ঝরা পাতার মতো একটা ছবি এসে পড়ে জ্যোতির পায়ের কাছে। জ্যোতি ছবিটা তুলে নিয়ে দেখে! অবাক হয়ে বলে, কবে এঁকেছি এই ছবি, কলমের স্কেচ! মনে নেই, কবে এঁকেছি। কিচ্ছু মনে পড়ছে না। কিন্তু ছবির প্রতিটি রেখা, আঁচড় আমার, আমারই কলমের। জ্ঞানদা ছবিটা হাতে নেয়। দেখে। কাদম্বরীর মুখের একটি পাশ। আর তার খোঁপা! পিছন থেকে দেখা কাদম্বরী। সে কিছু বলে না।
৩২.
একটা ঘোরের মধ্যে এই চিঠি লিখছি। বলতেও পারো, এ এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন, নাইটমেয়ার!
রবির বিয়ের আড়াই মাসের মধ্যে কাদম্বরী আত্মহত্যা করল। আমাদের সামনে সে একটু-একটু করে ঘুমিয়ে পড়ছে। ডাক্তার বলেছে, ওকে জাগিয়ে রাখতে হবে। ও ঘুমিয়ে পড়লে, সে ঘুম আর ভাঙবে না। মেয়েটা, আমার বউ, তাল তাল আফিম খেয়েছে। কোথায় পেল এত বিষ। দিল কে?
রবি আর আমি দক্ষিণের বারান্দায় কাদম্বরীকে টেনে হিঁচড়ে হাঁটানোর চেষ্টা করছি। একটা পাথরের দেহ। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। চোখ বন্ধ। নিশ্বাস ক্ষীণ। হাত-পা প্রাণহীন ঠান্ডা। আমরা তবু হিঁচড়ে টেনে তাকে হাঁটিয়ে চলেছি।
কাদম্বরী এখন সত্যি পাথর হয়ে গেছে। এক ভারি লম্বা কালো পাথরের চাঁই। আর রবি ভ্যানিশ! আর আমি প্রাচীন সিসিফাস। গ্রিক পুরাণের সেই ক্লান্তিহীন তবু ক্লিশ্যামান সিসিফাস! যার গল্প তোমাকে বলেছি।
আমি সিসিফাস। কাদম্বরী পাথর হয়ে গেছে। আমি তাকে ঠেলতে-ঠেলতে তুলে নিয়ে যাচ্ছি পাহাড়চূড়ায়। গ্রিসে নয়। রাচির এক পাহাড়ে। এই দৈববাণী শুনেছি আমি, যদি পাহাড়চূড়ায় পাথর-কাদম্বরীকে থিতু করতে পারি, স্থির করে দিতে পারি তাকে ক্ষণকাল, তার নবজন্ম হবে!
কিন্তু পাথর তো কিছুতেই দাঁড়াচ্ছে না পাহাড়-শীর্ষে। পিছলে নেমে যাচ্ছে একেবারে পাহাড়ের নীচে। আবার তাকে ঠেলে তুলছি বউঠান। আমি একা। আর কেউ নেই।
কিন্তু একবার, শুধু একটিবার, দাঁড়িয়ে পড়ল সেই পাথর!
পাহাড়ের মাথায়। যেন পৃথিবীর বুকে মাধ্যাকর্ষণের টান প্রাণহীন। নিথর। পাথর দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মাথায়।
…চিঠি এখানে শেষ, যেন আদ্দেক অসমাপ্ত।
এরপর চোখের সামনে ঘটল এক অবিশ্বাস্য বিস্ময়! সেই বিপুল পাথরের শরীরটা হয়ে উঠল এক কালো কুঁড়ি। আর কুঁড়ি ফুটে বেরিয়ে এল একটা ফুল! কালো কুঁড়ির সাদা ফুল! আর ফুলটা তার পাপড়ি মেলতে-মেলতে হয়ে গেল একটা বাড়ি!
–মেজবউঠান দেখে যাও, কী হয়েছে। দেখে যাও মিরাকেল আজও ঘটে! তুমি উড়ে এলে, না ছুটে এলে, নাকি নদীর মতো বয়ে এলে, নাকি বাতাস থেকে ঝরে পড়লে! জানিনে কিছুই। শুধু দেখলুম, তুমি চলে এসেছ তোমার পার্কস্ট্রিটের বাড়ি চিরতরে ছেড়ে।
–তুমি এসেছ বউঠান! আমি অবাক হয়ে বলি।
–তুমি অমন প্রাণ থেকে ডাকলে আমি না এসে পারি নতুন! বললে তুমি।
–কথা দাও, আর কোনও দিন ফিরে যাবে না তোমার পার্কস্ট্রিটের মেকি সংসারে, নকল ভালোবাসায়, অসার অস্তিত্বে?
–কোনও দিন না ঠাকুরপো। এই তো তোমার-আমার বাড়ি। পাহাড়-চূড়ায়। সবার ওপরে। সব কিছু থেকে ছিন্ন! ফেরার তো পথ নেই।
–এই নামহারা পাহাড়চূড়ায় আমাদের শেষ আশ্রয়।
–নাম নেই তো কী! নাম দিতে কতক্ষণ?
–কী নাম?
–শান্তিধাম, বলে জ্ঞানদা।
অবাক হয়ে তাকায় জ্যোতিরিন্দ্র।
–আমাদের নামমন্ত্রে সত্য হয়ে ওঠা নব নিলয়, বলে জ্ঞানদা।
জ্ঞানদার হাত ধরে জ্যোতিরিন্দ্র প্রবেশ করে পাহাড়-শীর্ষের শান্তিধামে!
পরের দৃশ্য: জ্ঞানদা আর জ্যোতি পাশাপাশি, পরস্পরকে স্পর্শ করে, নিবিষ্ট এবং উপবিষ্ট শান্তিধামের খোলা অঙ্গনে। সামনে বিস্তৃত দিগন্ত। নীচে, অনেক নীচে, ঘন সবুজ উন্মুক্ত উপত্যকা। সাদা ঝরনার মতো পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে গেছে শান্তিধামে আরোহণ-অবরোহণের সোপানশ্রেণি।
ঝরা পাতার মতো একটা ছবি এসে পড়ে জ্যোতির পায়ের কাছে। জ্যোতি ছবিটা তুলে নিয়ে দেখে! অবাক হয়ে বলে, কবে এঁকেছি এই ছবি, কলমের স্কেচ! মনে নেই, কবে এঁকেছি। কিচ্ছু মনে পড়ছে না। কিন্তু ছবির প্রতিটি রেখা, আঁচড় আমার, আমারই কলমের।
জ্ঞানদা ছবিটা হাতে নেয়। দেখে। কাদম্বরীর মুখের একটি পাশ। আর তার খোঁপা! পিছন থেকে দেখা কাদম্বরী। সে কিছু বলে না।
–শান্তিধামে শুধু একটিই ছবি থাকবে। এই ছবিটা। আমার শোওয়ার ঘরে।
–ছবিটা কি রাখতেই হবে শান্তিধামে।
–কেন নতুন?
–পরে বলছি। এখন এসো পাহাড় কিনারে।
ওরা, জ্ঞানদা আর জ্যোতি, পাহাড়ের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। জ্যোতি বলে, দেখতে পাচ্ছ মেজবউঠান পাহাড়ের নীচে ওটা কী?
–আরও একটা বাড়ি! ছিল না তো! এল কোথা থেকে?
–সে-প্রশ্ন কোরো না। বলতে পারো, বাড়িটা চাইছে কী?
–কী ইচ্ছে ফুটে উঠেছে ওর সারা শরীরে?
জ্ঞানদা অনেকক্ষণ তাকিয়ে বাড়ির দিকে। বাড়িটা ধীরে ধীরে জ্ঞানদার চোখের সামনে মস্ত বড় একটা পাখি হয়ে যায়। তার ডানায় উড়ানের তীব্র ইচ্ছে। সারা শরীরে তেষ্টা। পাখিটা উড়ে আসতে চায় শান্তিধামে, নতুনের কাছে, অনুভব করে জ্ঞানদা।
জ্যোতি বলে, বউঠান, তোমার বাড়ি। তুমি থাকবে পাহাড়ের নীচে। আমি থাকব পাহাড়ের ওপরে। তোমার যখন খুশি আসবে আমার কাছে। আমি যখন খুশি যাব তোমার কাছে। দ্যাখো, ওই সাদা সিঁড়ি শেষ হয়েছে তোমারই দুয়ারে। দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে রূপকথায়!
–কিন্তু কাদম্বরীর ছবিটা কি রাখতেই হবে তোমার ঘরে?
–রাখতেই হবে। আর কোনও ছবিই থাকবে না শান্তিধামে।
–তোমার-আমার মাঝখানে এখানেও সে?
–মধ্যবর্তিনী! চিরকালের। ওকে পেরিয়ে নয়। ওর সঙ্গে মিশে, ওর ভিতর দিয়েই আমাদের প্রেম ও মিলন পূর্ণ হবে।
জ্ঞানদা বুঝতে পারে না জ্যোতি কী বলতে চাইছে। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চোখ তুলে বলে ‘মধ্যবর্তিনী’। কী সুন্দর একটি শব্দ।
–রূপকথায় থাকে না। বাস্তবে থাকে। হয়তো রবি একদিন লিখবে এমনই কাউকে নিয়ে গল্প। নাম দেবে, মধ্যবর্তিনী!
জ্ঞানদা তাকায় ছলছলে চোখে জ্যোতির দিকে। পাহাড়ের বাতাস দমকা ধাক্কায় উড়িয়ে দেয় আঁচল, ফিরিয়ে আনার কোনও তাগিদ নেই জ্ঞানদার।
জ্যোতি বলে ঘরে চলো।
জ্ঞানদা জ্যোতিকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে।
পুনশ্চ: আজও আছে রাঁচির মোরাবাদি পাহাড়-চূড়ায় ‘শান্তিধাম’, জ্যোতিরিন্দ্রর বাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বসতে পারবেন সেই প্রাঙ্গণে, এখন যেখানে জ্যোতি আর জ্ঞানদা নিবিড় আশ্লেষে পরস্পরকে জড়িয়ে! জ্যোতিরিন্দ্রর ঘরে কাদম্বরীর সেই ছবিও আছে!
