ভরদুপুরে কলেজের গেটের বাইরে, থামের গায়ে হেলান দিয়ে, সুখটান দিচ্ছি। কেউ একজন কাউন্টার দিয়ে গেছে, অর্থাৎ মেরে-কেটে দু’-তিন টান হবে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রফেসর আসছেন, যিনি আমার বাড়ির সবাইকে চেনেন। ভয়ে হাতের তালুতে ট্যাপ করি ওই কাউন্টার। দীর্ঘদিন গোটানো চামড়া গুরুজনদের মতো ভ্রূ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। অথবা, এক বিকেলে বিডন স্ট্রিট থেকে হরি ঘোষ স্ট্রিটের দিকে যাব বলে মোড় ঘুরতেই দেখি বাবা। আমায় দেখতে পাননি বোধহয়। এদিকে আমার একগাল ধোঁয়া। ছাড়ব কী করে?
২১.
বাবা নাকি এককালে সিগারেট খেতেন। ছেড়ে দিয়েছিলেন এক অদ্ভুত কারণে। একবার, আমার দাদার ‘তুমি সিগারেট খাও?’ এই প্রশ্নের উত্তরে, উনি ‘না’ বলেন। দাদা তখন নাবালক। এই যে মিথ্যে বলে ফেললেন বাবা, সেটিকে সত্য প্রমাণ করতে তিনি আর জীবনে সিগারেট খেলেন না। সেই চাপে পড়েই হয়তো দাদার-ও আর ফোঁকা হল না। আমাকেও শিশুকাল থেকে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে সিগারেট সেঁকো বিষ। ওই ধোঁয়া একবার গিললে সে তোমাকেই গিলে নেবে একদিন। ওদিকে গুরুজনেরা, মা-মাসি নির্বিশেষে, স্টুডিওতে তোলা আমার ছোটমামার একটি ফোটো দেখে আহাবাহা করছেন। তাঁকে প্রমথেশ বড়ুয়ার মতো দেখতে লাগছে নাকি কে. এল. সায়গল– এই নিয়ে তর্ক! ছোটমামার সেই ফোটোতে ঠোঁটের কোণে একটি প্রজ্বলিত সাদা কাঠি ছিল, সঙ্গে তার ধোঁয়াও, আঁকাবাঁকা নদীর মতো। যতদূর মনে পড়ে প্যাল ম্যাল অথবা ক্যামেল ব্র্যান্ডের সিগারেট। আমি সেই ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে ভাবতাম কবে যে বড় হব আর এই কেতা দেখাতে পারব!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমাদের কৈশোর-যৌবনে শুধু সিগারেট ধরালেই চলত না, রাস্তাঘাটে আগুন এবং ধোঁয়া লুকনোর স্কিলও রপ্ত করতে হত। এখনকার জেনারেশন অতটা চাপ নেয় বলে মনে হয় না। আমরা জানতাম সিগারেট টানা পাপ। কিন্তু তার থেকেও বড় পাপ বয়ঃজ্যেষ্ঠদের নাকের ডগায় ধোঁয়া ছাড়া বা তাদের চোখে পড়ে যাওয়া সাদা কাঠির ডগায় লাল আলো। নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়া অথবা গাল তুবড়ে ঠোঁট ফাঁক করে রিং বানানোর চেয়ে কম কঠিন নয় সেই আগুন-ধোঁয়া লুকনোর স্কিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর এক দুপুরে সুযোগ এল। বাড়িতে কেউ নেই। প্রফেসর দত্ত নিজের অজান্তেই আমায় সিগারেটে অভিষিক্ত করলেন। উঠোন লাগোয়া একটি ঘরে উনি কেমিস্ট্রির প্রাইভেট টিউশন দিতেন। দেদার সিগারেট খেতেন, ‘চেইন স্মোকার’ বলা যেতে পারে। সে সিগারেট অবিশ্যি একটু অন্যরকম। সুদৃশ্য প্লাস্টিকের মোড়কে তামাক। হ্যান্ড রোল করে নিজের ধোঁয়ার ব্যবস্থা নিজেই করে নাও। কখনও ছাত্র-ছাত্রীদের সাডেন টেস্টের চাপে ফেলে দিয়ে উঠোনে পায়চারি করতেন নিজের মনে, এক অনন্য স্টাইলে সিগারেট টানতে টানতে। যেন উত্তমকুমার বা গ্রেগরি পেক উড়ে এসেছেন আমার উঠোনে। ভাবলাম, এক্সপেরিমেন্ট করি। টিউশনির ফাঁকা ঘরে ঢুকে ফেলে দেওয়া প্যাকেটগুলো থেকে অল্প কিছু তামাক জোগাড় করা গেল। ‘উইলস’ ও ‘ক্যাপ্সটান’ বোধহয় ওই প্রথম হাতে হাত মেলালো। কিন্তু রোল করব কীসে? কেন, বঙ্গলিপি খাতার পাতা আছে তো! ঘটনা হল, পাবলিক সিগারেট খায় বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়ার জন্য। কিন্তু বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে তামাকের চেয়ে অনেক বেশি ধোঁয়া জন্ম নেয় বঙ্গলিপির সাদা পাতা পুড়লে। আক্ষরিক অর্থে যে কিক পেয়েছিলাম সেই দুপুরে, লায়েক হওয়ার পর, প্রায় দু’দশকের সিগারেট জীবনে তা পাইনি। মাথা ঘুরল, চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম দালানে, হাপরের মতো বুক ওঠানামা করল কতক্ষণ কে জানে! একটু অক্সিজেনের জন্যও যে প্রার্থনা করতে হয় সেটা বোধগম্য হল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: একশো লেখক একশো বছর ধরে লিখলেও উত্তর কলকাতার গলির গল্প লেখা শেষ হবে না: মতি নন্দী
