ইংরেজের পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমাদের শেখায় ‘জিন-লাগাম-পরা অবস্থায় দৌড়তে দৌড়তে মরাই গৌরবের মরণ’। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তাহলে চলার সম্পূর্ণতাকে অস্বীকার করা হয়, চাবুক আর লাগামকেই স্বীকার করা হয়। নদীর সঙ্গে জীবনের তুলনা করে বলছেন, সমুদ্রে পৌঁছে নদীর যে থামা, সে থামার মধ্যে শূন্যতা নেই, পূর্ণতা আছে।
২৩.
‘গানে সম আছে, ছন্দে যতি আছে এবং এই-যে লেখা চলছে, এই লেখার অন্য-সকল অংশের চেয়ে দাঁড়ির প্রভুত্ব কিছুমাত্র কম নয়। এই দাঁড়িগুলোই লেখার হাল ধরে রয়েছে– একে একটানা নিরুদ্দেশের মধ্যে হু হু করে ভেসে যেতে দিচ্ছে না।’
উপাসনাগৃহে ‘শেষ’ শীর্ষক অভিভাষণ এইভাবে শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলছেন, কবিতা যেখানে শেষ হয়, সেখানেই যদি তার সব কথা, সব সুরও একেবারে শেষ হয়ে যায়, তাহলে সেই কবিতা নিজের দীনতায় লজ্জিত হয়। কোনও ভালো কবিতাই একেবারে শূন্যের মধ্যে শেষ হয় না। যেখানে সে শেষ হয় সেখানেও সে অনেক কথা বলতে থাকে। সেই নিঃশব্দে কথাগুলো বলার অবকাশ পেতে হলে তাকে সময়মতো থামতে হয়।
…………………………………………………………………………………………………..
যৌবন পেরিয়েও যৌবনকে টানাটানি করে ধরে রাখতে চাইলে, কত দুঃসাধ্য চেষ্টার পরেও ভয়-ভাবনা-লজ্জার শেষ থাকে না। পেকে যাওয়ার পরেও ফল যদি শাখা ছেড়ে দেওয়াকে অগৌরব মনে করে, তাহলে তার দীনতা কৃপার পাত্রই হয়।
……………………………………………………………………………………………………
মানুষের জীবনেও থামতে পারাকে আমাদের দেশ মূল্যবান মনে করেছে, অগৌরবের মনে করেনি।ইংরেজের পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমাদের শেখায় ‘জিন-লাগাম-পরা অবস্থায় দৌড়তে দৌড়তে মরাই গৌরবের মরণ’। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তাহলে চলার সম্পূর্ণতাকে অস্বীকার করা হয়, চাবুক আর লাগামকেই স্বীকার করা হয়। নদীর সঙ্গে জীবনের তুলনা করে বলছেন, সমুদ্রে পৌঁছে নদীর যে থামা, সে থামার মধ্যে শূন্যতা নেই, পূর্ণতা আছে।
যৌবন পেরিয়েও যৌবনকে টানাটানি করে ধরে রাখতে চাইলে, কত দুঃসাধ্য চেষ্টার পরেও ভয়-ভাবনা-লজ্জার শেষ থাকে না। পেকে যাওয়ার পরেও ফল যদি শাখা ছেড়ে দেওয়াকে অগৌরব মনে করে, তাহলে তার দীনতা কৃপার পাত্রই হয়। ভোগের বা দানের মধ্যে সঞ্চয় ক্ষয় হয়। সঞ্চয় আপনাকে যত ক্ষয় করে, ততই সে সার্থক হয়ে উঠতে থাকে। এই সার্থক অবসানকে স্বীকার করতে না পারলে, সঞ্চয়কে কেবল লজ্জাজনক কৃপণতার ভার বইতে হয়।
সংসারে আমাদের প্রাপ্য যে স্থান আমরা অধিকার করি, সেই অধিকারকে সম্পূর্ণ করে তুলে ত্যাগ করে যাওয়াটাই সুন্দর। সম্মানের। আমৃত্যু সেই অধিকারকে যে কোনও উপায়ে টানাহেঁচড়া করে ধরে রাখতে গেলে অপঘাতের অসম্মান অবধারিত হয়।
মানুষের মূল্য যদি কেবল সমাজের দাবি অনুসারেই নির্ধারিত হয়, সেখানে দুঃখের কারণ ঘটে। যে সমাজ যুদ্ধ দাবি করে সেখানে যোদ্ধার মূল্যই বেশি। সেখানে আর সব চেষ্টা ভুলে মানুষ যোদ্ধা হওয়ার জন্যই প্রাণপণ চেষ্টা করে। কাজের দাবি যে সমাজে সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে, সেখানে নিজের কেজো পরিচয়কেই প্রচার করার জন্য মানুষের প্রয়াস অন্তিম সময় পর্যন্ত চলতেই থাকে। মানুষের জীবন হয়ে ওঠে অসমাপিকা ক্রিয়া। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সেখানে মানুষ যে জায়গায় থামে সে জায়গায় কিছুই পায় না, কেবল লজ্জা পায়; সেখানে কাজ একটা মদের মতো, ফুরোলেই অবসাদ; সেখানে স্তব্ধতার মধ্যে মানুষের কোনো বৃহৎ ব্যঞ্জনা নেই; সেখানে মৃত্যুর রূপ অত্যন্তই শূন্য এবং বিভীষিকাময় এবং জীবন সেখানে নিরন্তর মথিত, ক্ষুব্ধ, পীড়িত ও শতসহস্র কলের কৃত্রিম তাড়নায় গতিপ্রাপ্ত’।
