গোড়াতেই বলেছিলাম রুলি মানুষটা নরখাদক টাইপ হলেও এমনিতে যাকে বলে গুড গার্ল। অতঃপর, নগার অজ্ঞাতবাসের খর চাউর হওয়ার পর যখন এলাকার মানুষ রোজই ওকে নানা সময়ে সুযোগসুবিধা মতো এসে পিটিয়ে যাচ্ছে, তখন রুলির ওকে ভালো লেগে যায়। বিয়ের প্রস্তাব রুলি কীভাবে দিয়েছিল, নগা কোন অবস্থায় তা অ্যাকসেপ্ট করে, সে সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায়নি। অনেকেই মনে করে প্রাণে বাঁচতে নগাই ওকে বিয়ের অফার দেয়।
২৪.
আমাদের ছেলেবেলায় মহিলাদের দিকে তাকানো ছিল মহাপাপ। তার ওপর ‘সুন্দরী’ হলে তো তাদের ছায়ার পানে চাইলেও অক্ষয় নরকবাস। ‘মেয়ে দ্যাখে’ খারাপ ছেলেরা– এই বিশ্বাসে বুক বেঁধে গোটা বাঙালি জাতি কেরামতি দেখাতে বেড়িয়েছিল, ফিরেছে তেমন খবর এখনও নেই। নেতাজি, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ইত্যাদি কেউকেটারা দশটা-পাঁচটা চাকরির পর সংসার সামলে, মেয়েকে টুইশানিতে দিয়ে দেশ–উদ্ধারে বেরলে কী হত জানি না, তবে নারী এবং প্রেম যে খুব খারাপ জিনিস, সে বোধটিকে এই মহামানবদের উদাহরণ টেনে সকলেই মগজে ঠেসেছে। মেয়েদের ছেলে দেখতে বারণ করা হত কতটা সিরিয়াসলি, সে বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। কলেজে পড়া ছেলেদের দেখতাম বিভিন্ন বিবাহিত মহিলার সঙ্গে বিকেলে চা-বিস্কুট খাচ্ছে, গল্প করছে, এমনকী, সিনেমা দেখতেও যাচ্ছে সুযোগ-সুবিধামতো। বেশিরভাগ সময় এই সম্পর্কগুলোর কথা সকলে জানত, মহিলাদের বররাও সে বিষয়ে ছিল ভয়ানক উদাসীন এবং স্বাভাবিক। মহিলাদের পুরুষ বন্ধু নিয়ে সে সময় ছুঁৎমার্গ এখনকার পর্যায়ে পৌঁছয়নি। হয়তো গোটা সমাজটাই পর্নোগ্রাফি তৈরি আর কনজিউম করার বাইরেও ভাবতে পারত বলে এটা সম্ভব হয়েছিল। অতএব অমুক বউদির তমুক দেওরের প্রতি বাড়তি স্নেহ, বোনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা, বাড়িতে গাদা গাদা শীতবস্ত্র থাকা সত্ত্বেও একটা হাতা সামান্য ছোট বেগুনি সোয়েটারটা পরেই গোটা জীবন কাটানো ছাড়াও শিলিগুড়ি যেতে হলে ‘তোমাকে আসতেই হবে’ বলে সিএল নেওয়ানো ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার!