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমাদের কৈশোর-যৌবনে শুধু সিগারেট ধরালেই চলত না, রাস্তাঘাটে আগুন এবং ধোঁয়া লুকোনোর স্কিলও রপ্ত করতে হত। এখনকার জেনারেশন অতটা চাপ নেয় বলে মনে হয় না। আমরা জানতাম সিগারেট টানা পাপ। কিন্তু তার থেকেও বড় পাপ বয়ঃজ্যেষ্ঠদের নাকের ডগায় ধোঁয়া ছাড়া বা তাদের চোখে পড়ে যাওয়া সাদা কাঠির ডগায় লাল আলো। নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়া অথবা গাল তুবড়ে ঠোঁট ফাঁক করে রিং বানানোর চেয়ে কম কঠিন নয় সেই আগুন-ধোঁয়া লুকোনোর স্কিল। ভরদুপুরে কলেজের গেটের বাইরে, থামের গায়ে হেলান দিয়ে, সুখটান দিচ্ছি। কেউ একজন কাউন্টার দিয়ে গেছে, অর্থাৎ মেরে-কেটে দু-তিন টান হবে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রফেসর আসছেন, যিনি আমার বাড়ির সবাইকে চেনেন। ভয়ে হাতের তালুতে ট্যাপ করি ওই কাউন্টার। দীর্ঘদিন গোটানো চামড়া গুরুজনদের মতো ভ্রূ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। অথবা, এক বিকেলে বিডন স্ট্রিট থেকে হরি ঘোষ স্ট্রিটের দিকে যাব বলে মোড় ঘুরতেই দেখি বাবা। আমায় দেখতে পাননি বোধহয়। এদিকে আমার একগাল ধোঁয়া। ছাড়ব কী করে? বিদ্যুৎগতিতে সিগারেট ফেলে উল্টোমুখো হই। এবার বাবা আমার পিছনে। কিন্তু পিছন থেকেও তো উনি নিজের ছেলেকে চিনে নিতে পারবেন নিশ্চয়ই! সেই ভয়ে দ্রুত পা ফেলি। একটু এগিয়ে, একটা গলতা পেয়ে সেঁধিয়ে যাই আর ভুস করে দম ছাড়ি। ফুটপাথের ধারে, তেলেভাজার দোকানে, সদ্য ধরানো উনুনের ধোঁয়ার দলে ভিড়ে আমার কৈশোর ঊরধ্মুখী হয়। সাহস করে মুখ বাড়িয়ে দেখি বাবা এগিয়ে গেছেন। নিজের উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে নিজেরই পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করে কিন্তু ওই না খাওয়া সিগারেটের জন্য হাহুতাশ কাটে না দীর্ঘদিন। কারণ, ওই সিগারেটে একটি নির্দিষ্ট সময়ের অঙ্গীকার লেখা ছিল। টানতে টানতে আমায় তার নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল একটা এঁদো গলির মুখে। যেখানে ছাইয়ে চাপা অন্য কোনও আগুন অপেক্ষায়, স্রেফ অপেক্ষায়, নিভে গেল।
…পাল্টি-র অন্যান্য পর্ব…
পাল্টি পর্ব ২০: যে কারণে বুলাদির মর্তে আগমন
পাল্টি পর্ব ১৯: আরে নামের সামনেই পেছন নিয়ে ঘুরছিস?
পাল্টি পর্ব ১৮: ‘আসল হিজড়ে’ কথাটা সোজা মাথায় আঘাত করে
পাল্টি পর্ব ১৭: গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে কোথায় চলেছেন অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভার?
পাল্টি পর্ব ১৬: কো-এড কলেজে পড়তে এসে বুঝি পিরিয়ড খুব একটা সুখের ক্লাস নয়
পাল্টি পর্ব ১৫: পচা ইলিশ ঝোলানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত পাড়ার মেজরিটি পাবলিক
পাল্টি পর্ব ১৪: গুরু তুমি তো ফার্স্ট বেঞ্চ
পাল্টি পর্ব ১৩: আমের সিজন ফুরিয়ে গেলে ল্যাংড়া তার আসল অর্থ খুঁজে পায়
পাল্টি পর্ব ১২: টিবি হয়েছে বলে আড়ালে বন্ধুটির নাম দেওয়া হয় ‘কিশোর কবি’
পাল্টি পর্ব ১১: ডোমেরা জানে, আগুনের তর সয় না
পাল্টি পর্ব ১০: আমেরিকায় খুন হওয়ার থেকে স্বদেশি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ভাল
পাল্টি পর্ব ৯: মানুষ হয়ে জন্মেছি, ব্যাং কী করে জন্মায়, তা জেনে কী হবে?
পাল্টি পর্ব ৮: খোকাবাবু, ম্যাডাম স্যুইটে আছেন, এক ঘণ্টায় ৪০০ দেবেন বলছেন
পাল্টি পর্ব ৭: ও তো সন্ধে থেকেই গিরিশ ঘোষ
পাল্টি পর্ব ৬: যে দোকানের বেবিফুডে বেড়ে উঠলাম, সেখান থেকেই বীরদর্পে কন্ডোম কিনেছি
পাল্টি পর্ব ৫: প্রায়শ্চিত্ত রোল অ্যান্ড কর্নার
পাল্টি পর্ব ৪: দু’অক্ষর কথা, চার-অক্ষর কথা
পাল্টি পর্ব ৩: ‘টুকলি’ ঈশ্বরের দয়ার শরীর
পাল্টি পর্ব ২: পাগলি তোমার সঙ্গে
পাল্টি পর্ব ১: প্যান্টি যেন বদ্বীপ, লাজুকলতা নরম কাপড় জুড়ে যাবতীয় গোপনীয়তা