুড়ি বাড়ির বাইরে বেরইনি। শুধুমাত্র খাওয়া, ঘুমানোর সময় ছাড়া সর্বক্ষণের জন্যই ঘরের মধ্যে থেকে ছবি আঁকা। ২০ দিনে ৬০ খানা ছবি মানে গড়ে তিনটে ছবি প্রতিদিন। জলরঙের জল গড়িয়ে যা হোক একটা কাজ করা নয়, প্রতিটি ছবি ছিল ফিগারেটিভ। মানুষজন এবং পশুপাখি নিয়ে কাগজে মাঝারি সাইজের জলরং। নিজেকে একেবারেই শুষে নেওয়া, ক্ষমতার শেষ পর্যন্ত দেখা আর কী! তেমন কাজ করার ঘটনা আর জীবনে কখনো ঘটবে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
খুবই ঢাক ঢোল পিটিয়ে সেই প্রদর্শনী হয়েছিল। ভীষণ বড় প্রচার, পাবলিসিটি। অনেক সংবাদ সংস্থা এবং ধনী সংস্থাগুলো থেকে সেই চ্যারিটি শোয়ে ভালো রকমের হাত বাড়িয়েছিল। পোস্টারে সমস্ত শহর ছেয়ে দেওয়া ছাড়াও আশ্চর্যভাবে অনেকগুলো বড় বড় হোর্ডিং পাওয়া গেল শহরের বিভিন্ন জায়গায়। মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভে চার্নি রোড স্টেশনের কাছাকাছি সম্ভবত শহরের সবচেয়ে বড় হোর্ডিং, স্টেশন থেকে শুরু করে একেবারে সমুদ্র পর্যন্ত বিশাল ডবল রোডের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ওই বড় হোর্ডিংয়ে লেখা ছিল শুধু দুটো লাইন ইংরেজিতে। উপরের লাইনে লেখা ছিল আর্ট এগজিবিশন অফ পিপল ফর অ্যানিম্যাল্স এবং তারিখ। নিচের লাইনে, সমীর মণ্ডল অ্যাট জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি। সেইটা আমরা আলাদা করে দেখতে গিয়েছিলাম, ছবিও তুলে রেখেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী, বিশাল বড় করে আমার নাম ওই হোর্ডিংয়ে দেখে আনন্দ নয় লজ্জাই পেয়েছিলাম বেশি। মুম্বইয়ের জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারির পরে বিশাল সাইজের ওই প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম মিসেস গান্ধী নিয়ে গেলেন দিল্লিতে, পার্ক হোটেলে। সেখানেও মহাসমারোহে আর একবার দেখানো হল দিল্লির দর্শকদের।
পিপল ফর অ্যানিম্যাল্স-এর প্রদর্শনী ছাড়াও আমার প্রদর্শনীতে উনি অনেক গ্যালারিতে এসেছেন নিজের ইচ্ছায়। তাতে বুঝতাম যে উনি আমার ছবি পছন্দ করেন। কলকাতার গ্যালারি ৮৮-এর শুরুর দিকে প্রীতীশ নন্দীর সঙ্গে কবিতা-ছবির একটা প্রদর্শনী করেছিলাম, সে কথা আগেও বলেছি, সেই শোয়ের পরের বছর আমি নিজের একটা এগজিবিশন করেছিলাম বেশ বড় সাইজের জলরঙের কাজ দিয়ে। সেখানে এসেছিলেন মেনকা গান্ধী এবং আমার ছবি কিনেছিলেন। সেটা ছিল জাহাঙ্গীরের আগে। সেই থেকেই আমার ছবির সঙ্গে ওঁর পরিচয়।
সালোয়ার কামিজ পরে, গায়ে লাল শাল জড়িয়ে মেনকা গান্ধী একবার এলেন শীতকালে পাড়া বেড়ানোর মতো ঘরোয়াভাবে দিল্লির ইন্ডিয়া হ্যাবিটাট সেন্টারে। যেন পাশের বাড়ির বনানীদি! এসেছিলেন আমার একক প্রদর্শনী দেখতে। সুযোগ পেলেই উনি আসতেন ছবি দেখতে। ছবি পছন্দ করতেন বুঝতাম। দিল্লি বলে কথা, তাই দর্শকের মধ্যে পেয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহকে, পরিবারের লোকজন সমেত। সপরিবার রেণুকা চৌধুরী এবং আরও কিছু দিল্লির রাজনৈতিক মহলের মানুষ। বণিক শ্রেণির মানুষ, আর্ট গ্যালারির লোকজন আর অনেক লোকাল শিল্পী-বন্ধুরা।
আলোচনার শেষের দিকে আবার ফিরে আসি ওঁর পশুপাখি প্রীতি এবং প্রাণীর অধিকার নিয়ে কাজকর্ম আর জীবন দর্শনে। মনে আছে নতুন নতুন মুম্বইতে এসে জুহু বিচে মাঝে মাঝেই যেতাম, কারণ আমার বসবাস ছিল খুব কাছাকাছি। তখন সেখানে টুরিস্টদের ভিড়। সবচেয়ে মজার ছিল যে উঠের পিঠে চড়া আর উটের গাড়ি। বালির ওপর দিয়ে জলের ধারে ধারে উটের গাড়িতে করে বাচ্চারা সমুদ্র দেখে আনন্দ পেত। পরে মিসেস গান্ধীর আপত্তিতে সে পরিবহণ বা বিনোদন বন্ধ হয়ে যায়।