রুলি যবে থেকে নবাদার বাড়ি পাঁচওয়ক্ত চক্কর মারা শুরু কললে, সেদিন থেকে অবিশ্যি আমাদের মনে আর কোনও সন্দেহ-ই ছিল না যে, প্রেমের সামনে সবাইকে একদিন মাথা নত করতে হবেই হবে।
রুলির হাত থেকে বাঁচতে নবাদা সদর দরজায় ডবল তালা মেরে কোথায় পগার পার হয়েছিল, সে খবর দেখলাম কারও কাছেই নেই। হদিশ থাকত আগা সাহেবের কাছে। অতএব দিনের বিভিন্ন সময়ে তাকে ঘিরে জটলা! সে কেবল ঘাড় নাড়ে আর ভয়ানক বিরক্ত মুখে বলে ‘নেহি জানতা’। অতএব শোরগোল পড়ে গেল। কেউ বললে, রাজস্থানের দিকে যেতে দেখা গেছে, কেউ বলে রেঙ্গুনের পথে এক অদ্ভুত সন্ন্যাসীর আগমনে সে দেশের সরকার নড়েচড়ে বসেছে। সবটাই আজগুবি গল্প! তবে নবাদা পালিয়েছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
এর মধ্যে এক নিশুতি রাত, বৃষ্টি এবং প্রবল শীত দেখে নগা এলাকায় ফেরে এবং নবাদার ঘরে শেল্টার নেয়। পরদিন আলমারির তালা খুলে টাকা-পয়সা বের করে চাদর মুড়ি দিয়ে বাজার থেকে ভালো-মন্দ সওদা সেরে বাড়ি ফিরে পোলাও-কালিয়া রাঁধতে বসে, কারণ লুকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজ বিশেষ ছিল না। প্রতিবেশীরা টের পায়নি, নবাদার বাড়িতে এমন কিছুই ঘটত না, যা আড়ি পেতে, লুকিয়ে শুনতে বা দেখতে হয়– তাই লোকের অভ্যেস গড়ে ওঠেনি। তবে এলাকায় সুখাদ্য রান্না হলে তার সুবাস রুলির নাক এড়িয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াবে এমনটা অসম্ভব। ও সোজা দরজায় করাঘাত কললে। প্রথমবার ‘ভিতরে কেউ নেই’ শুনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেও, ‘কখন থাকবে’ জানতেই ফের দরজার কড়া নাড়ে। পাল্লা এক চিলতে খুলে নগা যেই না বলতে গেছে ‘বলছি তো কেউ নেই’, রুলি অমনি সেই ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে রাস্কেলটার টুঁটি চিপে একটানে ঘরের মাঝখানে এনে মাটি থেকে ফুটখানেক ওপরে ঝুলিয়ে ধরে মিনিট ১৫ একটানা কিলিয়েছিল– আমরা জেনেছিলাম, কারণ ওই সময় ধরে একটানা ‘ওরে বাবা রে, মরে গেলাম রে’ শোনা গেছিল। এর থেকেই আমাদের ধারণা তৈরি হয় যে, নগা মাঝে বেশ কিছুদিন জেল খেটেছে, এবং নানা বৈধ কারণে সেপাই কনেস্টেবলদের বিরাগভাজন হওয়ার ফলে বেদম মার খাওয়াও অভ্যেস করেছে– নয়তো প্রেমোন্মাদ রুলির পিটানি খেয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। যাই হোক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে রুলি নাকি বিয়ের পর শাশুড়ি ঠাকরুনের পায়ে ঠকাস করে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে গেছিল। ইমপ্যাক্টের ইন্টেনসিটি কন্ট্রোল করতে না পারার ফলে বুড়ির ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের হাড় রুলির কপালের ঠোকায় মটাস করে ভেঙে যায়– কমপাউন্ড ফ্র্যাকচার। বুড়ি মোটামুটি নীরবে তা সহ্য করলেও মনে হয় সুযোগের অপেক্ষায় ছিল– তাই, এক শীতের সকালে চান্স পেয়েই পিসতুতো টাইপ ভাইয়ের হাত ধরে ‘সবাই যাচ্ছে’ বলে কন্ডাক্টেড ট্যুরের বাসে চেপে বৃন্দাবনের দিকে পালিয়ে যায়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গোড়াতেই বলেছিলাম, রুলি মানুষটা নরখাদক টাইপ হলেও এমনিতে যাকে বলে ‘গুড গার্ল’। অতঃপর, নগার অজ্ঞাতবাসের খবর চাউর হওয়ার পর যখন এলাকার মানুষ রোজই ওকে নানা সময়ে সুযোগসুবিধা মতো এসে পিটিয়ে যাচ্ছে, তখন রুলির ওকে ভালো লেগে যায়। বিয়ের প্রস্তাব রুলি কীভাবে দিয়েছিল, নগা কোন অবস্থায় তা অ্যাকসেপ্ট করে, সে সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায়নি। অনেকেই মনে করে প্রাণে বাঁচতে নগাই ওকে বিয়ের অফার দেয়– যারা কোনও না কোনও সময়ে রুলির হাতে ঠেঙানি, বা আহ্লাদের প্রকাশ স্বরূপ ‘গালটেপা’ ‘পিঠচাপড়ানি’ ইত্যাদি খেয়েছে, তাদের কাছে এই ধারণাটি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও তর্কাতীত প্রমাণ পেশ করার উপায় ছিল না। শোনা যায়, নগার মা গোটা বিষয়টা জানত। তবে রুলি নাকি বিয়ের পর শাশুড়ি ঠাকরুনের পায়ে ঠকাস করে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে গেছিল। ইমপ্যাক্টের ইন্টেনসিটি কন্ট্রোল করতে না পারার ফলে বুড়ির ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের হাড় রুলির কপালের ঠোকায় মটাস করে ভেঙে যায়– কমপাউন্ড ফ্র্যাকচার। বুড়ি মোটামুটি নীরবে তা সহ্য করলেও মনে হয় সুযোগের অপেক্ষায় ছিল– তাই, এক শীতের সকালে চান্স পেয়েই পিসতুতো টাইপ ভাইয়ের হাত ধরে ‘সবাই যাচ্ছে’ বলে কন্ডাক্টেড ট্যুরের বাসে চেপে বৃন্দাবনের দিকে পালিয়ে যায়। তা সেও বহুকাল আগেকার কথা। নগা এবং রুলি স্টেশনের একপাশে নিরুদ্দেশ শাশুড়ির নামে চায়ের দোকান দেয়– প্রভা টি। ব্যবসা মন্দ হত না। কারণ, রুলি কাউকে হাসিমুখে চা খেয়ে যেতে বললে তার অত দম ছিল না যে, সে আহ্বানে সাড়া না দিয়ে সমুখপানে এগিয়ে যাবে। তাছাড়া রুলি যাকে বলে ‘ড্যামজেল ইন ডিসট্রেস’, ওর দোকান পেট্রোনাইজ করাটা ছিল এলাকার মানুষের কর্তব্য।
নগার বিয়ে রুলির সঙ্গে পাকা ঘোষণা হওয়া মাত্র নবাদা খোট্টার দোকানে হাজির– একেবারে এক ঘণ্টার মধ্যে। লোকে বলে বগলামুখী হাইস্কুলের বাংলার দিদিমণি প্রতিভাদির বাড়িতেই নাকি গোটা সময়টা লুকিয়েছিল– আর সেই অবসরেই প্রেম। নবাদা প্রেমে পড়েছিল শুধু তাই নয়, প্রতিভাদির সঙ্গে হেসে কথা বলছে, মশকরা করছে, চায়ের কাপ হাতে নেওয়ার সময় বাই মিসটেক প্রতিভাদির আঙুল ছুঁয়ে ফেলে ‘আভি না যাও ছোড় কর’ গাইছে গুনগুন করে ইত্যাদি প্রভৃতিও নাকি সকলেই দেখেছে। দু’জনে একসঙ্গে সানগ্লাস চোখে বাসে চেপে শিলিগুড়ি গিয়ে আর্টফিল্ম দেখে এল যে রবিবার, তারপর থেকেই আর কোনও লুকোছাপা রইল না। যাদবজিই প্রথম বললে ওদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করে হবে– ‘তবে খাওয়াবে বলেছে।’ সকলে খুশি। ভটচাজ জেঠু ফস করে একটা লিস্টি বানিয়ে ফেলল– ‘শেষ পাতে রাবড়িই হোক।’ তা শুনে অবনীদার কোনও প্রয়োজন ছিল না ‘ছোটলোক বিহারিদের খাবার’ বলে নাক সিঁটকানোর। পিতাম্বর রায় অবিশ্যি মাঝখান থেকে ‘তাতে তো তোর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়’ বলে বিষয়টিকে বোঝা না-বোঝার মাঝে ঝুলিয়ে নাকের সামনে খবরের কাগজ মেলে তিন মাসের জন্য নীরব হয়ে গেলেন। পরদিন দুপুরের মধ্যে এলাকা দু’ভাগ, যে কোনও সময় দু’চারটে খুন হওয়ার আশঙ্কা, আর বিয়েতে খেলাম দই-রসগোল্লা। তবে সে সময়টাই ছিল ওরকম। কারও মনে কোনও প্রকার ভয় ছিল না কি না, তাই।
(সমাপ্ত)
…ভয়বাংলা-র অন্যান্য পর্ব…
ভয়বাংলা পর্ব ২৩: মানিকদা তার অবিবাহিত বোন রুলিকে নবাদার গলায় ঝোলাবার প্ল্যান আঁটছিল
ভয়বাংলা পর্ব ২২: কখনও শিকারে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে নবাদা একরকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল
ভয়বাংলা পর্ব ২১: তোমরা কথায় কথায় এমন পুলিশ ডাকো কেন?
