দেওয়ালে স্বেদবিন্দু মিশে গেলে মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোতেই আস্থা রাখে। তাই উঠে দাঁড়ালেন লিও। উঠে দাঁড়ালাম আমরা সবাই। তারপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভাগ্যদেবতা জীবনের লাস্টসিনে সবটুকু হিসেবে ফিরিয়ে দেন। নেপথ্যে শোনা যায়, ‘আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়নস্ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, এগেইন, অ্যাটলাস্ট অ্যান্ড এ নেশন উইল ট্যাংগো অল নাইট লং’।
অ্যান্ড আর্জেন্টিনা আর অ্যালাইভ– মেক্সিকো ম্যাচে পিটার ড্রুরির সেই কাব্যিক ধারাভাষ্য, যা আমাদেরও দ্বিতীয়বার বাঁচিয়ে দিল। শেষবার অনন্ত জীবনের উদ্দাম উদযাপন মিশেছে বটগাছতলা, সংহতি ক্লাব পেরিয়ে ওবেলিস্কোর দু’পাশের ব্যস্ত সড়কে। খাদের কিনারে দাঁড়ানো স্ক্যালোনির আর্জেন্টিনার ফিরে আসা। স্বপ্ন বোনা সহস্র রাত জাগা চোখ। যেভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল খনির গভীরে আটকে থাকা শ্রমিক। যেভাবে ক্ষমতার নির্লজ্জ আস্ফালনের থেকে বাঁচতে চেয়েছিল লাঠির ঘা খাওয়া যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা। যেভাবে দিল্লির প্রবল শীতে মার খেতে খেতে হাতে লাঠি তুলে নিয়েছিল বিক্ষুব্ধ কৃষক। যেভাবে গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে শেষ আর্তনাদটুকু অস্ফুটে বেরিয়ে এসেছিল বিমর্ষ পিতার মুখ দিয়ে। তার কোলেও ছিল হারানো শৈশব। বুক দিয়ে আগলে বাঁচিয়ে রাখা স্বপ্নের শেষচিন্হ।
তারপরেও মানুষ বাঁচে। বাঁচতে চায়। যে স্বপ্নে বক্সের বাইরে থেকে মাটি ঘেঁষা বাঁ–পায়ের শট অনায়াস জাদুবলে তেকাঠির জালে জড়িয়ে যায়। ফিরে যেতে চায় শৈশবে। যে শৈশব আটকা পড়েছিল নিউওয়েলস–ওল্ডবয়েজের বাথরুমে। দরজায় ক্রমাগত করাঘাত শোনেনি কেউ। অদম্য জেদের কাছে পরাজিত হয় ষড়যন্ত্র। বাথরুমের কাচ ভেঙে বেরনোর ২০মিনিটের মধ্যে হ্যাটট্রিক। অনবদ্য সেই দৌড় আটকাতে পারেনি কাঙ্খিত সাইকেল ছুঁয়ে দেখার আবেগ। যে দৌড় আগাম পূর্বাভাস দিয়েছিল মাথার উপরে স্বর্ণখচিত অদৃশ্য গোলক বলয়ের। তারপর পারানা আর বাসোস দিয়ে বহু জল প্রবাহিত হয়েছে। বাঁ–পায়ের মুনশিয়ানায় মুগ্ধ কাতালানীয় উপত্যকা। কিন্তু লিও ছুঁতে পারেনি আলবিসেলেস্তে ঈশ্বরকে। সে অতিকায় দৈত্যসম। বিশাল তার ছায়া। লিও মহাসাগরের ক্ষুদ্র এক বালুকণা। তবু সে সাগরকে ভালোবেসেছিল। দেওয়ার মতো ছিল না কিছুই। তাই তো এত অভিমান। ক্ষোভে–দুঃখে অবসর ঘোষণা পরাজিত এক যোদ্ধার। যে সিদ্ধান্ত নাড়িয়ে দিয়েছিল রোজারিও–বুয়েন্স আয়ার্স পেরিয়ে ১৬০০০ কিলোমিটার দূরে এক শহরের কিশোরকে। সেও তো এমনই অভিমানী, মুখচোরা।
টেস্ট পেপারের মধ্যিখানে চিঠি রেখেও কতবার ফিরিয়ে নিয়েছে সে। এগোতে পারেনি ভয়ে। যদি না বলে দেয়। কোচিং শেষে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়েও সভয়ে পিছিয়ে এসেছে। তবু সেদিনটা খুব মনে পড়ে। যখন দেখা হয়েছিল টেস্ট পরীক্ষার শেষে। ওই শেষবার দেখা। আঙুলে আঙুল রেখে প্রথমবার শিহরণ। বড় হয়ে যাওয়া একনিমেষে। চোখে এক অদ্ভুত মায়া মিশেছিল মেয়েটির। কেঁপে ওঠা ঠোঁটের অভিমান মিশে গেছিল ভেজা রুমালে। রুমালটুকুই রয়ে গেছিল। তারপর মাঠের পাশের দালানবাড়ি ছেড়ে ওরা অনেকদূর চলে গেছে। খোঁজ রাখেনি কেউ। মাঠটায় আজ প্রোমোটিং হচ্ছে। ছোটবেলার স্মৃতির বুক চিড়ে উঠে যাচ্ছে গগনচুম্বী ইমারত। শুধু রুমালটুকু আগলে রাখা সযত্নে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: অজস্র ট্রফি-সহ, জলসংকটের বার্সেলোনায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু রেখে গিয়েছিলেন মেসি
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
যেমন মেসি আগলেছিলেন। ন্যু–ক্যাম্পের প্রেস কনফারেন্স রুমে। বলতে পারছিলেন না কিছুই। শেষ সম্বল ওই রুমালটুকুই। যা কখনও অশ্রুস্নাত চোখ মুছিয়ে দেয়, কখনও হেলায় ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করায়। কাতালানীয় সভ্যতার অবসানকালে মনে পড়ছিল রঙিন দিনগুলো। মনে পড়ছিল চৈত্রমেলায় কেনা পোস্টার, ক্লাবঘরের তর্ক, রাত জাগা এল–ক্লাসিকো, জাভি–ইনিয়েস্তা–মেসির বার্সা। সময়ঘড়ি বয়ে যায়। স্মৃতিটুকুই বেঁচে থাকে। তারপর একদিন সবাই বড় হয়ে যায়। বসের সুমধুর সংলাপ হাসিমুখে হজম করতে শেখে। চেনা শহর ছেড়ে বাইরে কাটে রাতগুলো। মায়ের হাতে মাখা গরম আলুসেদ্ধ আর মুসুর ডালের গন্ধ হারিয়ে যায় সময়ের বিলাসিতায়। কান্না আর আসে না বড় একটা। ছেলেটা বদলে গেছে। বদলেছে শহর। দেশটা বদলাচ্ছে ক্রমাগত। বহু বেকার রাস্তায় রাত জাগছে। কৃষকরা ঋণের বোঝা বইতে না পেরে আত্মহত্যা করছে। বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ভারত ক্রমশ নিম্নগামী। ক্রমাগত বেড়ে চলেছে বিদ্বেষ। হিংসা–হানাহানির বিষবাষ্প গিলে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের জার্সি গায়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের খেলোয়াড়কে দেখলে গ্যালারি থেকে ভেসে আসে ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি। পাকিস্তানের কোনও বোলিং পারফরমেন্সের প্রশংসা করলে ধেয়ে আসে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা। কিন্তু ১০ নম্বর জার্সির মায়া আদি ও অকৃত্রিম। মেসি নীল–সাদা গায়ে মাঠে নামলে আমার শহরে আজও উৎসব নেমে আসে। কোথায় সে পৃথিবীর অন্য কোনও প্রান্তের এক দেশ। কাঁটাতারের অদৃশ্য বেড়াজাল টপকে সে আমাদের ঘরের ছেলে। বিশ্বকাপ শুরু হলে ময়দান মার্কেটে ঢালাও বিকোয় ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার জার্সি ও পতাকা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: শুধু গোল নয়, সমর্থকদেরও বাঁচান এমিলিয়ানো
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ফুটবল এক অদ্ভুত মায়া। যেখানে অবিশ্বাসের গন্ধ নেই। হিংসার আগুন নেই। শুধু আছে সব নিঃস্ব যুবকের একবুক আগলে রাখা জ্বলন্ত আবেগ। যে আগুন পোড়ায় না মানুষকে। কখনও কাঁদায়, কখনও হাসায়। এক ফ্রেমে মিশিয়ে দেয় রেলস্টেশনে রাত কাটানো দেশ আর মার্সিডিজে বাড়ি ফেরা দেশকে। বাঁ–পায়ের তুলির অদ্ভুত টানে সবুজ গালিচা চিড়ে রচিত হয় অবিনশ্বর শিল্পকলা। নিদারুণ মুগ্ধতায় বিস্ময় জাগায় হৃদয়ে। তাই তো বোধহয় প্যালেস্তাইনে বোমারু হানায় ক্ষত–বিক্ষত পরিবারের যুবকটিও আলবিসেলেস্তে গায়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। হতভাগ্য শরণার্থী দেশ ছাড়ার আগে প্ৰিয় জার্সি সঙ্গে নিতে ভোলে না। দেশ জিতলে মানুষ পেটের খিদে ভুলে রাস্তায় নামে। জীবনযুদ্ধে বল পায়ে জাগলিং করে পরিবারের পেট চালানো যুবক আরেকটু অক্সিজেন খুঁজে পায়। এরা প্রত্যেকে জানে, ফুটবল তাঁদের শত–সহস্র সমস্যা জর্জরিত জীবনে সমাধান বয়ে আনবে না। তবু বেঁচে থাকতে মানুষ ঈশ্বর খোঁজে। যে ঈশ্বর খাদের কিনারে দাঁড়ানো দলকে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখায়। কোনও এক ডিসেম্বরের শীতে খানিক জমাট বাঁধে আড্ডা। আরও কিছুক্ষণ পাড়ার মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে লোক বাড়বে। ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুকের শব্দ। মাথার উপর সারি দিয়ে বাড়ছে পোকার উৎপাত। রিকশা স্ট্যান্ডের ভজাকাকু খানিক আগেই গাড়ি গ্যারেজ করেছে মাঠের পাশে। ছিয়াশির পরে আবার একটা রাত। কুয়াশা নামছে শহরে। বাড়ছে ১০ নম্বর জার্সির মায়া। সাইডলাইনে দৃঢ় কিন্তু ধীর স্ক্যালোনি। আলবিসেলেস্তে গায়ে খেলছে ১১ জন। আসলে খেলছে গোটা পাড়াটা। বা অলিতেগলিতে হাজারও মেসি। যাদের পথ চলা কোনও দিনই সহজ ছিল না। কনস্ট্রাকশনে ইট বওয়া ছোট্ট মেয়েটা কিংবা ট্রাফিক সিগন্যালের জ্যামে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষটিও প্রতিদিন যুদ্ধ করে। যাদের লড়াইটা আরও কঠিন। কিন্তু প্রত্যেকেই তারা জীবনের ময়দানে যুদ্ধটা জারি রাখছে। মাঠে ওই টিকে থাকাটাই আসল। যে টিকে থাকার লড়াইটা প্রতিদিন লড়ে যাচ্ছে কাকদ্বীপ থেকে কিউবার মেহনতি মানুষ। কারখানার মজদুরের ঘাম মিশে যাচ্ছে সোনার ফসলে। তারা প্রত্যেকেই এমন হারতে হারতেও উঠে দাঁড়ায়।
যেমনটা মেসি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। ফ্রান্সের ওই পৈশাচিক উচ্ছাসের সময় যে একাকী মেসিকে খানিক অদ্ভুত ও ঐশ্বরিক মনে হয়। মোজা ঠিক করতে করতে এক রহস্যময় হাসি। খানিক নিঃসঙ্গতা। শত–সহস্র জনঅরণ্যের ভিড়েও কী একা সে। কিন্তু দেওয়ালে স্বেদবিন্দু মিশে গেলে মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোতেই আস্থা রাখে। তাই উঠে দাঁড়ালেন লিও। উঠে দাঁড়ালাম আমরা সবাই। তারপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভাগ্যদেবতা জীবনের লাস্টসিনে সবটুকু হিসেবে ফিরিয়ে দেন। নেপথ্যে শোনা যায়, ‘আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়নস্ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, এগেইন, অ্যাটলাস্ট অ্যান্ড এ নেশন উইল ট্যাংগো অল নাইট লং’। পিলপিল করে বেরিয়ে আসা আবেগের স্রোত ছড়িয়ে পড়ল শহর পেরিয়ে সেই সুদূর দিকশূন্যপুরের অলিগলিতে। যেখানে সন্ধ্যা নামলে তুলসী তলায় জ্বলে ওঠে প্রদীপ। ভুসভুস করা গ্যাসবাতির গন্ধ ছুঁয়ে যায় সেই কোন ছোটবেলার স্মৃতি। বাবা বলত, ছিয়াশির অপ্রতিরোদ্ধ মারাদোনার গল্প। যে যুবক প্রতিনিধিত্ব করছিল ফকল্যান্ডের যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের। যে দেশ বিপ্লবের সাক্ষী। কতদূরের কিন্তু কত আপন। মাঠ জুড়ে ঘুরে বেড়ানো ওই ঝাঁকড়া চুলের দামাল ছেলেটা। বাবা খুব মিস করছিল ওকে। মাঠের ধারে কিংবা কোনও এক ভিআইপি বক্সে তো সেদিন তার থাকার কথা ছিল। ৩৬ বছরের খরা কেটেছে। লিও বৃত্ত সম্পূর্ণ করেছেন। বেঁচে রইল আর্জেন্টিনা। অমর হলেন মেসি। বছর পেরিয়ে শুধু কানে বাজছে পিটার ড্রুরির সেই অমোঘ উক্তি– ‘লিওনেল মেসি হ্যাজ কনকোয়ারড হিজ ফাইনাল পিক। লিওনেল মেসি হ্যাজ শেকেন হ্যান্ডস উইথ প্যারাডাইজ। দ্য লিটল বয় ফ্রম রোজারিও সেন্টা–ফে হ্যাজ জাস্ট পিচড আপ ইন হেভেন।’