মানিক ছায়ামূর্তি দেখা গিয়েছে শুনে সবার সে কী উত্তেজনা! মানিককে চেপে ধরল সকলে– ‘বল হারামজাদা কী দেখেছিলি।’ ঠাকুমা বদ্ধ কালা বলে গল্পটা তিনবার বলতে হল। তার ফলে ঘোমটা দেওয়া মহিলা, নাকি ধুতির খুঁট জড়ানো মামদো– এই নিয়ে ছোড়দা আর পাশের বাড়ির শম্ভুর মধ্যে হাতাহাতি বেঁধে গেল প্রথমেই। লিখছেন অমিতাভ মালাকার।
১.
বাঙালি মধ্যবিত্ত ছানাপোনাদের ভূতের ভয় না দেখিয়ে বড় করার নিয়ম নেই। দুলালের তালমিছরি, রবিবারের মাংস ভাত, এবং উত্তম-সুচিত্রার মতোই ভূতের ভয় বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। আমাদের ছেলেবেলায় মানিক প্রথম ভূত দেখেছিল। রেল কলোনির ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলার শেষে মারামারির পাট চুকলে ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফেরার পথে হুবহু রামদয়াল গোয়ালার মতো বড় বড় দাঁতঅলা এক মহিলা সাদা কাপড় জড়িয়ে ঝুপ্পুস অন্ধকারে পেল্লাই জাম গাছটার আড়ালে স্যাট করে মিলিয়ে যেতে, ও আর দাঁড়ায়নি। এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে দোর খুলে তিন লাফে দোতলার বৈঠকখানায় সান্ধ্যকালীন আড্ডায় সকলের মাঝখানে শুয়ে সোজা অজ্ঞান। তারপর ‘এই জল আন, বাতাস কর, সুকতলা শোঁকা’ ইত্যাদি মহা হইচই-হট্টগোল। ছোটমামু ব্রায়োনিয়া থার্টি না কী একটা বলায় সেজকাকিমা তার কান মুলে ‘এই জন্যই তিনবারেও গ্র্যাজুয়েট হতে অপারগ’ না কীসব বলেছিল– কানমলা খাওয়া নিয়ে বিশেষ গোলমাল হয়নি, তবে সত্যি সত্যি কেউ ‘অপারগ’ শব্দটা ব্যবহার করে গোটা একটা বাক্য বলেছে, এই নিয়ে বেশ কিছুদিন ওদের বাড়ি সরগরম হয়েছিল। তবে সে অন্য গল্প। বড়পিসে জিলিপি, শিঙাড়া, আর ঘোষেদের দোকানের বড় বড় রাজভোগ নিয়ে না ফিরলে মানিকের তৎক্ষণাৎ ভিরমি কাটত কি না সন্দেহ!
তারপর ছায়ামূর্তি দেখা গিয়েছে শুনে সবার সে কী ভয়ানক উত্তেজনা! একে একে মানিককে চেপে ধরল সকলে– ‘বল হারামজাদা কী দেখেছিলি।’ প্রথমত, ঠাকুমা বদ্ধ কালা বলে গল্পটা তিনবার বলতে হল। তার ফলে উল্টোপাল্টা মন্তব্য এবং অনাবশ্যক কিছু এলিমেন্ট ঢুকে পড়ায় শেষ পর্যন্ত ওটা আর মানিকের গল্প ছিল বলাটা মুশকিল। ঘোমটা দেওয়া মহিলা, না কি ধুতির খুঁট জড়ানো মামদো– এই নিয়ে ছোড়দা আর পাশের বাড়ির শম্ভুর মধ্যে হাতাহাতি বেঁধে গেল প্রথমেই। জাম গাছের মাথায় একফালি চাঁদ দেখা গিয়েছিল কি না, তাও ঠিক মনে না পড়ায় মানিক ‘ইয়ে, মানে, খুব অন্ধকারে ঠাওর হয়নি, তবে গিয়ে থাকতেও পারে’ ইত্যাদি বিড়বিড় করে পাশ কাটাতে চাইলেও, জেঠামশাই অমন জোর দিয়ে ‘থাকতেই হবে, থাকতেই হবে’ এবং ‘রাতে তাহলে মাংস ভাতই হোক’ বলায় সকলেই চাঁদের অস্তিত্ব মেনে নেয়। সবাই সেদিন সন্ধেয় তো বটেই, পরবর্তী বছরখানেক একটানা মানিক ঠিক কী কী দেখেছিল, তা আলোচনার মাধ্যমে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেয়, এবং তারপর থেকে ও-বাড়ির ছোটপিসিই গল্পটা বিয়ে-অন্নপ্রাশন