এআই-কে আমরা ভালো না খারাপ কোন উদ্দেশে ব্যবহার করছি, তার ওপর নির্ভর করছে এর গ্রহণযোগ্যতা। সম্প্রতি একটি সিনেমায় গান গাইলাম। নাম– ‘অতি উত্তম’, কিছুদিনের মধ্যে সিনেমাটি রিলিজ হবে। সেখানে উত্তমকুমার রয়েছেন, উত্তমকুমারকে ডায়লগ বলতেও দেখা যাচ্ছে। পুরোটাই হয়েছে এআই-এর সহায়তায়। এই ধরনের পরীক্ষামূলক কাজ ছাড়া এআই-এর কোনও সদর্থক ভূমিকা আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না।
শুরুতেই বলে রাখি, এআই, অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার নিয়ে বাংলা গানের জগতে সম্প্রতি যে হুলুস্থুুল পড়ে গিয়েছে, সেটা আমার কাছে নতুন নয়। গত বছর আমেরিকায় কনসার্ট করতে গিয়ে এমন ঘটনার সাক্ষী থেকেছি।
এআই ব্যবহার করে তৈরি করা গান আমি আগেও শুনেছি। একটা নয়, বেশ কিছু। কিন্তু এআই-এর আবির্ভাব কিংবা তার প্রভাব যতই সুদূরপ্রসারী হোক না কেন, এই সমাজে যে কোনও পারফর্মিং আর্ট, সে গান হোক, কিংবা নাচ, পেন্টিং বলুন কিংবা অন্য কিছু– আমার বিশ্বাস, সে তার নিজস্ব পথ তৈরি করে নেবে। এবং সেই পথ ধরে নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করতে সমর্থ হবে। কোনও অবস্থাতেই শিল্পের দাবিকে কখনও মুছে ফেলা যাবে না।
কেন বলছি একথা? একটা উদাহরণ দিই। পেন্টিংয়ের কথাই ধরা যাক। একটা সময় ছিল, যখন চিত্রশিল্পীরা রং-তুলিতে ছবি আঁকতেন, ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পকর্ম। রাজদরবারেও সমাদর পেতেন চিত্রশিল্পীরা। তারপর একটা সময় ক্যামেরার আর্বিভাব ঘটল। ছবিকে স্রেফ রং-তুলি দিয়ে ক্যানভাসে তুলে ধরা নয়, তাকে ক্যামেরাবন্দি করে রাখাটাও মানুষকে আকর্ষণ করল। তাই বলে, পেন্টিং তো আর উঠে যায়নি। হ্যাঁ, ক্যামেরা আসার পর যখন ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু হল, তখন পেন্টিং এবং এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা, চিত্রশিল্পীরা ভয়ংকর সমস্যার মুখে পড়েছিলেন। তাদের ভবিষ্যতের সামনে বড় সড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারপর? নতুন পথ বেরিয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেকনোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট হবেই, তাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। এআইও তেমনই একটা প্রযুক্তিগত ডেভেলপমেন্ট। এই নয় যে, তার প্রভাব শুধু আমাদের গানের জগতে পড়েছে। এবং সেই প্রভাবে গায়ক বা শিল্পীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থাৎ এই রোবোটিক সিস্টেম সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে কর্পোরেট জগতে। এমন একটা সময়ের মধ্যে আমরা বসবাস করছি, সেখানে ফিল্ম হোক কিংবা গানের জগৎ কিংবা অন্য কোনও ফিল্ড, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার হবে না, এটা বলা যাবে না। হবেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গানের জগতের প্রেক্ষিতে কথা যদি বলতে হয়, ভার্চুয়াল সাউন্ড তো বহুকাল আগে এসে গিয়েছে। কী-বোর্ড অপারেটরকে দিয়ে অনায়াসে সরোদের সাউন্ড আমরা বাজিয়ে নিচ্ছি, তার জন্য তো সরোদ-চর্চা বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং সেই শিল্পীরা, যাঁরা সরোদ চর্চা করেন, তাঁরা নিজেদের অস্তিত্বকে বাজিয়ে রাখার পথ তৈরি নিয়েছেন। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, হিউম্যান-এরর ছাড়া ক্রিয়েটিভ কাজ তৈরি করা কখনও সম্ভব নয়। যন্ত্রের মাধ্যমে, রোবোটিকভাবে যখনই তাকে নিখুঁত করার চেষ্টা চালানো হবে, ব্যাপারটা কৃত্রিম হয়ে যাবে। ফলে এআই যাই করুক, যে ক্রিয়েটিভিটির জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করুক, সেটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে বলে মনে হয় না। এআই নির্মিত গান আর ন্যাচারাল সংগীত– তফাতটা করার জন্য শিল্পীর প্রয়োজন হবে না, সাধারণ মানুষই তা করতে পারবে। ছোট্ট ছোট্ট যে তফাত, সেগুলো মানুষই ধরিয়ে দেবে।
আসলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেকনোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট হবেই, তাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। এআইও তেমনই একটা প্রযুক্তিগত ডেভেলপমেন্ট। এই নয় যে, তার প্রভাব শুধু আমাদের গানের জগতে পড়েছে। এবং সেই প্রভাবে গায়ক বা শিল্পীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থাৎ এই রোবোটিক সিস্টেম সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে কর্পোরেট জগতে। এমন একটা সময়ের মধ্যে আমরা বসবাস করছি, সেখানে ফিল্ম হোক কিংবা গানের জগৎ কিংবা অন্য কোনও ফিল্ড, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার হবে না, এটা বলা যাবে না। হবেই। কিন্তু এর জন্য মিউজিশিয়ানদের ঘাবড়ে যাওয়ার কোনও কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। প্রথমত, লাইভ পারফরম্যান্স, সেটা এআই দিয়ে হবে না। দ্বিতীয়ত, একটা গান যখন তৈরি হচ্ছে, সেটা যদি এআই সহায়তায় অর্থাৎ একটা রোবোট তৈরি করে, তাহলে সেই গানের সঙ্গে ন্যাচারাল যে গান, তার একটা ‘হিউম্যান এরর’ থাকবেই। সেটা শ্রোতারা কতটুকু গ্রহণ করবে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
সম্প্রতি বন্ধু অনুপমের (রায়) একটা গান ‘বাউন্ডুলে ঘুড়ি’, সেটা দেখলাম, হেমন্তকণ্ঠী করে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হলেও সেটা যে খুব শ্রুতিমধুর হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। সেটা যে রোবোটিক, সেটা যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন না, হেমন্তবাবুর ফিলিংসগুলো, ইমোশনগুলো যে ওই গানে নেই, তা ধরা পড়ে যাচ্ছে। আসলে যে কোনও সৃষ্টিশীল কাজ, যেখানে ক্রিয়েটিভিটি রয়েছে, সেখানে ইমোশন একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাকে বাদ দিয়ে কোনও সৃষ্টিশীল কাজ হতে পারে না। সেটা এআইয়ের পক্ষেও তৈরি করা সম্ভব নয়। আর সেটাও যদি হয়, তাহলে শিল্পের স্বার্থে, তার উৎকর্ষতার স্বার্থে, তার স্থায়িত্বের কথা বিবেচনা করে শিল্পীরা, এই আমরা, যারা মিউজিক নিয়ে কাজ করছি বা সিনেমা আর্টিস্টরা নিশ্চয়ই একটা বিকল্প রাস্তা ঠিক খুঁজে বের করে নেব।
এআইয়ের মাধ্যমে গানে একটা বিপ্লব আনার এই প্রয়াস, আমার মনে হয় না, এর দ্বারা গানের জগতের কোনও উপকার হবে। জানি, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ব্যাপারটা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি নিজে সোশ্যাল মিডিয়াকে ততটা গুরুত্ব দিই না। ওটাই তো সমাজের পূর্ণ রূপ তো নয়। ওটা একটা সামাজিক প্ল্যাটফর্ম। তার ভিত্তি আমার মধ্যে এখনও গড়ে ওঠেনি সেভাবে। সোশাল মিডিয়া সম্পূর্ণ একটা ধোঁয়াশার জায়গা। ফলে সেখানে কী ভাইরাল হচ্ছে, তার ওপর ভবিতব্য নির্ভর করবে না। পারফর্মিং আর্টের যে মৌলিক দিকগুলো রয়েছে, যেমন থিয়েটার বলুন, সেটা কখনও এআইয়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মহম্মদ রফি, কিশোর কুমারের গলায় অন্য কারও গান এআই-এর দ্বারা বসিয়ে দেওয়া হয়তো যাবে, কিন্তু তাঁদের লাইভ স্টেজে এনে পারফর্ম করানো যাবে না।
ব্যাপার হল, এআই-কে আমরা ভালো না খারাপ কোন উদ্দেশে ব্যবহার করছি, তার ওপর নির্ভর করছে এর গ্রহণযোগ্যতা। সম্প্রতি একটি সিনেমায় গান গাইলাম। নাম– ‘অতি উত্তম’, কিছুদিনের মধ্যে সিনেমাটি রিলিজ হবে। সেখানে উত্তমকুমার রয়েছেন, উত্তমকুমারকে ডায়লগ বলতেও দেখা যাচ্ছে। পুরোটাই হয়েছে এআই-এর সহায়তায়। এই ধরনের পরীক্ষামূলক কাজ ছাড়া এআই-এর কোনও সদর্থক ভূমিকা আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না। সিনেমার প্রয়োজনে, চলচ্চিত্রের দাবি মেনে একটা দৃশ্যে গ্রামের বাউলের সঙ্গে বেঠোফেনকে বসিয়ে দেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু এআইয়ের সাহায্যে বাউলের গলায় যেমন বেঠোফেনের গান মানাবে না, তেমনই মানাবে না যদি এআই-এর সাহায্যে বেঠোফেনের গলায় বাউল গান বসিয়ে দেওয়া হয়। তাই এআই-এর আবির্ভাবে কোনও ক্রিয়েটিভ ফিল্ডের– সে নাটক হোক কিংবা সিনেমা, বাংলা গান হোক কি বিদেশি গান– তাদের ভয়ের কিছু নেই। যা আশঙ্কার তা হল, এআই-এর ব্যাপক প্রয়োগের কারণে কিছু মানুষের চাকরি যাবে। বেকারত্ব তৈরি হবে। একটা জবলেস সোসাইটি তৈরি হবে, ক্রাইম বাড়বে।
এটা মেনে নিতে হবে, এআইকে আটকানো যাবে না। মিউজিশিয়ানরা এটা নিয়ে সাময়িক আগ্রহ দেখাবেন। কিছু এক্সপেরিমেন্টও হবে, তবে সেটা দিয়ে যে মহৎ শিল্প সৃষ্টি কখনও সম্ভব নয়, অচিরেই বুঝতে পারবে।
অশোক ঘোষ মনে করতেন, ট্রাম আন্দোলন কলকাতার হকারদের একটি রাজনৈতিক চেতনা জুগিয়েছিল। এই আন্দোলন ছিল ছাত্র, শিক্ষক, কেরানি, হকার, আর উদ্বাস্তুদের লড়াই। আর ট্রাম-ডিপো মানেই হকার। এইসব দোকানেই আন্দোলনকারীদের আড্ডা বসত। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের কথা আলোচনা হত। সকালে হয়তো কোনও এক চায়ের দোকানে জটলা পাকিয়ে খবরের কাগজ পড়া হত।
বীরভূমের লেখক-গবেষকেরা মনে করেন, বীরভূমের লাভপুরের কাছে দেবী ফুল্লরাতেই সেই পীঠের অধিষ্ঠান আবার বর্ধমানের গবেষকেরা দাবি করেন, ঈশানী নদীর বাঁকে বর্ধমানের দক্ষিণডিহিতেই দেবীর ওষ্ঠপাত ঘটেছিল। তবে ভক্তদের কাছে দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র এবং অলৌকিক শক্তি দুই জায়গাতেই বর্তমান।