সার্কাসে জন্তুর ব্যবহার পছন্দ করছেন না। একেবারেই পশুপাখি জন্তু-জানোয়ারদের দিয়ে কোনও খেলা দেখানোতে ঘোর আপত্তি। একবার অসমে গুয়াহাটি থেকে কাজিরাঙ্গা হয়ে শিলঙের দিকের রাস্তা ধরে গিয়েছিলাম ‘নুমালিগড় অয়েল রিফাইনারি’তে। সেখানে মাঝে মাঝে যেতাম অয়েল ডিফাইনারির এগজিকিউটিভদের ‘ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড প্রোডাক্টিভিটি’ বিষয়ে কর্মশিবির করতে। এই নুমালিগড়ে ছিল একটা বিরাট এরিয়া জুড়ে প্রজাপতি পার্ক। পার্কে প্রচুর পরিমাণে প্রজাপতি আর উপযুক্ত গাছপালা ও ফুল। জায়গাটা বিশাল হলেও সম্পূর্ণ তারের জাল দিয়ে ঘেরা সেই জায়গাটাই আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। মিসেস গান্ধী এলেন এবং এসে সাবধান করে গেলেন, প্রজাপতিদের কোনও কারণেই বন্দি অবস্থায় রাখা চলবে না।
এরই মধ্যে একটা মস্ত ঘটনা ঘটতে দেখা গেল। বহু লোক এই হাওয়ায় তাদের নিজস্ব অভ্যেস বদলে নিরামিষাশী হয়ে যেতে লাগল। অনেক চেনা নাম। প্রীতীশ নন্দী, এম.এফ.হুসেন, জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজ, রীতেশ দেশমুখ, আমির খান, অমিতাভ বচ্চন, কঙ্গনা রানাউত, গৌতম আদানি, হর্ষা ভোগলে। এমনকী, ২০২০ সাল পর্যন্ত ‘হটেস্ট ভেজিটেরিয়ান সেলিব্রিটি অ্যাওয়ার্ড’ নামের খেতাব। বিজয়ীদের মধ্যে রয়েছেন জিনাত আমান, জ্যাকি শ্রফ, ফাতিমা সানা শেখ, রাজকুমার রাও, আলিয়া ভাট, অক্ষয় কুমার, ভূমি পেডনেকর, শ্রদ্ধা কাপুর, সোনু সুদ, মানুষী চিল্লার, সুনীল ছেত্রী, অনুষ্কা শর্মা, কার্তিক আরিয়ান, বিদ্যুৎ জামওয়াল, শহিদ কাপুর, রেখা এবং অমিতাভ বচ্চন।
‘ভেগান’ এবং ‘ভেজিটেরিয়ান’ শব্দ দুটোর একরকম মানে নয়। এদের মানে আলাদা করতে শুরু করেছে মানুষ। ‘ভেগান’ শব্দটা আসলে ভেজিটেরিয়ান শব্দের শুরু এবং শেষের কয়েকটি অক্ষর নিয়ে শর্ট ফর্ম তৈরি করেছে। শব্দটা তৈরি হয় ১৯৪৯ সালে, সম্ভবত ইংল্যান্ডে। তবে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে হতে এখন যেটা দাঁড়িয়েছে সেটা অন্যরকম। এখন ওরা বলতে চায় এটা একটা ফিলোজফি আর একটা জীবন যাপনের নতুন ধারা। বিশেষ করে যেগুলোকে ত্যাগ করতে চায় সেগুলো হচ্ছে জন্তু-জানোয়ার থেকে কোন খাবার, তাদের থেকে তৈরি কোন ব্যবহারের জিনিসপত্র। পশুদের কষ্ট দেওয়া,পশুদের ওপর অত্যাচার, যানবাহন ইত্যাদিও পছন্দ করে না এরা। ফলে অনেকেই পশমি পোশাক, চামড়ার আসবাবপত্র, ব্যাগ, বেল্ট ইত্যাদি ত্যাগ করেছে। এছাড়া অনেকেই এখন অভয়ারণ্যে যেতে চায় কিন্তু সার্কাস বা চিড়িয়াখানাতে যেতে চায় না।
আমাদের দেশে পুরো নিরামিষাশী শহর? আমরা, বাঙালিরা ভাবতে পারি না। হ্যাঁ, ভারতেই বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী শহর। জায়গাটার নাম ‘পালিতানা’। গুজরাটের ভাবনগর জেলায় অবস্থিত একটি ছোট শহর, এটি জৈন ধর্মাবলম্বীদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র এবং সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় গন্তব্যস্থল। বাস্তবিকই এখানে খাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রাণী হত্যা করা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং ডিম, মাংস ইত্যাদি বিক্রি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ২৩: ড. সরোজ ঘোষ আমাকে শাস্তি দিতে চাইলেও আমাকে ছাড়তে চাইতেন না কখনও
পর্ব ২২: মধ্যবিত্ত সমাজে ঈশ্বরকে মানুষ রূপে দেখেছেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ২১: ‘তারে জমিন পর’-এর সময় আমির খান শিল্পীর আচার-আচরণ বুঝতেই আমাকে ওঁর বাড়িতে রেখেছিলেন
পর্ব ২০: আমার জলরঙের গুরু শ্যামল দত্ত রায়ের থেকে শিখেছি ছবির আবহ নির্মাণ
পর্ব ১৯: দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরতেন জয়াদি, না, কোনও স্টাইলের জন্য নয়
পর্ব ১৮: সিদ্ধার্থ যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা-জগতের কবি
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল