২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রতন ভট্টাচার্য চলে গেলেন। তার আগে থেকেই চেষ্টা করছিলাম, যাতে কোনও পত্রিকা রতন ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি সংখ্যা, অন্তত ক্রোড়পত্র করে। আমাদের নিজেদের পত্রিকা তখন প্রায় ২০ বছর বন্ধ। পকেটে রেস্ত নেই, মাথায় কিন্তু সবসময়েই ‘উলুখড়’-এর পরবর্তী সংখ্যার পরিকল্পনা। বন্ধুবৃত্তে একই কথা শুনে শুনে তারা ক্লান্ত, শুধু অঞ্জন, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া। অঞ্জনই একদিন সুখবর নিয়ে এল, ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকার উৎপল ভট্টাচার্য ক্রোড়পত্র করতে রাজি হয়েছেন। সেই আহ্লাদ স্থায়ী হল না। ‘কবিতীর্থ’ আচমকাই পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়াল। আমরা দুই বন্ধু ভেঙে পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়ালাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ‘উলুখড়’ থেকেই বেরবে। তারপর সবটাই ইতিহাস। রতন ভট্টাচার্যের হাত ধরে কুড়ি, ২০ বছর পরে প্রকাশিত হল ‘উলুখড়’-এর দশম সংকলন।
রতন ভট্টাচার্যের কথা আমি শুনি কবি, চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কাছে। তিনি রতন ভট্টাচার্যের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় করানোর জন্য ‘ছোটগল্প’ পত্রিকার একটি সংখ্যা দেন, যাতে ‘পঙ্ককুন্ড’ গল্পটি ছিল। বুদ্ধদেবদা বিশেষ করে বলেন ‘কৃষ্ণকীর্তন’ গল্পের কথা। কিন্তু সেই সময়, তখনও রতন ভট্টাচার্যের সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়নি, ওঁর গল্প পাওয়া আমাদের পক্ষে যথেষ্ট দুরূহ। যের’ম স্বভাব আমার, কোনও একটি লেখা বা বইয়ের কথা মাথায় ঘুরঘুর করতে শুরু করলে সেটিকে করায়ত্ত না করতে পারলে আমাকে ঘোর অশান্তির মধ্যে কাটাতে হয়, আমি সম্ভাব্য সর্বত্র ‘কৃষ্ণকীর্তন’ খুঁজে বেড়াই। পাই না। ইতিমধ্যে আমার বন্ধু কৃষ্ণা ভট্টাচার্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে টেলিফোন ভবনের চাকরিটা পেয়ে যায়। অফিসে জয়েন করার আগে আমাকে ওর লাইব্রেরির কার্ডটা দিয়ে বলে, ‘তোর তো খুব ইচ্ছে ছিল, নে, কৃষ্ণ ভট্টাচার্য হয়ে লাইব্রেরিটা চষে ফেল।’ তখন লাইব্রেরির কার্ডে কোনও ছবি ছিল না। ‘নামই কাফি হ্যায়’! সেদিন কৃষ্ণার সৌজন্যে একটুকরো চাঁদ আমার করায়ত্ত হল। সেখানেই আমি ‘কৃষ্ণকীর্তন’ পাই। আমি মুগ্ধ। এর আগে বুদ্ধদেবদার সৌজন্যে রতনবাবুর কিংবদন্তি গল্প ‘পিঞ্জর’ পড়েছিলাম আর বেশ কিছুদিন ‘পিঞ্জর’-এর ঘোরেই ছিলাম।
‘কৃষ্ণকীর্তন’ আমাকে ধরাশায়ী করে দিল। যাকে বলে এক্কেবারে ফ্ল্যাট! এরপর, বেশ কিছুদিন পর শুরু হল রতন ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম গল্প ‘তৃতীয় মহাযুদ্ধ’। তারপর ‘রাজার এঁটো’। এক একটা গল্প বেরয় আর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। যেন আমরাই কামাল করে দিচ্ছি। ইতিমধ্যে ‘দেশ’ সুবর্ণজয়ন্তী গল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয় ’কৃষ্ণকীর্তন’। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বেরয় প্রথম পর্বের বাছাই গল্প নিয়ে ছোট একটা বই– ‘রতন ভট্টাচার্যের গল্প’।
প্রায়শই ভাবতাম, একদিন চলে যাব লেখকের বাড়ি। কিন্তু হয়ে ওঠে না। একদিন হাওড়া টাউন হলে একটি অনুষ্ঠানে, হলের বাইরে বসা অ-লেখকসুলভ এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে একজন বলল, ‘অরণি, তুমি রতনদার কথা খুব বল, চেনো রতন ভট্টাচার্যকে?’ আমি দু’দিকে ঘাড় নাড়লাম। ওই অ-লেখকসুলভ ভদ্রলোকের দিকে আঙুল তুলে সে জানাল, উনিই তিনি! আমি গুটিগুটি পায়ে তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। ওঁর পরনে শার্টপ্যান্ট, কোলের ওপর ফেলে রাখা অফিস ব্যাগ। কে বলবে ওঁর ওই সাধারণ শরীরের ভেতরেই জন্ম নেয় অসাধারণ সব গল্প! সংসার জীবনের যে কোণটা কেউ লক্ষই করে না, সে কোণটাই তাঁর লেখায় আশ্চর্য বিভা লাভ করে। সামান্য পরিচয় এবং আমার ও আমাদের মুগ্ধতা জানাতে হাসিহাসি মুখে একদিন বাড়িতে আসতে বললেন।
তাঁর বাড়ি যাওয়ার সুযোগ এল বেশ কিছুদিন পরে আচমকাই। গল্পকার বন্ধু অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলল, তারা আগামী রবিবার পাঁচলায় রতনবাবুর বাড়ি যাবে। জানতে চাইল, আমি যাব কি না। যাব তো বটেই। অঞ্জন, অমিতাভ সমাজপতি, অমৃত সাহা আর আমি। বাউড়িয়ায় ট্রেন থেকে নেমে লাইন পেরিয়ে বাসে পৌঁছে গেলাম পাঁচলার বোসপাড়া। বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করছিলেন রতন ভট্টাচার্য। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই আপ্যায়নের শুরু। এত খোলামেলা পরিবেশ যে, রতন ভট্টাচার্য, রতনবাবুর থেকে রতনদায় পৌঁছতে মিনিট পনের সময়ও লাগল না। চা পর্ব শেষ। বেলা হয়ে গেছে। বিরিয়ানি পর্ব শুরু। সেই বিরিয়ানিও রান্না করেছেন লেখক মহাশয় নিজে! অপূর্ব!
