জয়দেব বসুর একটা আলাদাই গ্ল্যামার তখন। যেমন দেখতে, তেমন রোয়াব। শঙ্খবাবুকে মুখের ওপর আর কোন কবি বলতে পেরছে– এই কবিতাটা হয়নি স্যর। সুনীল-শঙ্খর কাছে এমন অনন্ত প্রশ্রয় আর কোনও অনুজ কবি পেয়েছে বলে জানা নেই। সেই ঠোঁটকাটা জয়দেব আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, অনিন্দ্য কেন তোর মনে হচ্ছে অ্যাঙ্কর হিসেবে আমি স্পেশাল? জয়দেব আমার গেলাসীয় বন্ধু, সুখ-দুঃখের প্রচুর সময় কেটেছে হাত-পা ছুড়ে তর্ক জুড়ে।
২৭.
কুয়াশাকুহক শীতস্বপ্ন ছেড়ে তপ্ত কড়াইয়ের মধ্যে এসে পড়ল জীবন। পিকনিক থেকে ফিরে পরদিন অফিস যাওয়ার সময় ঠিক যেমন লাগে। ঋতুদার উপহার দেওয়া বনভোজন শেষ, এবার নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার পালা। বাবা-মা ওই সময়টা দিল্লিতে, বোনের কাছে। আমি দু’বেলা উপলের বাড়ি খেয়ে চরকিপাক খাচ্ছি। চাকরি ছেড়ে দেওয়াটা সহজ হল না। ফলে একবুক অনিচ্ছা ঠেলে সেই তারার অফিস ছুটতে হল। কৌস্তভী, রেশমীরা আমার দোনামোনা দশা বুঝতে পারছিল। ওরাও পরামর্শ দিল, চাকরি ছাড়িস না, জয়েন করে যা। মওকা বুঝে অফিস একটু দরাদরি করল। যে মাইনে পেতাম তার চেয়ে কম টাকায় পুনর্মুষিক পোস্টে যোগ দিলাম।
সে সময় তারায় যোগ দিয়েছে অনন্যাদি মানে অনন্যা চক্রবর্তী। সুমনের গানে যার কথা শুনেছি আমরা– ‘আমার দাবি রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনের নাম পাল্টে যাক, নতুন নাম হোক অনন্যার প্রতিরোধ’। সুচিত্রা ভট্টাচার্য লিখেছেন ‘দহন’ তাকে নিয়েই, যা নিয়ে ঋতুদার দ্বিতীয় ছবি। ফলে অনন্যাদির সঙ্গে কাজ করব– সেটা বাড়তি ভালোলাগা ছিল। নতুন প্রোগ্রামের প্ল্যানিং শুরু করলাম। কলকাতা শহর নিয়ে। নাম দিলাম ‘আমার শহর’। অনন্যাদি প্রোডিউসার, আমি ডিরেক্টর। এই প্রোগ্রামটা করার সময় অনন্যাদি যা সাহায্য করেছিল, ভুলব না কখনও। খুব ভালো একটা বন্ধুত্বের শুরুয়াত হল, কাজটায় ডুবে গেলাম। ‘আমার শহর’ গানটা বানানো হয় এজন্যই। মনে আছে, উত্তর কলকাতার বাড়ির ছাদে একটা কাঠের গিটার হাতে সুরজিৎ আর আমি মিলে গান মকশো করছি। টাইটেলটা গেয়েছিল উপল। পরে অ্যালবামের জন্য যখন রেকর্ড করা হয়, তখন আমি গেয়েছিলাম। ‘আমার শহর’ গানটায় একটা ভিডিও তোলা হয়েছিল বেশ খেটেখুটে। কোনও পারমিশন ছাড়াই তখন আমরা কলকাতা শুট করতাম। এই শুটিংয়ে আমার শাগরেদ ছিল গ্রাফিক্স-এর দেবজ্যোতি। আমরা চলন্ত চক্ররেলের ড্রাইভারের কেবিনের বাইরের একটা খাঁচা থেকেও অনেকটা তুলেছিলাম। খুব সুন্দর এডিট করেছিল ইন্দ্র। কলকাতা শহরের সঙ্গে মানানসই কাকে অ্যাঙ্কর করা যায়, এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা চলছিল। শেষমেশ আমি জয়দেবকে ধরি। ও তো আমার প্রস্তাব শুনে এমন তুতলে গেল, পুরো কথাটা শেষও করতে পারল না। জয়দেব বসুর একটা আলাদাই গ্ল্যামার তখন। যেমন দেখতে, তেমন রোয়াব। শঙ্খবাবুকে মুখের ওপর আর কোন কবি বলতে পেরেছে– এই কবিতাটা কিছু হয়নি স্যর। সুনীল-শঙ্খর কাছে এমন অনন্ত প্রশ্রয় আর কোনও অনুজ কবি পেয়েছে বলে জানা নেই। সেই ঠোঁটকাটা জয়দেব আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, অনিন্দ্য