সেলের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলেন শঙ্কর। এখন শুয়ে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। পুরনো কত কথা মনে হচ্ছে। খাবারটা এসে ঠান্ডা হচ্ছে। ভাত আর সবজির ঝোল, এক টুকরো মাছভাজা। সেদিকে মন নেই তাঁর। তবে খাওয়ার সময় ধরে বিড়ালটা এসেছে। কাঁটা খায়। মূলত তার ডাক সামলাতেই শঙ্কর খেয়ে নিলেন। থালা বাটি ধুয়ে সাফ করে বাইরে একটু পায়চারি সেরে আবার সেলে ঢুকলেন। এবার একটু শোয়া।
২৫.
ঘণ্টা চারেকের তফাত।
শঙ্কর বারিক দুটি খবর পেলেন। হুগলি জেলে বসে। তিনি সেলের বাসিন্দা। তাঁর পাশের সেলটাই সংরক্ষিত, কাজী নজরুল ইসলামের জন্য। বিদ্রোহী কবি। এই জেলে, এই সেলে ছিলেন একসময়। আজ সেলের মধ্যে তাঁর মূর্তি বসানো। বাইরে ইতিহাস লেখা। পরের সেলগুলিতে বন্দিরা থাকেন। লাগোয়া সেলটিতে শঙ্কর বারিক।
মাওবাদীদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা জেলে রাখা হয়। শঙ্কর এখন এখানে এসে পড়েছেন।
ছায়ার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, শুধু এই একটি খবরেই মনে আনন্দের ঝড় উঠে গিয়েছিল শঙ্করের। চিন্তা ছিল, কোথায় কীভাবে আছেন ছায়া, বেঁচে আছেন কি না। ঘুম আসত না। চিন্তার কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হত মাথা। পুলিশের হাতে ধরা পড়া খুব খারাপ। কিন্তু এক্ষেত্রে উল্টো। সন্ধান মিলেছে, বেঁচে আছে, হয়তো আরও অনেক কষ্টে ছিল, তার বদলে জেলে থাকবে। থাকা, খাওয়া নিশ্চিত। হয়তো দু’জনের আবার দেখা হবে। হয়তো দু’জনে একদিন মুক্তি পেয়ে আবার ঘর বাঁধবেন। শঙ্কর নিশ্চিত, বড় মামলাটিতে তিনি শেষ পর্যন্ত উপরের কোর্ট থেকে খালাস পাবেন। অন্য মামলাটাও দাঁড়াবে না। শুধু বন্দিদশার হয়রানি চলবে। আর ছায়ার বিরুদ্ধে তো বড় কোনও মামলার প্রশ্নই ছিল না। পরে কী হয়েছে, তা অবশ্য জানা নেই। তবু, শঙ্করের মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। খবরটা দিয়ে গিয়েছিল এক সেপাই। টিভিতে দেখে এসেছে। শঙ্করের মনে একটা ছটফটানি কাজ করছে। ছায়াকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। মনে পড়ে যাচ্ছে পুরনো কথা, প্রথম প্রথম আলাপ। শঙ্কর জঙ্গলমহলে গিয়েছেন, থাকছেন। ছায়ার সঙ্গে পরিচয়। আস্তে আস্তে সব কাজে ছায়া। ছায়াও যেন আগলে রাখতেন শঙ্করকে। দু’জনে যখন ঠিক করলেন বিয়েটা করবেন, ছায়ার পরিবার থেকে যেমন আপত্তি ছিল, শঙ্করদের দু’-একজন কমরেডও আপত্তি করেন। এই ঘরছাড়া বিপ্লবী জীবনে বিয়ে! কিন্তু উৎসাহ দেওয়ারও লোক কম ছিল না। একদম গ্রামের মধ্যে ঘরোয়া পরিবেশে মালাবদল করে বিয়ে হয়ে গেল। ছায়া কিন্তু শঙ্করের পিছুটান হলেন না। ছায়া আরও বেশি করে কাজের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠলেন। কিছুটা বাইরে থেকে শান্ত, কিন্তু ভেতরে আগুন। জঙ্গলের নানা অভিযানে শঙ্করদের ‘কভার’ করে রাখতেন ছায়া এবং তাঁর টিম। আলাদা হওয়ার শেষ অভিযান, তুমুল গুলি, বোমার মধ্যে আলাদা হয়ে যাওয়ার মুহূর্তটা মনে পড়লে আজও শঙ্করের বুকের মধ্যে ব্যথার মোচড় ওঠে। ছায়া যেতে চাননি। শঙ্কর বলেছিলেন, ‘আমরা ওদের ঠেকিয়ে রাখছি। তুমি মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে যাও। এটা তোমার দায়িত্ব কমরেড।’ ছায়া মেনেছিলেন, একবার জড়িয়ে ধরেছিলেন শঙ্করের হাত। শঙ্কর ছায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘যাও। আবার দেখা হবে।’
সেই শেষ। আর দেখা হয়নি। এখন ছায়ার গ্রেপ্তারের কথা শুনে শঙ্কর ভাবলেন দেখা এতদিনে হবে। আলাদা জেলে থাকলেও কোর্টকে আবেদন করলে তাঁরা অনুমতি দেন। এরকম বহু উদাহরণ আছে। কোনো মাওবাদী স্বামী-স্ত্রী ধরা পড়েছেন আগেও। কোর্ট সপ্তাহে বা মাসে একবার দেখা করার অনুমতি দেন। একজনকে পুলিশ পাহারায় আরেকজনের জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ছায়ার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, শুধু এই একটি খবরেই মনে আনন্দের ঝড় উঠে গিয়েছিল শঙ্করের। চিন্তা ছিল, কোথায় কীভাবে আছেন ছায়া, বেঁচে আছেন কি না। ঘুম আসত না। চিন্তার কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হত মাথা। পুলিশের হাতে ধরা পড়া খুব খারাপ। কিন্তু এক্ষেত্রে উল্টো। সন্ধান মিলেছে, বেঁচে আছে, হয়তো আরও অনেক কষ্টে ছিল, তার বদলে জেলে থাকবে। থাকা, খাওয়া নিশ্চিত। হয়তো দু’জনের আবার দেখা হবে। হয়তো দু’জনে একদিন মুক্তি পেয়ে আবার ঘর বাঁধবেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শঙ্কর চঞ্চল হয়ে উঠলেন। এরপর জানতে হবে ছায়াকে কোথায় রাখছে, কী মামলা দিচ্ছে। জানা যাবে। পরের তারিখে কোর্টে গেলে অনেকের সঙ্গে দেখা হবে; কিংবা জেল অফিসারদের বললে তারা খবর জোগাড় করে দেবেন; তাছাড়া খবরের কাগজগুলোতেও নজর রাখতে হবে, যদি কিছু লেখে।
