রাজস্থান আমাকে ফাফরার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল, আর ঢাকা শহর আমাকে ফাঁফরার সঙ্গে। দেখে চমকিত হওয়ার কিছু নেই, চন্দ্রবিন্দুতে অনেক কিছু হয়– যেমন ভেজ থেকে ননভেজ। উদয়পুরের এয়ারপোর্ট ডাবোকে কোনও কাজে গেলে ফেরার সময় সেখানে চলে যেতাম সেখানে সদ্য ভাজা ফাফরা আর জিলিপি খাওয়ার জন্যে। উত্তরাতে এই নেমন্তন্নে ঠিক মাংস নয়, একটু কচকচে কিন্তু অদ্ভুত সুস্বাদু, তা দিয়ে অর্ধেক ভাত সেই পদ দিয়ে খেয়ে ফেলার পর দেখি বন্ধুরা খাওয়া থামিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ‘এটা কেমন খেলে দোস্ত?’ ‘সাক্ষাৎ অমৃত!’ শুনলাম সেটাই হল ফাঁফরা।
১৪.
তারক মেহতার প্রতিবেশী জেঠালালকে মনে আছে? যে সুস্বাদু জিলিপি আর ফাফরার জন্যে দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধতে বা বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে ১০৮টি নীলপদ্ম খুঁজতে সদা তৈরি? পশ্চিম ভারতে থাকার সময় দেখেছি, জেঠালাল তো একটা নামমাত্র, ফাফরা আর জিলিপির ভক্ত গুনতে গেলে কোটি লোকের জেঠা হয়ে যাবে। ডাবোক থেকে চিতোরে যাওয়ার রাস্তায় অল্প এগোলেই নন্দওয়াল চৌরাহা, সেখানে সারি সারি ফাফরার দোকান। গুজরাতিরা নাথদোয়ারার শ্রীনাথজিকে খুব মানে। একলিঙ্গজি আর শ্রীনাথজি দর্শন করে নিজের রাজ্যে ফেরার পথে নন্দওয়াল চৌরাহাতে নাস্তা করত আর বাড়ির জন্যে ফাফরা নিয়ে নিত। উদয়পুরের এয়ারপোর্ট ডাবোকে কোনও কাজে গেলে ফেরার সময় সেখানে চলে যেতাম সেখানে সদ্য ভাজা ফাফরা আর জিলিপি খাওয়ার জন্যে। একদিন পাশে বসা গুজরাতি মধ্যবয়স্ককে এই ফাফরা-প্রীতি নিয়ে জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম, বেসন হনুমানজির প্রিয় আর জিলিপি রামচন্দ্রর। তাই বেসনের তৈরি ছাঁকা তেলে ভাজা ফাফরা আর জিলিপি খেলে রামচন্দ্র আর হনুমান– দু’জনকেই খুশি করা যায়। ভক্তি আর রসনার এমন অনন্য যুগলবন্দি দেখে পুলকিত হয়ে আর কথা বাড়াইনি– আরও দশ টাকার ফাফরা অর্ডার দিয়েছিলাম।
আমরা কলকাতার শহুরে মধ্যবিত্তরা মাংসের দোকানে গিয়ে রান্, সিনা, গর্দান ইত্যাদি জায়গার মাংস দেওয়ার জন্যে দোকানদারকে কাকুতিমিনতি করে থাকি আর বাকি অংশ সন্তর্পণে এড়িয়ে যাই। কিছু অংশ দেখে নিয়ে আগে আমি নিশ্চিত থাকতাম এই অংশগুলো ফেলা যায়– কবি যে ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা’ লিখেছিলেন, সেটা ভুলে যাই। কবির অনেক বছর আগে নবী তাঁর ধর্মাবলম্বীদের এই শিক্ষাই দিয়ে গিয়েছেন। ইসলাম ধর্মের অনেক সুশিক্ষার মধ্যে একটা হচ্ছে খাবার নষ্ট না করা। মধ্যপ্রাচ্যে যখন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন হয়, চারদিকের মরুভূমি আর রুক্ষ প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করা মানুষদের কাছে শিকার করা বা হালাল করা কোনও পশুর দেহের কিছু অংশ খাওয়া আর বাকি অংশ ফেলে দেওয়া একধরনের বিলাসিতা মাত্র– তাই নবী বলেছিলেন কোনও খাবার নষ্ট না করতে, যেটা বেঁচে যাবে, সেটাও যত্নে রেখে দিতে পরে খাওয়ার জন্য। তাই ব্রেন বা ভেজা, চর্বদা বা গুর্দা বা অন্ত্র, বা ফাঁফরা বা ফুসফুস– কোনও কিছুই ফেলে দেওয়ার রীতি নেই, সবটাই খাওয়া হয়। ইউরোপে সসেজ খাওয়ার রেওয়াজ সেই আদ্যিকাল থেকে– সেখানেও সেই একই গল্প, খাবার নষ্ট করবে না। আগের লেখাতেই ইউলিসিসের ব্লাড সসেজ খাওয়ার যে গল্প লিখেছি, সেটা এই মানসিকতার প্রতিফলন।
