ররিকে দু’বার বলতে হয় না। সে তিড়িং করে লাফিয়ে বলে, ওরে রে লক্ষণ, এ কী শুধু অলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ! তারপর সে কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে বলে, কিশোরীবাবু আমাকে কত দুঃখ করে বলেন, রবি, তোর এমন সুন্দর গানের গলা, কেন যে তুই পঁাচালির দলে ভর্তি হলি না, তাহলে দেশে যা হোক, তোর একটা নাম থাকত।
২৬.
–তুমি নতুন-দাদাকে খুব ভালোবাস, তাই না?
ভোরবেলা রান্নাঘরে আচমকা এই প্রশ্নে চমকে ওঠে কাদম্বরী।
কখন রবি এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে, সে খেয়ালই করেনি।
–-বর বলে কথা, ভালো তো বাসতেই হবে গো, নাহলে লোকে বলবে কী? হেসে বলে কাদম্বরী।
সেই হাসির দিকে এমনভাবে তাকায় বালক রবি, কাদম্বরীর মনে হয় রবি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে।
–বর হলেই ভালোবাসতে হয়?
–তা বোধহয় নয় রবি। কিন্তু আমি যে তোমার নতুনদাদাকে খুব ভালোবাসি, সেকথা বুঝলে কেমন করে রবি?
–ওই যে রোজ ভোরবেলা হলে তুমি টোস্ট আর চা করো নতুনদাদার জন্যে, কী সুন্দর করে মাখন লাগাও। রবির কথায় কাদম্বরীর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।
–-রবি, তোমার খিদে পেয়েছে, না?
–না তো, আমার খিদে পায় যখন ব্রজেশ্বরের খেয়াল হয়। যতক্ষণ না ব্রজেশ্বরের খেয়াল হচ্ছে, ততক্ষণ তো আমার খিদে পাওয়া বারণ। যদি বলি ব্রজেশ্বরদা, আমার খুব খিদে পেয়েছে, অমনি ব্রজেশ্বরদা যায় রেগে। বলে, দাঁড়াও দাঁড়াও সাত সকালে খিদে পেলে তো চলবে না। আগে পুকুরে চান করে আসি। নতুন বউঠান, তুমি ব্রজেশ্বরদার চান দেখেছ?
–না তো! অবাক হয়ে আবার মিষ্টি হেসে বলে কাদম্বরী। আবার রবি তেমন স্বপ্ন দেখার মতো চোখে তাকিয়ে থাকে সেই হাসির দিকে।
–আমি জানলা দিয়ে দেখি। একদিন তোমাকে দেখাব। ওই যে গো আমাদের তোশাখানার দক্ষিণভাগে একটা জানলা আছে না? যেখানে কাচের সেজে মিটিমিটি করে রেড়ির তেলে আলো জ্বলে। আর টিকটিকি আর পোকারা ঘোরে, সেখানে ভোরবেলা আমি পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। আমার যতই খিদে পাক, ব্রজেশ্বরদা আগে চান সারবে, তারপর তো কাজ।
–চানটা কেমন বলো তো রবি?
–সেটাই তো বলছি। অনেক বাতিক আছে গো ব্রজেশ্বরদার। পুকুরে নেমে উপরকার তেলভাসা জল অনেকক্ষণ দু’-হাত দিয়ে ঠেলবে। তারপর যখন তার মনে হবে, আর তেল নেই, তখন ঝুপ করে একবার ডুব। তারপর আবার শুরু হবে তেল সরানো। এইভাবে সাত অাটটা ডুব। তারপর পুকুর থেকে উঠে সে এমন ভঙ্গিতে হাত-পা বেঁকিয়ে চলবে, যেন সারা পৃথিবীটা খুব নোংরা। যেন সব কিছুর পাশ কাটিয়ে চললে, তবেই তার রক্ষে। তারপর অনেক দেরি করে বেঁকে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বলবে, কী, ভোর না হতেই খিদে? আর যেদিন বউঠান জলখাবারে ব্রজেশ্বরদার লুচি করার কথা, সেদিন কী করে জানো?
–কাদম্বরী গভীর স্নেহে রবিকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, কী করে সে?
– একটা করে লুচি আলগোছে দুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, আর দেব কি?
– তখন কী বলো তুমি? কাদম্বরীর গলা কঁাপে মায়াভরা বেদনায়।
– নতুন বউঠান, আমি বুঝতে পারি কোন উত্তরটা ব্রজেশ্বরদার মনের মতো হবে।
–তাই!
–হ্যাঁ গো। আমি বলি, আর চাই নে!
–সে কী! কিন্তু আমি যে ব্রজেশ্বরকে দেখি কাঠের বারকোশে অনেক লুচি ভেজে নিয়ে যেতে।
–সে তো ওর নিজের জন্যে নতুন বউঠান। শোলক্ওয়ালা একটা ঘরে। তার মধ্যে তো ব্রজেশ্বরদা লুচি আর দুধ রেখে দেয়।
–রবি, তুমি বসে থাকো খিদে চেপে আর ব্রজেশ্বর লুচি জমিয়ে রাখে আলমারিতে?