সেলের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলেন শঙ্কর। এখন শুয়ে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। পুরনো কত কথা মনে হচ্ছে। খাবারটা এসে ঠান্ডা হচ্ছে। ভাত আর সব্জির ঝোল, এক টুকরো মাছভাজা। সেদিকে মন নেই তাঁর। তবে খাওয়ার সময় ধরে বিড়ালটা এসেছে। কাঁটা খায়। মূলত তার ডাক সামলাতেই শঙ্কর খেয়ে নিলেন। থালা বাটি ধুয়ে সাফ করে বাইরে একটু পায়চারি সেরে আবার সেলে ঢুকলেন। এবার একটু শোয়া।
কখন চোখ লেগে গিয়েছিল শঙ্করের।
ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। বিকেল প্রায় যায় যায়। জেলার এসেছেন।
শঙ্কর বললেন, ‘কী ব্যাপার জেলারবাবু?’
‘আসলে একটা খবর নিয়ে আসা। আপনার স্ত্রী…’
শঙ্কর হেসে বললেন, ‘শুনেছি, ছায়া ধরা পড়েছে। আমিই আপনার কাছে যেতাম। একটু খোঁজ নিয়ে রাখবেন ঠিক কোথায় ওকে রাখা হচ্ছে?’
জেলার চরম অস্বস্তিতে। বললেন, ‘শঙ্করবাবু, আমার বলতে খারাপ লাগছে, ছায়া দেবী ধরা পড়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কাস্টডিতেই উনি আজ মারা গিয়েছেন। খবরটা আপনাকে জানাতেই আমার আসা।’
শঙ্কর বিহ্বল চোখে তাকিয়ে। মুখে শব্দ নেই।
জেলার বললেন, ‘আমি যেটুকু শুনেছি ওঁর পরিচিত কোনও মহিলা এসেছিলেন থানায় দেখা করতে। মহিলা খাবারে বিষ মিশিয়ে দেন। ছায়াদেবী হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই মারা যান। পুলিশ ওই মহিলাকে খুঁজছে।’
শঙ্কর পাথরের মতো দাঁড়িয়ে।
জেলার বললেন, ‘ছায়াদেবীর বডি পোস্টমর্টেমে গিয়েছে। কাল শেষকৃত্য। আপনাকে নিয়ে যাওয়ার অর্ডার হয়েছে।’
শঙ্করের চোখ জলে ভরছে। ঠোঁট কাঁপছে। বললেন, ‘চলেই যদি যাবে, ধরা দিল কেন?’
তিনি আস্তে আস্তে সেলের মধ্যে ঢুকে গেলেন।
জেলার যাওয়ার আগে ওয়ার্ডের সেপাইকে বলে গেলেন, ‘উনি মেন্টালি ঠিক নেই। নজর রেখো। কিছু করে না বসেন।’
( চলবে)
…পড়ুন কুসুমডিহার কাব্য-এর অন্যান্য পর্ব…
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৪: মলিন চেহারার এই মহিলাকে ধরতে এত পুলিশ?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৩: শঙ্কর বারিকের স্ত্রী ছায়া মাহাতো ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২২: গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাওবাদীরা, কুসুমডিহায় মনোবল বাড়ছে মানুষের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২১: কুসুমডিহা এক বুক আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২০: মানুষকে একজোট করতে চায় রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৯: দূত এবং দূতের দূত মারফত খবর গিয়েছে কুসুমডিহায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৮: টিলার ওপরের মহিলাদের নিয়ে পুলিশের কৌতূহল প্রবল
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৭: পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১০: শান্ত কুসুমডিহা এখন হিংস্র হয়ে ফুঁসছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৬: পরিচয় যত বাড়ছে, সুমিত অনুভব করছে এলাকা গরম হচ্ছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৫: পশ্চিমগড়ের মৃতদেহর খবর এখনও কলকাতা সংস্করণে জায়গা পায়নি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৪: সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৩: ‘বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি’
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২: সিস্টেমের দোষেই কুসমডিহাতে ফের অমঙ্গলের পদধ্বনি, সুমিতকে বোঝাল রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!