(শেষ)
…পড়ুন মেজবউঠাকরুণ-এর অন্যান্য পর্ব…
মেজবউঠাকরুণ ৩১: রবির প্রতিভার মূল্য আমাদের সবাইকে দিতে হবে– বললেন জ্যোতিরিন্দ্র
মেজবউঠাকরুণ ৩০: যতটা গড়িয়েছে রবির সঙ্গে কাদম্বরীর সম্পর্ক, তার কতটুকু জ্যোতিরিন্দ্র আন্দাজ করতে পারে?
মেজবউঠাকরুণ ২৯: দুর্গার মুখ আর এস্থারের মুখ প্রায় হুবহু এক
মেজবউঠাকরুণ ২৮: দেবদূতের সঙ্গে পাপের আদানপ্রদান
মেজবউঠাকরুণ ২৭: কাদম্বরী শুধুই রবির, আর কারও নয়
মেজবউঠাকরুণ ২৬: আমারও খুব ইচ্ছে বউঠান, পাঁচালির দলে ভর্তি হয়ে গ্রামে গ্রামে মনের আনন্দে গেয়ে বেড়াই
মেজবউঠাকরুণ ২৫: জ্ঞানদা প্রথম মা হল একটি মৃত সন্তান প্রসব করে!
মেজবউঠাকরুণ ২৪: কাদম্বরীকে ‘নতুন বউঠান’ বলে উঠল সাত বছরের রবি
মেজবউঠাকরুণ ২৩: ঠাকুরপো, তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুমি ছাদে একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে!
মেজবউঠাকরুণ ২২: কাল থেকে আমিও রবির মতো একা হয়ে যাব না তো ঠাকুরপো?
মেজবউঠাকরুণ ২১: জ্ঞানদার মধ্যে ফুটে উঠেছে তীব্র ঈর্ষা!
মেজবউঠাকরুণ ২০: স্বামী সম্বন্ধে জ্ঞানদার মনের ভিতর থেকে উঠে এল একটি শব্দ: অপদার্থ
মেজবউঠাকরুণ ১৯: কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে তোলপাড় নিয়ে আসছে
মেজবউঠাকরুণ ১৮: নতুনকে কি বিলেত পাঠানো হচ্ছে?
মেজবউঠাকরুণ ১৭: চাঁদের আলো ছাড়া পরনে পোশাক নেই কোনও
মেজবউঠাকরুণ ১৬: সত্যেন্দ্র ভাবছে জ্ঞানদার মনটি এ-বাড়ির কোন কারিগর তৈরি করছে
মেজবউঠাকরুণ ১৫: জ্ঞানদার কাছে ‘নতুন’ শব্দটা নতুন ঠাকুরপোর জন্যই পুরনো হবে না
মেজবউঠাকরুণ ১৪: জ্যোতিরিন্দ্রর মোম-শরীরের আলোয় মিশেছে বুদ্ধির দীপ্তি, নতুন ঠাকুরপোর আবছা প্রেমে আচ্ছন্ন জ্ঞানদা
মেজবউঠাকরুণ ১৩: বিলেতে মেয়েদের গায়ে কী মাখিয়ে দিতে, জ্ঞানদার প্রশ্ন সত্যেন্দ্রকে
মেজবউঠাকরুণ ১২: ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে
মেজবউঠাকরুণ ১১: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ১০: অসুস্থ হলেই এই ঠাকুরবাড়িতে নিজেকে একা লাগে জ্ঞানদানন্দিনীর
মেজবউঠাকরুণ ৯: রোজ সকালে বেহালা বাজিয়ে জ্ঞানদার ঘুম ভাঙান জ্যোতিঠাকুর
মেজবউঠাকরুণ ৮: অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা
মেজবউঠাকরুণ ৭: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ৬: পেশোয়াজ অন্দরমহল আর বারমহলের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল
মেজবউঠাকরুণ ৫: বাঙালি নারীশরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান
মেজবউঠাকরুণ ৪: বৈঠকখানায় দেখে এলেম নবজাগরণ
মেজবউঠাকরুণ ৩: চোদ্দোতম সন্তানকে কি ভুল আশীর্বাদ করলেন দেবেন্দ্রনাথ?
মেজবউঠাকরুণ ২: তোমার পিঠটা কি বিচ্ছিরি যে তুমি দেখাবে না বউঠান?
মেজবউঠাকরুণ ১: ঠাকুরবাড়ির বউ জ্ঞানদাকে ঘোমটা দিতে বারণ দেওর হেমেন্দ্রর
যেদেশে ক্রিকেট ধর্ম, সেই ক্ষেত্রয় শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ও বাঙালি প্লেয়ার হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে কত শুচিবাই, কত ট্যাবু, কত অসূয়া, কত সংস্কার ও তার জগঝম্পের ইতি না ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গবেষণা করলে ক্রিকেটের এক অন্যতর সামাজিক বীক্ষণ কি উঠে আসবে না?