হওয়ার কথা ছিল ফিল্ম ডিরেকটর। কৈশোর পেরনোর আগেই দুটো কাজে হাতেখড়ি করে ফেলেছিলেন। ইরানের সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন স্কুলে-র একদম শুরুর দফাতেই ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন দানেশিয়ান। আর মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পাঠশালাতেও নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন। অনাগত বিপ্লবের সিনেমা বানাতে হবে, সিনেমাকে রাজনীতির কাজে লাগাতে হবে… এই স্বপ্নে আঠারো তখন বুঁদ। সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন স্কুলের পাট চুকতে সময় লাগেনি যদিও– বছর না ঘুরতেই সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে! কারণ তাঁর বিপজ্জনক রাজনৈতিক যোগাযোগ।
১১.
তারপর? তারপর আমরা– কেরামত দানেশিয়ান আর খোসরো গোলসোরখি– প্রিয়তম দুই বন্ধু তেহরানের কেন্দ্রীয় কারাগারের এই নির্জন সেলে। কদিনের জন্যই বা! এই তো আর ক-টা দিন গেলেই আমাদের দু-জনকে মেরে ফেলা হবে। ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ ভোরবেলায় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াব আমরা দু-জন। মোটেই চোখ বাঁধতে দেব না দু-জনের কেউই। কারণ সূর্য ওঠা দেখতে দেখতে মরব আমরা! মরতে মরতেও আমরা সূর্য ওঠা দেখব। তার আগের এই ১৭ ফেব্রুয়ারির রাত। আমরা স্লোগান দিয়েছি এতক্ষণ, কবিতা পড়েছি। একসঙ্গে পাশাপাশি বসে রাতের খাওয়া সেরেছি। জেলের রক্ষীরা অবাক চোখে দেখে চলেছে আমাদের হাসিমুখ, অবাক কানে শুনে গেছে আমাদের উঁচুগলা। এদেশরই মানুষ ওরা, একদিন আমাদের কবরে ঠিকই ফুল নিয়ে দাঁড়াবে, দেখো! এখন আমাদের শেষ গানটি গাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। তেহ্রানের মিলিটারি কোর্ট। খোসরো গোলসোরখির সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হল। সঙ্গে কেরামত দানেশিয়ানেরও। উচ্ছ্বসিত গোলসোরখি বলে ওঠেন, ‘কমরেড!’ দানেশিয়ান উত্তর দেন, ‘প্রিয়তম কমরেড আমার’ বলে!
হওয়ার কথা ছিল ফিল্ম ডিরেকটর। কৈশোর পেরনোর আগেই দুটো কাজে হাতেখড়ি করে ফেলেছিলেন। ইরানের সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন স্কুলে-র একদম শুরুর দফাতেই ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন দানেশিয়ান। আর মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পাঠশালাতেও নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন। অনাগত বিপ্লবের সিনেমা বানাতে হবে, সিনেমাকে রাজনীতির কাজে লাগাতে হবে… এই স্বপ্নে আঠারো তখন বুঁদ। সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন স্কুলের পাট চুকতে সময় লাগেনি যদিও– বছর না ঘুরতেই সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে! কারণ তাঁর বিপজ্জনক রাজনৈতিক যোগাযোগ। তার ওপরে ওই বয়সেই তথ্যচিত্র বানিয়ে বসেছিলেন একটা– ইরানের তেল বিদেশিরা কীভাবে লুঠে নিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে। কবিতা লেখাও চলছে পুরোদমে। কবিতা আর বিপ্লব কাছাকাছি আনছে খোসরো গোলসোরখি আর কেরামত দানেশিয়ানকে। তেহ্রান থেকে দূরের গ্রামে গ্রামে তখন দানা বাঁধছে ফাদায়াঁ-ই-খাল্ক-এর গেরিলাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ। ইরান মানেই কিন্তু তেহ্রান শুধু নয়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সূর্য ওঠা দেখতে দেখতে মরব আমরা! মরতে মরতেও আমরা সূর্য ওঠা দেখব। তার আগের এই ১৭ ফেব্রুয়ারির রাত। আমরা স্লোগান দিয়েছি এতক্ষণ, কবিতা পড়েছি। একসঙ্গে পাশাপাশি বসে রাতের খাওয়া সেরেছি। জেলের রক্ষীরা অবাক চোখে দেখে চলেছে আমাদের হাসিমুখ, অবাক কানে শুনে গিয়েছে আমাদের উঁচুগলা। এদেশরই