কেন তোর মনে হচ্ছে অ্যাঙ্কর হিসেবে আমি স্পেশাল? জয়দেব আমার গেলাসীয় বন্ধু, সুখ-দুঃখের প্রচুর সময় কেটেছে হাত-পা ছুড়ে তর্ক জুড়ে। ফলে বারবিকিউ-তে সেদিন খেপে গিয়ে বলেছিলাম, আরে যা বলছি করো না চুপ করে, বিশ্বের আর কোনও প্রোগ্রামে তোতলা অ্যাঙ্কর দেখেছ কখনও? খুব খারাপ ভাবে বলেছিলাম। বন্ধু তো, তাই মনে করেনি কিছু। জয়দেব উত্তেজিত হলে ওর কথা আটকে যেত, আমার ঘোরতর অন্যায় হয়েছিল ওভাবে সেটা বলায়। ওই সন্ধ্যায় শুধু আমরা ছিলাম। আর আমার শহর নিয়ে কিছু লাল-নীল স্বপ্ন।
ক্যামেরায় আগাগোড়া ছিল দেবলীনা। এই মুহূর্তে ফিল্মমেকার, সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে যার আন্তর্জাতিক খ্যাতি। শুরুর দিনগুলোতে একে অপরকে জড়িয়ে জাপটে বেশ রোদ্দুর কুড়িয়েছিলাম আমরা। এই সব ঘটনা যখন ঘটছে, দেবাশিস তারা ছেড়ে দিয়ে ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ নামের একটা কোম্পানি যোগ দিল। আরও কিছুটা ফাঁকা হল তারা। আমার শহর অনুষ্ঠানটা সেই সময় ব্যস্ত থাকতে সাহায্য করেছিল আমায়। জোরকদমে শুরু হয়ে গেল শহর কলকাতা নিয়ে শুটিং। যেহেতু এটা কালচারাল ম্যাগাজিন প্রোগ্রাম, সারা সপ্তাহ ধরেই একটু একটু শুটিং হত। অ্যাঙ্কারিংগুলো পরে রেকর্ড করা হয় ময়দানের ধারেকাছে। অলস দুপুর, রং শরবতের গাড়ি, গ্যাসবেলুন, একাকী ঘোড়া আবহে রেখে কত ভুলভাল টেক যে জয়দেব দিত। এ প্রোগ্রামের একটা বিভাগ, আচমকা, খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বেশিরভাগই দেবুর লুকোনো শুট। টাক, প্রেম, গরু, রাস্তার খাবার– এগুলোর মন্তাজ একটা গান দিয়ে করা হত। টাকের ভিডিওটার সঙ্গে ‘যাক যা গেছে তা যাক’ গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
ঋতুদাকে এর মাঝে বেশ কয়েকবার ফোন করেছি। এমনি গল্প করার জন্য নয়, ‘তিতলি’র জন্য একটা পারিশ্রমিক ঠিক হয়েছিল, তার একটা অংশ অ্যাডভান্স হিসেবে পেয়েছি, বাকিটা কবে পাব জানতে চেয়ে ফোন করা। কিন্তু কিছুতেই লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারছি না। ঋতুদা ফোন করলেই তারার হালচাল জিজ্ঞেস করত।
একদিন বলল, ‘তুই কি আনন্দলোকে একটা লেখা লিখতে পারবি?’
খুব খুশি হলাম শুনে। ‘কী বিষয় বলো?’
‘শচীন দেব বর্মণ ও রাহুল দেব বর্মণকে নিয়ে।’
‘তোমাদের লাইব্রেরিতে একটু পড়াশুনা করতে দেবে?’
ঋতুদা শক্তিবাবুকে বলে রেখেছিল। শক্তিবাবুর মতো দক্ষ লাইব্রেরিয়ান আর দেখিনি। সে সময় আনন্দবাজার প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের রাস্তার ওপারে অস্থায়ী অফিস। তার একবছর আগে ভয়ানক আগুন লেগেছিল পুরনো অফিসে। শক্তিবাবু এই মেকশিফট অফিসেও কী সুন্দর করে লাইব্রেরিটা সাজিয়ে তুলেছিলেন। লেখালেখির কাজ শুরু করলাম মন দিয়ে। জীবনে এই প্রথম আনন্দলোকের কভার স্টোরি লিখছি। ঋতুদা খুব খুশি হয়েছিল লেখাটা পড়ে। ভাবলাম এই মওকায় জিজ্ঞেস করি ‘তিতলি’র বকেয়ার কথা। শেষমেশ আর জিজ্ঞেস করে ওঠা হয়নি। ফলে টাকাটাও আর পাইনি কোনও দিন।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?