Robbar

ধূমপান ছাড়ার পর ডায়েরিতে নিজেকে ‘নতুন মানুষ’ ঘোষণা করেছিলেন সলিল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 24, 2025 8:17 pm
  • Updated:November 24, 2025 8:17 pm  

১৯৩০-১৯৪০ দশকের আগ্নেয় রাজনীতির আঁচ গায়ে মেখে কয়েকজন তরুণ, অধিকাংশই যাঁরা তখন আইপিটিএ-এর কালচারাল স্কোয়াডের প্রতিনিধি, চারের দশকের শেষাশেষি দিনান্তে আড্ডা জমাতেন দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের ছোট্ট চায়ের দোকান ‘প্যারাডাইস কাফে’-তে। জড়ো হতেন ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, কলিম শরাফী, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়, মৃণাল সেন এবং সলিল চৌধুরী প্রমুখ। সময়কে অনুপুঙ্খে গিলে নেওয়ার তাগিদে তাঁদের তর্ক-বিতর্কে বাদ যায় না তো কিছুই– থিয়েটার-সিনেমা-সাহিত্য-গান, সঙ্গে এই গিলে নেওয়ার অনুপান হিসাবে ক্রমাগত ঠোঁট-ছুঁয়ে-থাকা আগুন-বৃত্ত থেকে পাকে পাকে নিঃসৃত ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী

৭.

সৃজনবোধের স্বতঃস্ফূর্ত উন্মোচনে মদ্যপান সংক্রান্ত ‘কু-অভ্যাস’-এর অঙ্গাঙ্গী সম্পৃক্তি প্রসঙ্গে যেমন গত কিস্তিতে আমরা পেয়েছি সলিল চৌধুরীর আন্তরিক উদ্বেগ– শিল্প-সাহিত্যের সামগ্রিক ভবিষ্যতের সঙ্গে নিজেকেও একান্তে মিশিয়ে ফেলা ডায়েরির পৃষ্ঠায়, তেমনই ওই ১৯৮৮-র দিনলিপিতে মে এবং আগস্ট মাসের দুটো পৃথক তারিখে পাওয়া যাচ্ছে ধূমপান সম্পর্কেও তাঁর প্রবল উৎকণ্ঠা, এবং দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এই বদ-অভ্যাসের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখার পর মগজের গাড়ি ঠেলার অনিবার্য পেট্রল হিসাবে চিহ্নিত তামাকজাত ধোঁয়া উদ্‌গিরণের আয়েশ থেকে বার্ধক্যে নিজেকে বিচ্যুত করার মরিয়া আকুতি।

দীর্ঘ কয়েক দশক, অর্থাৎ পিছিয়ে যেতে যেতে আবারও পৌঁছনো যেখানে– ‘উত্তাল চল্লিশ’-এর ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’-কে সম্পূর্ণ করার দায়ভার কাঁধে তুলে নেওয়া একদল নবীন সাংস্কৃতিক কর্মীর দৈনন্দিন বলয়ে। সলিলের নিজস্ব স্মৃতিচারণা থেকে ধার নিয়েই গল্পটুকু বলা যেতে পারে। বিশেষত ধূমপানই যেখানে কেন্দ্রীয় উপজীব্য। ১৯৩০-১৯৪০ দশকের আগ্নেয় রাজনীতির আঁচ গায়ে মেখে কয়েকজন তরুণ, অধিকাংশই যাঁরা তখন আইপিটিএ-এর কালচারাল স্কোয়াডের প্রতিনিধি, চারের দশকের শেষাশেষি দিনান্তে আড্ডা জমাতেন দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের ছোট্ট চায়ের দোকান ‘প্যারাডাইস কাফে’-তে। জড়ো হতেন ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, কলিম শরাফী, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়, মৃণাল সেন এবং সলিল চৌধুরী প্রমুখ। সময়কে অনুপুঙ্খে গিলে নেওয়ার তাগিদে তাঁদের তর্ক-বিতর্কে বাদ যায় না তো কিছুই– থিয়েটার-সিনেমা-সাহিত্য-গান, সঙ্গে এই গিলে নেওয়ার অনুপান হিসাবে ক্রমাগত ঠোঁট-ছুঁয়ে-থাকা আগুন-বৃত্ত থেকে পাকে পাকে নিঃসৃত ধোঁয়ার কুণ্ডলী। সেই পর্বে সলিলের বান্ধববর্গের মধ্যে অধিকাংশই পার্টি-হোলটাইমার অথবা কাঠ-বেকার। ভবানীপুরের জমায়েতে একমাত্র মৃণাল সেনই তখন খানিক অর্থে চাকুরিজীবী, সামান্য মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। সলিল জানাচ্ছেন– ‘…কাজেই ওর পয়সাতেই চা-সিগারেট চলত।… ঋত্বিক বিড়ি খেত। তখন এক আনায় দুটো ক্যাপস্টান পাওয়া যেত। একদিন এক আনাই ছিল মৃণালের কাছে। তাই দিয়ে দুটো সিগারেট কিনে আমি পানওয়ালাকে বললুম, “ভাই, এই যে লম্বা লোকটি দেখছ, ওর সিগারেট খেলেই ভীষণ মাথা ঘোরে, রাস্তায় পড়ে যায়। একটা বিড়ি ফাউ দেবে? দিয়েছিল কিন্তু লোকটা! আমাকে গালাগাল দিতে দিতে বিড়িটাও ঋত্বিক খেয়েছিল।”…’ সামান্যই স্মৃতি-রোমন্থন, বন্ধুদের হালকা খুনসুটি, যা হয়তো প্রত্যেক প্রজন্মের অভিজ্ঞতাতেই একই মাত্রায় বিদ্যমান থেকে যায়। তথাপি এটুকুর মধ্যেই অনুসন্ধিৎসু মন খুঁজে নিতে গরম চায়ের ভাঁড় আর সিগারেট-বিড়ির ধোঁয়ার কাটাকুটি-বাদানুবাদে মজে ওঠা বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বঙ্গসংস্কৃতির প্রগতিপন্থী অভিমুখটুকু।

সবিতা চৌধুরীর সঙ্গে সলিল চৌধুরী

অস্কার ওয়াইল্ডের মতো সাহিত্যিক তো একসময় বলেইছিলেন– ‘A cigarette is the perfect type of a perfect pleasure’। হয়তো সলিল বা তাঁর ধূমপায়ী বন্ধুবর্গও একই ধারণার অনুসারী ছিলেন, বিশেষত যাঁদের কাছে তখন ‘perfect pleasure’ ছিল সৃজনচেতনায় আগুনের ইন্ধন জোগানোরই সমার্থক। আর অন্যদিকে এও এক মুশকিল– অতীতের ময়নাতদন্তে রোম্যান্টিসিজমের প্রাবল্যের রোগে কখনও কখনও আমরাও অজান্তেই যেন আক্রান্ত হয়ে পড়ি। সে চারের দশকের অন্তিমে ‘প্যারাডাইস কাফে’-র মানস দৃশ্যকল্প নির্মাণেই হোক, অথবা পরবর্তীতে ‘কফিহাউসের সেই আড্ডা’-য় টেবিল ঘিরে ‘তিন-চার ঘণ্টা চারমিনার ঠোঁটে’ জ্বলার ভবিতব্যকে সংস্কৃতিচর্চার অঙ্গাঙ্গী হিসাবে মেনে নেওয়ার মধ্যেও। 

তবু কোথাও বা কখনও তো মগজ খাটানোর অনুশীলন আর বিধিবদ্ধ স্বাস্থ্যচর্চার মধ্যে দ্বন্দ্ব বেঁধে যেতেই পারে। ঋত্বিকের মতো বন্ধুর বোহেমিয়ান জীবনচর্চার অনিবার্য পরিণতির দৃষ্টান্ত তো ১৯৮৮-তে টাটকা স্মৃতির দগদগে ঘা। আর নিজের অভ্যন্তরের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি আরও জমাট বেঁধে উঠেছে তখন, সমস্যাসংকুল শরীরের তরফে দেওয়া বিবিধ ইঙ্গিতে। তাই প্রয়াণের বছর সাতেক আগে সলিল চৌধুরী যে তেমন উপলব্ধিতেই ক্রমশ জারিত হচ্ছেন, তা ডায়েরির দুটো পৃষ্ঠার মধ্যেই রীতিমতো স্পষ্ট। যেদিন তিনি চলচ্চিত্রের মর্যাদাপূর্ণ বিএফজে পুরস্কারের মঞ্চে কৃতী শিল্পীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে আনন্দিত, প্রায় সমান্তরালে তখনও তাঁর ভেতর সক্রিয় ‘সিগারেট পাইপ ইত্যাদি’-র নেশা থেকে মুক্তির আন্তরিক উদ্যোগ। হয়তো তিনি তখন ইংরেজ লেখক অ্যালেন কার-এর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Easy Way to Stop Smoking’ পড়ে ফেলেছেন। অন্তরাত্মায় বিশ্বাস করে নিয়েছেন– “Quitting smoking is not a sacrifice; it’s a liberation”। চাইছেন লড়ে যেতে, তথাপি দোদুল্যমান– স্থির প্রত্যয়ে নিজেকে সামলে রাখার গন্তব্যে। মাসতিনেক এমনতর যুঝে যখন মিস্টার হাইডের মতো দৈত্যাকার অভ্যাসকে অহেতুক প্রশ্রয় না দিয়ে ডক্টর জেকিলের অবশেষে দৃপ্ত স্থিতি, অন্তত সলিল তাই মনে করছেন, তখনই মুক্তির আনন্দে তাঁর ঘোষণা– ‘আজ থেকে আমি নতুন মানুষ’। গানে গানে সামাজিক মুক্তির দিশারী যিনি, নিজের পার্থিব অস্তিত্বকে শেষমেশ শুদ্ধ রাখার আয়োজনে এটুকু খুশির আমেজ অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য।

………………..

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: অন্তরা চৌধুরী, শুভঙ্কর দে

………………..

ডায়েরির ৯টি পাতা, পড়ুন এক ক্লিকে

প্রথম পর্ব সলিল চৌধুরী নোটবইয়ে এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্কেচ

 দ্বিতীয় পর্ব জাপানি খাতায় লিখতে গিয়ে সলিল চৌধুরীর প্রথম মনে পড়েছিল জাপানি বোমার কথা

তৃতীয় পর্ব ফ্যাসিজম কাব্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে, ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন সলিল

চতুর্থ পর্ব সাম্যই প্রকৃতির অন্তরের কথা, এই বিশ্বাস সলিল চৌধুরীর ডায়েরির পাতায় পাতায়

পঞ্চম পর্ব মশলাদার নয়, ‘পার্সোনাল’ ফিল্ম করতে চান রাজ কাপুর, জানিয়েছিলেন তুই-তোকারির বন্ধু সলিলকে

ষষ্ঠ পর্ব নিজের সবচেয়ে বড় শত্রুর কথাও ডায়েরিতে লিখতে ভোলেননি সলিল