খাওয়া-দাওয়ার পর শুরু হল সাহিত্য পাঠ। সবাই নিজের নিজের গল্প পড়ল। আমি ছাড়া সবাই গল্পকার। আমি অনুরোধ করলাম, “রতনদা ‘নোয়ার নৌকো’টা পড়বেন?” উনি একদমই রাজি হলেন না। বললেন, ‘বড় গল্প। ওটা থাক।’ ওঁর গল্প পাঠের আগে আমার কবিতা পড়ার পালা। আমি বেছে বেছে কয়েকটা কবিতা পড়লাম। সেই থতমত কবিতা পাঠে রতনদার তারিফও পেলাম। রতনদা আমাকে, আমাদের বিস্মিত করে পুরস্কৃতও করলেন। ঘোষণা করলেন, “অরণির ইচ্ছে যখন, ‘নোয়ার নৌকো’ই পড়বো।” আমার জীবনে যত স্মরণীয় মুহূর্ত তৈরি হয়েছে, এটা তার অন্যতম। পাঁচলার বোসপাড়া পেরিয়ে আমরা যখন বাউড়িয়া স্টেশনের দিকে যাচ্ছি, তখন গাছে গাছে জোনাকি। রতনদার জীবৎকালে আর আমাদের দেখা হয়নি।
২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রতন ভট্টাচার্য চলে গেলেন। তখনই খবর পাইনি, জেনেছিলাম বেশ কিছুদিন পরে। তার আগে থেকেই চেষ্টা করছিলাম, যাতে কোনও পত্রিকা রতন ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি সংখ্যা, অন্তত ক্রোড়পত্র করে। আমাদের নিজেদের পত্রিকা তখন প্রায় ২০ বছর বন্ধ। আমি নিজে নানারকম সমস্যায় বিপর্যস্ত। পকেটে রেস্ত নেই, মাথায় কিন্তু সবসময়েই ‘উলুখড়’-এর পরবর্তী সংখ্যার পরিকল্পনা। বন্ধুবৃত্তে একই কথা শুনে শুনে তারা ক্লান্ত, শুধু অঞ্জন, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া। অঞ্জনই একদিন সুখবর নিয়ে এল, ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকার উৎপল ভট্টাচার্য ক্রোড়পত্র করতে রাজি হয়েছেন।
রতনদার পরিবার বেশ কয়েকবছর আগেই বাড়ি করে পাঁচলা থেকে মৌড়িগ্রাম চলে এসেছেন। বাড়ির নাম ‘পিঞ্জর’। এই নামকরণ কি এই জন্যে যে, পূর্ববঙ্গের খোলা হাওয়ায় বড় হওয়া রতনদা শহুরে বাড়িগুলিকে খাঁচা মনে করতেন? নাকি তাঁর প্রথম বিপুল সাড়া জাগানো গল্প ‘পিঞ্জর’ গল্পের নামেই বাড়ির নাম দিয়েছিলেন? পরের দিনই আমি আর অঞ্জন পৌঁছে গেলাম ‘পিঞ্জর’-এ। আমরা গিয়েছিলাম ২০০৯-এ। রতনদার স্ত্রী নীলাবউদি আমাদের প্রস্তাবে রাজি তো হলেনই, সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিয়ে দিলেন। দুঃখের সঙ্গে জানালেন, আমাদের যাওয়ার আগে পর্যন্ত সেভাবে কেউই দেখা করতে আসেননি। যদিও রতন ভট্টাচার্যের মুগ্ধ পাঠকের সংখ্যা কম ছিল না, আর তাঁর লেখক বন্ধুরা সবাই তারকা খচিত। অবশ্য রতনদার চিরকালীন আড়ালে থাকার অভ্যেসও এজন্য দায়ী।
আহ্লাদ স্থায়ী হল না। ‘কবিতীর্থ’ আচমকাই পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়াল। আমরা দুই বন্ধু ভেঙে পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়ালাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ‘উলুখড়’ থেকেই বেরবে।
তারপর সবটাই ইতিহাস। রতন ভট্টাচার্যের হাত ধরে কুড়ি, ২০ বছর পরে প্রকাশিত হল ‘উলুখড়’-এর দশম সংকলন।
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………………
মতি নন্দীর স্মৃতির গলিতে উত্তর কলকাতার কত যে দগদগে নাম! কত রঞ্জন-রশ্মি! এদিকে হরি ঘোষ স্ট্রিট তো, ওদিকে দুর্গাচরণ মিত্র। সেদিকে দর্জিপাড়া তো অন্যদিকে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট বা কাশী বোস লেন। উত্তর কলকাতার গলি মতির লেখায় শেষপর্যন্ত হয়ে উঠেছে এক একটি মহাদেশ।
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?