ইত্যাদি সমস্ত অনুষ্ঠানে বলে এসেছে। সাদা শাড়ি কখনও লাল অথবা কালো-পেড়ে হয়েছে, কখনও জিন্স টি-শার্ট। ছায়ামূর্তি কখনও নিমেষে হাওয়ায় মিলিয়েছে, কখনও মানিককে খোনা গলায় ‘আঁয় আঁয়’ বলে কাছে ডেকেছে। রেশন দোকানের বিমল একবার ‘কেবল বাজে তর্ক’ ইত্যাদি ধমক-সহ চটি-পেটা খাওয়ার পর থেকে সেসব নিয়ে কেউ ছোটপিসিকে অনাবশ্যক প্রশ্ন করত না। ছোটপিসির অবর্তমানে সকলেই সুযোগ মতো নিজের ভার্সনটি গুছিয়ে বলত, এবং আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সবক’টা গল্প আগাগোড়া বিশ্বাস তো করতামই, এক কুচি ডিটেইল বাদ দিলে হাঁ হাঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভুল ধরিয়ে দিয়ে ফের চোখ গোল গোল করে সে গায়ে কাঁটা-দেওয়া বর্ণনা শুনতাম নিবিষ্ট হয়ে। একমাত্র ওদের এক ডাক্তার মেসো একবার কী একটা বলার চেষ্টা করলে সকলে তাঁকে ‘থাক থাক, তুমি বরং কাপড়গুলো ধোপাবাড়িতে দিয়ে এসো’ বলে থামিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে তিনি আর ও-বাড়ি আসেন না। সেখানে নাকি জামাইদের আদর নেই। সে অবশ্য বাজে কথা। ও-বাড়ির জামাইদের দিয়ে কয়লা ভাঙানো, ঘুঁটে দেওয়ানো থেকে সারা দুপুর কোদাল চালিয়ে ব্যাডমিন্টনের কোর্টও কাটানো হয়েছে– আদর ছিল না-র মতো অবাস্তব কথা কেউ বলেনি কখনও।
প্রশ্ন সেটা নয়। একটা ক্লাস এইটের পাঞ্জাবি বাচ্চাকে সন্ধের পর শ্মশানের ধারে টেনে নিয়ে বলুন ‘কন্ধকাটা আয়গা’– ফ্যাল ফ্যাল করে সে চেয়ে থাকবে। পুরোটা বুঝিয়ে বলুন, ছলো ছলো চোখে ওর প্রাথমিক হৃদয় নিংড়ানো প্রশ্ন, ‘ফির দারু কেইসে পিয়েগা?’ ‘চেতনা চৈতন্য করে দাও মা’ বলে এরপর কোনও লাভ আছে? ভূতের ভয়টাকে এরা কখনও বাঙালির মতো আর্টের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে? আমাদের প্রতিটি পরিবারেই একাধিক সদস্য এই ভয়টিকে লালন করে, যাতে পরের প্রজন্ম মাঝে মাঝেই আঁতকে উঠতে পারে। রাতের অন্ধকারে মৃত অঙ্কের মাস্টার বেত হাতে বারান্দা দিয়ে চটি ফটাস ফটাস করে হেঁটে যাবে, শীতের কুয়াশা ভেদ করে ছায়ামূর্তিরা এক পা আলসেয় আর এক পা চিলেকোঠায় তুলে ঘাড় মটকাতে আসবে, তবেই না বাঙালি শিশুর কুসুমকোমল হৃদয় বিকশিত হবে। আর্লি চিত্রকল্পগুলো বুড়োবুড়িদের কল্পনাপ্রসূত। দুপুরে চিলেকোঠায় উঠলে হঠাৎ ঘাড়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাওয়া (ছেলেপিলেদের কথা হচ্ছে, বুড়োদের নয়), সন্ধের মুখে খেলার মাঠ থেকে, এমনকী, সদলবলে ঘোষেদের আমবাগান পেরনোর সময়েও হইহুল্লোড় থামিয়ে চাপা গলায় কথা বলা, রাতে একা উঠোন পেরিয়ে বাথরুমে যাওয়ার সময় যাদের সঙ্গে অষ্টপ্রহর সবচেয়ে বেশি ঝগড়া-মারামারি, তাদেরই ‘একটু দাঁড়াবি ভাই’ বলে কাকুতি-মিনতি শৈশব-কৈশোরের স্বাভাবিক অঙ্গ। যাদের তেমনটা নয়, খোঁজ নিয়ে দেখুন, তাদের রক্তে পঞ্চনদীর কিছু একটা মিশেল আছেই, এবং সেটা রবিবাবুর কাব্যনিঃসৃত সুধা-ফুধা নয়, আবগারি দপ্তরের ছাপ আছে তাতে বিলকুল।