–তুমি যেন একথা কাউকে বোলো না নতুন বউঠান। তাহলে ব্রজেশ্বরদা অনেক শাস্তি দেবে আমাকে। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাকে খুব অবাক করে।
– কী ব্যাপার ঠাকুরপো?
–এই যে আমি এত কম খাই, তাতে আমার শরীর তো খারাপ হয় না। এত করে ভগবানকে ডাকি, বলি একটা ব্যামো দাও, তাও হয় না। কম খাওয়া যে আমাকে কাহিল করছে, সেকথা তো বলার জো নেই। শরীরটা নতুন বউঠান এমন বিচ্ছিরি রকমের ভালো, যে রোজ রোজ ইশকুল যেতে হয়। কাদম্বরী রবির এ কথা শুনে হাসতে হাসতে তাকে আদর করে তার গালে একটা চুমু বসিয়ে দেয়।
– তোমাকে হাসলে খুব সুন্দর দেখায় নতুন বউঠান, বলে রবি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
মালিরা তাদের ফুলের ঝুড়ি নিয়ে আসে তোমাদের জন্য। তোমরা বেলফুলের গোড়ে মালা গেঁথে বিকেলবেলা কী সুন্দর করে সেজে সেই মালা খোঁপায় লাগাও। গা ধুয়ে ঘরের সামনে বসে সমুখে হাত-আয়না রেখে চুল বাঁধো। বিনুনি করে চুলের দড়ি দিয়ে খোঁপা তৈরি করো। কত সুন্দর সুন্দর শাড়ি পাক দিয়ে কুঁচকিয়ে তুলে কতক্ষণ ধরে সাজগোজ করো। তোমাদের বেলফুলের মালার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারাবাড়ি জুড়ে। নাপতিনি আসে। ঝামা দিয়ে পা ঘষে তোমাদের আলতা পরিয়ে দেয়। কিন্তু আমার কী আছে বলো?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
– শুধু হাসলে সুন্দর? কিন্তু তোমাকে যে সব সময়ে আমার সুন্দর লাগে।
–আমি সুন্দর? কিন্তু আমাকে যে এ বাড়িতে কেউ ভালোবাসে না। এক পয়সা দামের গোলাপি-রেউড়ি কিনে দেওয়ার মতোই কেউ ভালোবাসে না আমাকে। তবে সন্ধেবেলায় কিশোরীবাবু এলে আমার খুব ভাল্লাগে।
–রবি, তুমি নাকি কিশোরীর চাটুজ্জের রামায়ণ পড়া খুব ভালো নকল করতে পারো?
–কে বলল তোমাকে?
–তোমার জৈদাদা।
–আমি যে নতুন দাদাকে ‘জৈদাদা’ বলেও ডাকি, তুমি জানো?
–তোমার নতুনদাদাই আমাকে বলেছে, রবি আমার জ্যোতিরিন্দ্র-কে একেবারে খুদে করে ‘জৈ’-তে নামিয়েছে। রবি, তুমি আমাকে একটিবার শোনাও কীভাবে নকল করো কিশোরী চাটুজ্জে-কে! টোস্ট তৈরি করতে-করতে হেসে বসে কাদম্বরী।
ররিকে দু’বার বলতে হয় না। সে তিড়িং করে লাফিয়ে বলে, ওরে রে লক্ষণ, এ কী শুধু অলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ! তারপর সে কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে বলে, কিশোরবাবু আমাকে কত দুঃখ করে বলেন, রবি, তোর এমন সুন্দর গানের গলা, কেন যে তুই পাঁচালির দলে ভর্তি হলি না, তাহলে দেশে যা হোক, তোর একটা নাম থাকত। আমারও খুব ইচ্ছে বউঠান, পাঁচালির দলে ভর্তি হয়ে গ্রামে গ্রামে মনের আনন্দে গান গেয়ে বেড়াই। তা নয়, শুধু ইশকুল আর ইশকুল। আমার বউঠান মেয়েদের খুব হিংসে হয়।
–কেন, হিংসে হয় কেন?
–এই যে তুমি একজন মেয়ে, তোমাদের জীবনে কত কী আছে!
–যেমন?
–মালিরা তাদের ফুলের ঝুড়ি নিয়ে আসে তোমাদের জন্য। তোমরা বেলফুলের গোড়ে মালা গেঁথে বিকেলবেলা কী সুন্দর করে সেজে সেই মালা খোঁপায় লাগাও। গা ধুয়ে ঘরের সামনে বসে সমুখে হাত-আয়না রেখে চুল বাঁধো। বিনুনি করে চুলের দড়ি দিয়ে খোঁপা তৈরি করো। কত সুন্দর সুন্দর শাড়ি পাক দিয়ে কুঁচকিয়ে তুলে কতক্ষণ ধরে সাজগোজ করো। তোমাদের বেলফুলের মালার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারাবাড়ি জুড়ে। নাপতিনি আসে। ঝামা দিয়ে পা ঘষে তোমাদের আলতা পরিয়ে দেয়। কিন্তু আমার কী আছে বলো?
সত্যিই রবির জন্য কাদম্বরীর বুকের শিরায় টান ধরে। সে বুঝতে পারে এ-বাড়িতে রবি কতটা একা।
হঠাৎ সে বলে, চলো, আমার ঘরে চলো।
–তোমার ঘরে? এখন? কেন? রবি অবাক।
–বুঝতে পারছ না কেন? কতগুলো টোস্ট করেছি, দেখতে পাচ্ছ না?
–পাচ্ছি তো?
–সেগুলো খাবে কে? আজ থেকে প্রত্যেকদিন ভোরবেলা চলে আসবে আমার ঘরে। ব্রজেশ্বর কখন খাবার দেবে তার জন্যে তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে না রবি।
–কিন্তু নতুনদাদা?
–নতুনদাদা খুব খুশি হবে। তোমাকে তোমার নতুনদাদা কত ভালোবাসে তুমি জানো না?
–ভালোবাসে তো আমাকে থিয়েটারে নিয়ে যায় না কেন? থিয়েটার দেখতে আমার খুব ইচ্ছে করে নতুন বউঠান।
(চলবে)
…মেজবউঠাকরুণ-এর অন্যান্য পর্ব…
মেজবউঠাকরুণ ২৫: জ্ঞানদা প্রথম মা হল একটি মৃত সন্তান প্রসব করে!
মেজবউঠাকরুণ ২৪: কাদম্বরীকে ‘নতুন বউঠান’ বলে উঠল সাত বছরের রবি
মেজবউঠাকরুণ ২৩: ঠাকুরপো, তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুমি ছাদে একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে!
মেজবউঠাকরুণ ২২: কাল থেকে আমিও রবির মতো একা হয়ে যাব না তো ঠাকুরপো?
মেজবউঠাকরুণ ২১: জ্ঞানদার মধ্যে ফুটে উঠেছে তীব্র ঈর্ষা!
মেজবউঠাকরুণ ২০: স্বামী সম্বন্ধে জ্ঞানদার মনের ভিতর থেকে উঠে এল একটি শব্দ: অপদার্থ
মেজবউঠাকরুণ ১৯: কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে তোলপাড় নিয়ে আসছে
মেজবউঠাকরুণ ১৮: নতুনকে কি বিলেত পাঠানো হচ্ছে?
মেজবউঠাকরুণ ১৭: চাঁদের আলো ছাড়া পরনে পোশাক নেই কোনও
মেজবউঠাকরুণ ১৬: সত্যেন্দ্র ভাবছে জ্ঞানদার মনটি এ-বাড়ির কোন কারিগর তৈরি করছে
মেজবউঠাকরুণ ১৫: জ্ঞানদার কাছে ‘নতুন’ শব্দটা নতুন ঠাকুরপোর জন্যই পুরনো হবে না
মেজবউঠাকরুণ ১৪: জ্যোতিরিন্দ্রর মোম-শরীরের আলোয় মিশেছে বুদ্ধির দীপ্তি, নতুন ঠাকুরপোর আবছা প্রেমে আচ্ছন্ন জ্ঞানদা
মেজবউঠাকরুণ ১৩: বিলেতে মেয়েদের গায়ে কী মাখিয়ে দিতে, জ্ঞানদার প্রশ্ন সত্যেন্দ্রকে
মেজবউঠাকরুণ ১২: ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে
মেজবউঠাকরুণ ১১: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ১০: অসুস্থ হলেই এই ঠাকুরবাড়িতে নিজেকে একা লাগে জ্ঞানদানন্দিনীর
মেজবউঠাকরুণ ৯: রোজ সকালে বেহালা বাজিয়ে জ্ঞানদার ঘুম ভাঙান জ্যোতিঠাকুর
মেজবউঠাকরুণ ৮: অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা
মেজবউঠাকরুণ ৭: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ৬: পেশোয়াজ অন্দরমহল আর বারমহলের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল
মেজবউঠাকরুণ ৫: বাঙালি নারীশরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান
মেজবউঠাকরুণ ৪: বৈঠকখানায় দেখে এলেম নবজাগরণ
মেজবউঠাকরুণ ৩: চোদ্দোতম সন্তানকে কি ভুল আশীর্বাদ করলেন দেবেন্দ্রনাথ?
মেজবউঠাকরুণ ২: তোমার পিঠটা কি বিচ্ছিরি যে তুমি দেখাবে না বউঠান?
মেজবউঠাকরুণ ১: ঠাকুরবাড়ির বউ জ্ঞানদাকে ঘোমটা দিতে বারণ দেওর হেমেন্দ্রর
কাগজ বেরনোর পর দেখা গেল উপন্যাসের নাম হয়ে গেছে ‘শালিকার ঠোঁট’! পূর্ণেন্দুদা রেগে আগুন। পিঠে হাত দিয়ে সন্দীপন তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, ‘কী করবে ভাই বল! ছাপাখানার ভূত কাউকেই রেহাই দেয় না রে।’ পরে জানা গিয়েছিল এটা সন্দীপনদারই সূক্ষ্ম হাতের কাজ।