গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নিয়ে, শেষ দিকের একটি প্রবন্ধের নাম ‘পল্টুদা ও ১৯৮৪’। এই বছর দুয়েক আগে লেখা। জর্জ অরওয়েলের লেখা উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘১৯৮৪?’। এর মাঝে তিনি ‘তুঘলক’-এর সিনোগ্রাফি নির্মাণ করেছেন। এই ২০ বছরের রাজনৈতিক ভাষ্য একসুতোয় বাঁধা পড়ে যায়। বিগ ব্রাদার দেখছে, দেখবে। চতুর্দশ শতাব্দী হোক, ১৯৮৪ হোক, ২০০২ হোক বা ২০২৫। শাসকের সেই শ্যেনদৃষ্টির বিরুদ্ধে থিয়েটারের লড়াই। ‘অচ্ছে দিনে আক্রান্ত মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্র’ বা ‘নিশ্চুপ, স্বপ্রতারক বুদ্ধিজীবীরা’তে তিনি বারবার মনে করিয়ে দেন সমসময়ে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে একজন থিয়েটারশিল্পীর দায়িত্ব কী?
শম্ভু মিত্রের ‘সন্মার্গ সপর্যা’ গ্রন্থে একটি প্রবন্ধ আছে। নাম– ‘একটি অন্বেষণে’। বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যরীতির আদর্শ স্পর্শ করে তিনি কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করেন, তার ‘বহুরূপীয়’ পদ্ধতি। এই ‘অন্বেষণ’ শব্দটির ব্যবহার গ্রন্থজুড়ে বেশ কয়েকবার আছে। শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চার সঙ্গে যাঁরা কমবেশি পরিচিত, তাঁরা জানেন যে পেশাদার-গণনাট্য হয়ে তিনি কীভাবে নবনাট্যের ধারক-বাহক হয়ে উঠেছিলেন। এক অর্থে এটা তাঁর মাধ্যমে বাংলা থিয়েটারের সর্বাঙ্গীণ সফর। যার মূলে আছে ওই ‘অন্বেষণ’। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঝরা সময়ের কথাচিত্র’ গ্রন্থটি পড়তে পড়তে সবচেয়ে বেশি ‘অন্বেষণ’ শব্দটির প্রয়োগের কথা মনে পড়ছিল। এই শতকের শুরু থেকে আজ, ঠিক এই সময় পর্যন্ত দেবেশবাবুর সফর ও অন্বেষণের কাহিনি ‘ঝরা সময়ের কথাচিত্র’।
মূলত ২৭টি ছোটবড় প্রবন্ধের সংকলন এই গ্রন্থ। প্রথম প্রবন্ধটির প্রকাশকাল ২০০৩, নাম ‘অন্ধের স্মৃতিকথন’। বহু বিতর্কিত কিন্তু বাংলা থিয়েটারের মোড় ঘোরানো ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’-এর নির্মাণ নিয়ে কয়েকটি টুকরো কথার সমাহার। ব্রাত্য বসুর লেখা নাটকটি ‘বিতর্কিত’ কেন, সেটা আর নতুন করে বলার নয়। প্রবল প্রতাপশালী বাম আমলে দাঁড়িয়ে পার্টিজান শক্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে থিয়েটারের জয়গান আক্ষরিক অর্থেই মোড় ঘোরানো। ঘটনা হচ্ছে, এই নাটক যে নিছক ‘রাজনৈতিক থিয়েটার’ নয়, তার ঊর্ধ্বে শক্তিলোলুপতার চিরকালীন নীতির বিরুদ্ধাচারণ, সেটা সম্ভবত মঞ্চায়নের কালে দেবেশবাবু নিজেও বুঝতে পারেননি। সেই বিশ্বাসটা এসেছে আরও পরে, ২০১৩ সালে লেখা ‘মুখোমুখি বসিবার ব্রাত্য’ পড়লে যা বোঝা যায়। এই জন্যই গ্রন্থটির ক্ষেত্রে অন্বেষণ ও সফরের কথাটি প্রযোজ্য।
সাধারণত দেখা যায়, যে ধরনের নাট্যরীতি জনপ্রিয়তা তথা সাফল্য এনে দেয়, মানুষ সেটাকেই অনুসরণ করে। এমন নয় যে, সেই পদ্ধতি তাঁর কাছে ‘শর্টকাট’। আসলে মনে হয়, এটাই তাঁর সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের পথ বা এটাই তাঁর বহুদিনের না বলা বাণী ছিল। হ্যাঁ, বদল অবশ্যই আসে। তবে সেটা ক্লান্ত হওয়ার পর। দেবেশ চট্টোপাধ্যায় কোনওদিনই সে পথের পথিক নন। ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ থেকে ‘ব্রেন’, ‘ইয়ে’ থেকে ‘ফ্যাতাড়ু’, কিংবা ‘শের আফগান’ থেকে ‘সদাগরের নৌকা’– তাঁর নাট্যনির্মাণ কোনও স্থিতিশীল পদার্থ নয়। কীভাবে তিনি নিজেকে নিয়ে ভাঙাগড়ার খেলা খেলেন, ‘ঝরা সময়ের কথাচিত্র’-এ তার একটা রূপরেখা আছে।
২০০৭ সালে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের সিনিয়র ফেলোশিপে ‘কগনিটিভ নিউরোসায়েন্স ও থিয়েটার’ নিয়ে গবেষণা করেন। শর্ট টার্ম মেমোরিকে অ্যাসোসিয়েটিভ মেমোরি থেকে লং টার্ম করে থিয়েটারের অনুষঙ্গ কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটাই হল বিষয়। তার ফলে থিয়েটার নির্মাণের দৃষ্টিভঙ্গি যেভাবে বদলেছে, সেটা ‘মগজের থিয়েটার/থিয়েটার মগজ’ পড়লে বোঝা যায়। এটি গ্রন্থের সবথেকে দীর্ঘ প্রবন্ধ। তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক, তবে জটিল নয়। আবার ‘অভিনেতার স্মৃতি নিয়ে কাজ করি’ তাঁর গবেষণা ও থিয়েটারি প্রয়োগের প্রবন্ধরূপ। যেখানে তিনি বুঝিয়ে দেন, কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাত্র আড়াই দিনে ‘একদিন মন্দিরে যাওয়ার পথে’ নাটকটি তৈরি হয়। ও, মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, বাংলা থিয়েটারের প্রচলিত ‘নির্দেশক’ নন তিনি, দেবেশবাবুর নিজের ভাষায় ‘সিনোগ্রাফার’। কেন? তিনি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, ‘সেট, লাইট, মিউজিক, মেক-আপ, কস্টিউম– সবকিছু নিয়ে অভিনেতার সঙ্গে একটা বায়োলজিক্যাল সম্পর্ক তৈরি করা এবং দর্শকের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক তৈরি করা– এটাই সিনোগ্রাফারের মূল কাজ। এটার সঙ্গে সিনেমাটোগ্রাফি বা ফিল্মের কোনো অ্যাসোসিয়েশন নেই।’
…………………………….
সাধারণত দেখা যায়, যে ধরনের নাট্যরীতি জনপ্রিয়তা তথা সাফল্য এনে দেয়, মানুষ সেটাকেই অনুসরণ করে। এমন নয় যে, সেই পদ্ধতি তাঁর কাছে ‘শর্টকাট’। আসলে মনে হয়, এটাই তাঁর সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের পথ বা এটাই তাঁর বহুদিনের না বলা বাণী ছিল। হ্যাঁ, বদল অবশ্যই আসে। তবে সেটা ক্লান্ত হওয়ার পর। দেবেশ চট্টোপাধ্যায় কোনওদিনই সে পথের পথিক নন। ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ থেকে ‘ব্রেন’, ‘ইয়ে’ থেকে ‘ফ্যাতাড়ু’, কিংবা ‘শের আফগান’ থেকে ‘সদাগরের নৌকা’– তাঁর নাট্যনির্মাণ কোনও স্থিতিশীল পদার্থ নয়। কীভাবে তিনি নিজেকে নিয়ে ভাঙাগড়ার খেলা খেলেন, ‘ঝরা সময়ের কথাচিত্র’-এ তার একটা রূপরেখা আছে।
…………………………….
গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নিয়ে, শেষদিকের একটি প্রবন্ধের নাম ‘পল্টুদা ও ১৯৮৪’। এই বছর দুয়েক আগে লেখা। জর্জ অরওয়েলের লেখা উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘১৯৮৪?’। এর মাঝে তিনি ‘তুঘলক’-এর সিনোগ্রাফি নির্মাণ করেছেন। এই ২০ বছরের রাজনৈতিক ভাষ্য একসুতোয় বাঁধা পড়ে যায়। বিগ ব্রাদার দেখছে, দেখবে। চতুর্দশ শতাব্দী হোক, ১৯৮৪ হোক, ২০০২ হোক বা ২০২৫। শাসকের সেই শ্যেনদৃষ্টির বিরুদ্ধে থিয়েটারের লড়াই। ‘অচ্ছে দিনে আক্রান্ত মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্র’ বা ‘নিশ্চুপ, স্বপ্রতারক বুদ্ধিজীবীরা’তে তিনি বারবার মনে করিয়ে দেন সমসময়ে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে একজন থিয়েটারশিল্পীর দায়িত্ব কী? আবার ২০০৩ সালে লেখা ‘গ্রুপ থিয়েটারে গণতন্ত্র’-এ যে আশা-আশঙ্কার দোলাচলতা ছিল, তার কিছু স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। কিছু দুশ্চিন্তা আজও থেকে যায়। ২০ বছরের ওপার হতে ফিরে আসে ‘ফাটা ডিম’-এর অনুষঙ্গ।
কোথাও যেন মিশে যায় ১৯৮৯-এর কাহিনিও। খুন করা হয়েছিল সফদর হাসমিকে। পথনাটকের অগ্রণী পথিককে নিয়ে লেখা ‘হাল্লা বোল’ চিত্রনাট্যটি গ্রন্থের ব্যতিক্রমী আস্বাদ। বিষয়টা আরও দীর্ঘ হলে মন্দ হত না। আছে রবীন্দ্রনাথ, পিরানদেল্লোকে নিয়ে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। থিয়েটারের বাইরে কিছু স্মৃতিকথা আছে। কখনও ছোটবেলার জলের মধ্যে জাহাজ বা জুতোর মধ্যে বাড়ি খুঁজছেন, কখনও বা অমিতাভ বচ্চনের বাংলা সিনেমা ‘অনুসন্ধান’-এর গান ‘ফুলকলি রে ফুলকলি’ গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরা। এক দীর্ঘ পথচলা। সময়ের ধারাপাতে ব্যক্তি দেবেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলেমিশে যায় থিয়েটারকর্মী দেবেশের রোজনামচা। ওই যে বললাম, এটা তাঁর অন্বেষণের সফর।
শেষ প্রবন্ধের নাম ‘আমার সন্মার্গ, আমার সপর্যা’। প্রকাশকাল ২০২৪। যেখানে তিনি শম্ভু মিত্রের আদর্শকে আত্মস্থ করে লিখছেন, “বুঝতে শুরু করলাম নাট্যশিল্পের কোনো স্থাণু একক নেই। এই শতাব্দীপ্রাচীন যৌথ শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে অন্যান্য শিল্পের সম্পর্ক। তিনি লিখেছিলেন, ‘যে-শিল্প তার সমসাময়িক কালকে ধরতে ও বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা না করে সে শিল্প জীবন্ত নয়।’ আমার শিক্ষকের হাত ধরে আবার পড়তে শুরু করলাম, নতুন করে জানতে চাইলাম, বুঝতে চাইলাম ইতিহাসকে, শিল্পের ভাষাকে।”
…………………………
আরও পড়ুন সরোজ দরবার-এর লেখা: পিঠের উপর জেগে থাকা কাটা দাগই আসলে জীবন
…………………………
প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্ব মার্গ থাকে, নিজস্ব উপাসনা থাকে। ঝরে যাওয়া সময় মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপন পথ অন্বেষণের সুযোগ করে দেয়। সে তিনি যে ক্ষেত্রের লোকই হোন না কেন। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সেই অন্বেষণের সফরের নাম ‘ঝরা সময়ের কথাচিত্র’।
ঝরা সময়ের কথাচিত্র
দেবেশ চট্টোপাধ্যায়
এবং অধ্যায়
২৭৫ টাকা