ভয়বাংলা পর্ব ২০: ‘মালদা এলে ডেকে দেবেন দাদা, আমার আবার ভোরবেলাতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা ওব্বেস’
ভয়বাংলা পর্ব ১৯: দর্শকরা দ্রুত ঐতিহাসিক থেকে পৌরাণিকে সুইচ করতে পারত
ভয়বাংলা পর্ব ১৮: বাঙালি কি আদৌ জানে তালেগোলে সে কী হারাইয়াছে?
ভয়বাংলা পর্ব ১৭: বাঙালি জীবনের ভেজিটেরিয়ান হওয়ার ভয়
ভয়বাংলা পর্ব ১৬: বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও যারা রাবীন্দ্রিক বাংলায় কথা কইত, তারা মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৫: গুষ্টিসুখের প্লেজারই অর্জি-নাল সিন
ভয়বাংলা পর্ব ১৪: কৈশোরে জাতের খোঁজ কেউ কখনও নিয়েছে বলে মনে পড়ে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৩: নবনাৎসিগুলোর কাছে আর একটু সফিস্টিকেশন এক্সপেক্ট করেছিলাম মশাই
ভয়বাংলা পর্ব ১২: রাজসভায়, থুড়ি, লোকসভায় কেবল পাশা-খেলাটুকু হবে
ভয়বাংলা পর্ব ১১: আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে
ভয়বাংলা পর্ব ১০: ভূতেরাও ঢিল ছোড়ে, মানুষও রেডি রাখে পাথরের স্টক
ভয়বাংলা পর্ব ৯: চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’-এর খুদে স্টোনম্যান জানলার শার্শি ভেঙেছিল খাবার জুটবে বলেই
ভয়বাংলা পর্ব ৮: ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা লোকেদের সংখ্যা আশ্চর্যরকম বৃদ্ধি পেল
ভয়বাংলা পর্ব ৭: প্রত্যেকেরই মনে হতে থাকে সে-ই অদৃশ্য ঘাতকের একমাত্র টার্গেট
ভয়বাংলা পর্ব ৬: হাতের নাগালে একখানা জলজ্যান্ত বন্দুক চালানো লোকই ছিল সহায়
ভয়বাংলা পর্ব ৫: স্টোনম্যানের একটুকরো খুনে স্টোন বাড়িতে থাকলেই সর্বরোগ থেকে মুক্তি!
ভয়বাংলা পর্ব ৪: ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর
ভয়বাংলা পর্ব ৩: বাঙালি ভূত-পেতনিরাও ভারি শুচিবায়ুগ্রস্ত!
ভয়বাংলা পর্ব ২: তবু সে দেখিল কোন ডাইনোসর!
ভয়বাংলা পর্ব ১: বাঙালির ভূতের ভয় যেন উত্তম-সুচিত্রার মতোই সাংস্কৃতিক