পড়ুন ‘ভাজারদুয়ারি’-র আগের পর্ব: শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামকে টেক্কা দেবে ভাতের বিবিধ নাম
রাজস্থান আমাকে ফাফরার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল, আর ঢাকা শহর আমাকে ফাঁফরার সঙ্গে। দেখে চমকিত হওয়ার কিছু নেই, চন্দ্রবিন্দুতে অনেক কিছু হয়– যেমন ভেজ থেকে ননভেজ। একদিন উত্তরায় আড্ডা দিচ্ছি– আর সেখানে বন্ধুদের গাল দিচ্ছি যে পাঁঠা বা গরুর সবকিছু খাওয়ার জন্য– ‘কিছু তো ছাড় রে বাপ!’ ওরা হেসে আমাকে বলছে, ‘মাছের কাঁটা অবধি যে কিলোদরে কিনে এনে চচ্চড়ি বানায়, সে খাবার ছাড়তে বলছে!’ পরের দিন এক দাওয়াতে যথারীতি বিভিন্ন পাত্রে খাবার সাজানো। চেনা খাবারের চেয়ে অচেনা পদ আমাকে বেশি টানে, তাই ঢাকা সরিয়ে সরিয়ে দেখছি। হঠাৎ নজরে এল তেল আর মশলার এক পুকুর থেকে কেউ আমায় ‘টুকি’ দিচ্ছে। সরাসরি আক্রমণ করলাম। ‘উপাদেয়’ বললে কম বলা হয়, ঠিক মাংস নয়, একটু কচকচে কিন্তু অদ্ভুত সুস্বাদু। অর্ধেক ভাত সেই পদ দিয়ে খেয়ে ফেলার পর দেখি বন্ধুরা খাওয়া থামিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ‘এটা কেমন খেলে দোস্ত?’ ‘সাক্ষাৎ অমৃত!’ তখন শুনলাম সেটাই হল ফাঁফরা। এরপরে চর্বদা খাওয়াটা সময়ের অপেক্ষা ছিল শুধু।
আরও পড়ুন: জুয়া-লগ্নে যে খাবারের জন্ম, এখন তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে
টোকোন আবার চর্বদা-ভক্ত হয়েছিল বিবিরহাট পেরিয়ে বুরুলে একটা কাজে গিয়ে। সেখানে কাজ করে যখন বেরচ্ছে, পেটে খিদের আগুনে ছুঁচোরা অবধি ঝলসে গিয়েছে। এক পথচলতি খাবারের দোকানে গিয়ে খাবার চাইতে শোনে চর্বদা আর পাউরুটি আছে। চর্বদার কোষ্ঠীবিচার না করে সে সটান অর্ডার দিয়ে দেয়। আর তেল-ভাসা লাল চর্বদার ঝোলের এমন প্রেমে পড়ে যায় যে, পার্ক সার্কাস বা খিদিরপুর কোনও কাজে গেলে চর্বদা না খেয়ে ফেরে না। আর ভেজা ফ্রাই? মুম্বইয়ের বড়ে মিয়াঁর ভেজা ফ্রাইয়ের রোল বা হাজি আলীর গেটের উল্টোদিকের ইরানি হোটেলে ভেজা ফ্রাই মসালা না খেয়ে যদি কোনও মাংসপ্রেমী ইহলোক ত্যাগ করে, ঈশ্বর তাকে কান ধরে ব্যাকলগ ক্লিয়ার করতে ফেরত পাঠাবে– হলফ করে বলতে পারি!
পরিশেষে একটা সাবধানবাণী– এই রান্নাগুলো পর্যাপ্ত তেল, মশলা, পেঁয়াজ আর রসুন না দিয়ে বাঙালি ট্যালট্যালে মাংসের ঝোল হিসেবে রান্না করলে ঈশ্বর পাপ দেয়।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে যে মন্ত্রিত্বই তাঁর হাতে থাক, বুদ্ধদেব ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে অতি নির্ভরযোগ্য এক সেনাপতির মতো। ‘আপনারা বুদ্ধর কাছে যান, বুদ্ধ ওসব কালচার-ফালচার বোঝে’– জ্যোতিবাবুর এই উক্তি যথার্থ কি না জানি না, কিন্তু কথাটা মিথ্যে ছিল না।