রবীন্দ্রনাথের উপদেশ, করার আদর্শটাই মানুষের একমাত্র আদর্শ নয়, হতে পারে না। হওয়ার আদর্শই বড়। ধানের গাছ যখন রোদবৃষ্টির সঙ্গে সংগ্রাম করে বাড়তে থাকে, সেও যেমন সুন্দর, মাঠের দিন শেষ করে ঘরে আসার দিন আরম্ভ হয় যখন, সেই ফসলের রূপ হয়তো সুন্দরতর। সেই ফসলের মধ্যে ধানখেতের রোদবৃষ্টির ইতিহাস নিবিড়ভাবে নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। সেই নিস্তব্ধতা অগৌরবের নয়। মানুষের জীবনকে তার ফসলের মধ্যে দেখাটাকে অস্বীকার করে কেবল তার খেতের মধ্যেই দেখতে চাইলে, সে জীবনকে নষ্ট করা হয়। খেতের চারা আর গোলার ধান দুইয়ে মিলেই তো জীবনের সম্পূর্ণতা।
‘আমাদের দেশে বলে: পঞ্চাশোর্ধ্বং বনং ব্রজেৎ। কিন্তু সে বন তো আলস্যের বন নয়, সে-যে তপোবন। সেখানে মানুষের এতকালের সঞ্চয়ের চেষ্টা দানের চেষ্টার ক্ষেত্রে প্রবেশ করে।’ জীবনের গার্হস্থ-পর্বের সুন্দর সমাপনের মধ্য দিয়ে সমগ্র পার্থিব জীবনের সুন্দরতর সমাপনের সন্ধানের সূচনা যেন।
রবি ঠাকুর ছেড়ে নিজের কথা দুটো বলি। ইশকুলের পড়া ভালোবাসতে পারিনি, ‘বাড়ির কাজ’ শেষ করতে না পারাটাই ছিল দস্তুর। কিন্তু, কোনও দিন শেষ করে ফেলতে পারলে বড় আরাম হত। সেই আরামের স্মৃতি ফিরে দিল ‘রোববার.ইন’। কোনও দুর্বল মুহূর্তে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম চব্বিশ কিস্তি লিখে চলার। আজ যখন দেখছি, আর একটি লিখলেই প্রতিশ্রুতির পালা শেষ, ভারি আরাম হচ্ছে ভাবতেই। জীবনখাতার শেষ কিস্তি এমন তৃপ্ত আনন্দে শেষ করতে পারার একটা আশা জাগছে।
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২২। কথা জিনিসটা মানুষের, আর গান হল প্রকৃতির
পর্ব ২১। আত্মার স্বরূপ শূন্যতা নয়, নিখিলের প্রতি প্রেম
পর্ব ২০। ভিতরের সাধনা আরম্ভ হলে বাইরে তার কিছু লক্ষণ টের পাওয়া যায়
পর্ব ১৯। মানুষের পক্ষে মানুষ হয়ে ওঠা সব থেকে কঠিন
পর্ব ১৮। যে হৃদয় প্রীতিতে কোমল, দুঃখের আগুন তাকেই আগে দগ্ধ করে
পর্ব ১৭। সাধনায় সাফল্যের আভাস মিললে সেই পথচলা সহজ হয়
পর্ব ১৬। প্রকৃতি ব্যক্তিবিশেষ মানে না, তার কাছে সকলে সমান
পর্ব ১৫। যিনি অসীম তিনি সীমার আকর হয়ে উঠেছেন ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা
পর্ব ১৪। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া
পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না... পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে।
পাশাপাশি এ-ও বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমুখে যেমন অনেকে নতুন বউঠানের মিল খুঁজে পান, তেমনই কারও চোখে সেখানে উদ্ভাসিত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আদল। এই দ্বিতীয় মতে, চিত্রী রবি ঠাকুরের চোখে ওকাম্পোর ছায়া নিঃসন্দেহে আরও প্রবলতর, কারণ নতুন বউঠান সেখানে দূর গ্রহান্তরের বাসিন্দা।