মানুষ ওরা, একদিন আমাদের কবরে ঠিকই ফুল নিয়ে দাঁড়াবে, দেখো! এখন আমাদের শেষ গানটি গাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এরপর থেকে গোলসোরখি আর দানেশিয়ানের জীবন একই খাতে বয়ে গেছে। এবং মৃত্যুও, কী আশ্চর্য! সেই সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী ১২ জনের গ্রুপ– যার কেন্দ্রে তাঁরা দু’জন। বারোজনের এই গ্রুপটি শাহ-রাজতন্ত্রের হিংস্র দমননীতি আর প্রতিবাদী কবি-শিল্পী-সাংবাদিকদের গুপ্তহত্যার পাল্টা হিসাবে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ রেজ়া পহ্লভি শাহ-কে অপহরণ ও খতম করার ছক বানিয়েছিল। বারোজনই ধরা পড়ে যান। ১৯৭৪-এ তেহরানের মিলিটারি কোর্টে তাঁদের বিচার শুরু হয়। বারোজনের মধ্যে অনেকেই খোলাখুলি ‘দোষ’ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা করেন। ব্যতিক্রমী পাঁচজন ছিলেন– তায়ফুর বাতাহি, আব্বাস আলি সামাকার, রেজ়া আলমাজ়াদা, কেরামত দানেশিয়ান এবং খোসরো গোলসোরখি। এখানেই গোলসোরখি যে বক্তব্যটি রাখেন, সেটিকে সারা পৃথিবীর বিপ্লবীদের শ্রেষ্ঠ ‘কোর্টরুম স্পিচ’-এর একটি বলে ধরা হয়ে থাকে। দানেশিয়ানের বক্তৃতাটিও কম আগ্নেয় ছিল না (নজর করার মতো একটা তথ্য রয়েছে এখানে। এই বারোজন যখন ধরা পড়েছিলেন, তখনও ইরানের রাষ্ট্রীয় গুপ্তচর বিভাগ ‘সাভাক’ কিন্তু এই অপহরণ আর হত্যা-ষড়যন্ত্রের কথা জানত না। বিচার শুরুর আগেই এই বারোজনের একজন, শোকোহ্ মিরজ়াদেগি, এই পরিকল্পনার কথা সাভাক-এর কাছে ফাঁস করে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত ও বিচারের মোড় ঘুরে যায়, এবং পরিণতি মৃত্যুদণ্ড অবধি গড়ায়)।
তারপর? তারপর আমরা প্রিয়তম দুই বন্ধু তেহরানের কেন্দ্রীয় কারাগারের এই নির্জন সেলে। ক’দিনের জন্যই বা! এই তো আর ক’টা দিন গেলেই আমাদের দু’জনকে মেরে ফেলা হবে। ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ ভোরবেলায় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াব আমরা দু’জন। মোটেই চোখ বাঁধতে দেব না দু’জনের কেউই। কারণ সূর্য ওঠা দেখতে দেখতে মরব আমরা! মরতে মরতেও আমরা সূর্য ওঠা দেখব। তার আগের এই ১৭ ফেব্রুয়ারির রাত। আমরা স্লোগান দিয়েছি এতক্ষণ, কবিতা পড়েছি। একসঙ্গে পাশাপাশি বসে রাতের খাওয়া সেরেছি। জেলের রক্ষীরা অবাক চোখে দেখে চলেছে আমাদের হাসিমুখ, অবাক কানে শুনে গিয়েছে আমাদের উঁচুগলা। এদেশরই মানুষ ওরা, একদিন আমাদের কবরে ঠিকই ফুল নিয়ে দাঁড়াবে, দেখো! এখন আমাদের শেষ গানটি গাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
–দানেশিয়ান তুমি গাও। তোমার লেখা সেই বসন্তের সেই কবিতা! কতদিন শোনাওনি! তুমি শহিদ হওয়ার একবছরের মধ্যে এদেশের কোনায় কোনায় যে কবিতা জনগান হয়ে পৌঁছে যাবে। দিগন্তবিস্তারী মাঠে ঘাসের মাথা দুলিয়ে দিয়ে বয়ে যেতেই থাকবে– দিন, বছর, দশক পেরিয়ে।
ধুলো নেই হাওয়া-ঝিরঝিরে লিলিফুলে
ফিঙে, শালিকের গানেও খুশির ছোঁয়া
প্রাণ কেঁপে ওঠে পল্লবে, তৃণমূলে
বসন্ত এলো, শস্যের আলো-ধোয়া
বসন্তঋতু, শস্যের আলো-ধোয়া।
স্বজন, সুজন, জানাশোনা মানুষেরা
যারা রণভূমে নিয়ত দীপ্যমান
কলমে তুলিতে ভাবীকাল আঁকে যারা
বসন্তআলোতে হয়ে ওঠো খরশান।
বসন্তআলোয় তুমি হোয়ো খরশান।
খিদে আছে, নিপীড়ন, এবং অজ্ঞতাও
এ পৃথিবীর জল মাটি দেশ মহাদেশে
হাত ধরে থাকা জরুরি, জেনেছি তাও
জলধারা যাতে এক সমুদ্রে মেশে।
জলধারা এসে এক সমুদ্রে মেশে।
স্বজন, সুজন, জানাশোনা মানুষেরা
যারা রণভূমে নিয়ত দীপ্যমান
কলমে তুলিতে ভাবীকাল আঁকে যারা
বসন্তআলোতে হয়ে ওঠো খরশান।
বসন্তআলোয় তুমি হোয়ো খরশান।
[ব্যবহৃত ছবিগুলির সম্পাদনা: এষা এবং শুভদীপ ঘোষ]
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved