সোভিয়েত আমলে দোকানে পণ্যদ্রব্যের বৈচিত্র্য না থাকলেও অনেকখানি জায়গা জুড়ে তৈরি হত এক-একটি দোকানঘর– হয়তো ক্রেতাদের লাইনে দাঁড়াতে সুবিধা হবে বলে। এখন বেসরকারিকরণের ধাক্কায় সেই সুপারমার্কেট ধরনের দালানগুলি কমার্শিয়াল শপ-এর ভোগে লাগছে। একটি-দু’টি করে দোকানঘরের এককোণে ঠাঁই নিতে নিতে শেষকালে পুরো জায়গাটারই দখল নিয়ে ফেলছে। গত একবছর হল ছাঁটাই হতে হতে যে গুটি কয়েক সরকারি দোকান কর্মচারী বহাল ছিল, তারাই কো-অপারেটিভের নাম করে সেগুলি হস্তগত করে কমার্শিয়াল শপকে ভাড়া দিয়ে দিচ্ছে। দু’-পক্ষেরই লাভ– নতুন দোকানগুলির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে কো-অপারেটিভ, তথা সম্পত্তির মালিকরা। জিনিসপত্রের দামেরও কোনও নিশ্চয়তা নেই।
৬৬.
অসংগতি
মস্কো, ১১ আগস্ট ১৯৯২
…আমলা মহোদয়
ততক্ষণে হাতে নিয়েছেন
লাল চামড়ায় মোড়া
আমার পাসপোর্টখানা
হাত পড়ে গেছে
বুঝি-বা বোমায়
কাঁটাভরা কোনো শজারুর গায়ে
যেন কোনো ক্ষুর–
দুধারেই যার ধার।
যেন হাত পড়ে গেছে
গোটা বিশ হুলধারী
পাঁচ হাত লম্বা
গোখরো সাপের গায়ে।
এটা পড়ো,
পড়ে হিংসেয় মরো
সোভিয়েত দেশের আমি
এক নাগরিক।
–১৯২৯ সালে ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি লিখেছিলেন সোভিয়েত পাসপোর্টের ওপর কবিতা।
সোভিয়েত পাসপোর্ট। বাইরের মলাট আগাপাশতলা লাল, ওপরে সোনার জলে ছাপা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতীকচিহ্ন কাস্তে-হাতুড়ি, ভেতরেও সেই রাষ্ট্রীয় প্রতীকচিহ্ন, তার তলায় একপৃষ্ঠায় অধিকারীর নাম, জন্ম তারিখ, জন্মস্থান, ইস্যুর তারিখ, স্থান, মেয়াদ ইত্যাদি– একপৃষ্ঠায় রুশিতে, অন্য পৃষ্ঠায় ইংরেজিতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাপ।
১৯২৯ সালের পাসপোর্টের চেহারা নয়, একবছর আগেরকারও নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে যায়, তারও অনেক পরে। ১৯৯২ সালের জুলাই মাসে ইস্যু করা ছাড়পত্র– তারও এই চেহারা। যে দেশের কোনও অস্তিত্ব নেই তার পাসপোর্ট? বিদেশের অনেক আমলার চোখ কপালে উঠে যাবে একেবারে অন্য কারণে: তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও রাশিয়া বা রুশ ফেডারেশন নামটির সন্ধান মিলবে না এর মধ্যে। মেয়াদ ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। আবারও চমক।
………………………………………
আজকের রাশিয়ায় অন্তত যত্রতত্র যা চোখে পড়ছে, তা কেবলই অসংগতি আর অসংগতি। মস্কোর দক্ষিণ অঞ্চল থেকে লেনিনস্কি প্রস্পেক্ত (লেনিন এভিনিউ শহরের দীর্ঘতম পথ) ধরে বাসে যেতে যেতে চোখে পড়ে ফুলভারের মাঝখানে নিরেট ইস্পাতের তৈরি পাঁচ-ছ’তলা উঁচু এক বিশাল মনুমেন্ট– সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই পরিচিত প্রতীক চিহ্ন– সঙ্গে বিরাট বিয়াট ইস্পাতের হরফে লেখা স্লোগান– সোভিয়েত ইউনিয়ন– শান্তির রক্ষাদুর্গ, ডানপাশে এককালের জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (পূর্ব জার্মানি) দূতাবাসের দালান– অনেক দিন হল অখণ্ড জার্মানির সম্পত্তি।
……………………………………….
অভ্যন্তরীণ পাসপোর্ট নামে এদেশে প্রত্যেক বয়স্ক নাগরিকের জন্য আবহমানকাল ধরে যে-পরিচয়পত্র চলে আসছে, তাও সোভিয়েত ইউনিয়নের। যে দেশের কোনও অস্তিত্ব নেই, তার নাগরিক! সবই লাল– যেমন ভেতরে, তেমনই বাইরে– অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দুই পরিচয়পত্রেরই এই রং– এমনকী, পরবর্তীকালে প্রতীকচিহ্ন এবং দেশের নাম পাল্টালেও ওই লাল রং থেকেই গেল। অবশ্য এতে আপত্তি করার কোনও কারণ নেই। রুশিরা আবহমানকাল ধরে লালের ভক্ত। লাল শুধু বিপ্লবের রং নয়, রুশিদের কাছে লাল এক অর্থে সুন্দরও বটে। রেড স্কোয়ারের অর্থই সুন্দর স্কোয়ার, তার রং লাল, ক্রেমলিনেরও তাই। সেই নাম, সেই রং জারের আমল থেকেই চলে আসছে। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।
আজকের রাশিয়ায় অন্তত যত্রতত্র যা চোখে পড়ছে, তা কেবলই অসংগতি আর অসংগতি। মস্কোর দক্ষিণ অঞ্চল থেকে লেনিনস্কি প্রস্পেক্ত (লেনিন এভিনিউ শহরের দীর্ঘতম পথ) ধরে বাসে যেতে যেতে চোখে পড়ে ফুলভারের মাঝখানে নিরেট ইস্পাতের তৈরি পাঁচ-ছ’তলা উঁচু এক বিশাল মনুমেন্ট– সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই পরিচিত প্রতীক চিহ্ন– সঙ্গে বিরাট বিয়াট ইস্পাতের হরফে লেখা স্লোগান– সোভিয়েত ইউনিয়ন– শান্তির রক্ষাদুর্গ, ডানপাশে এককালের জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (পূর্ব জার্মানি) দূতাবাসের দালান– অনেক দিন হল অখণ্ড জার্মানির সম্পত্তি। আর একটু এগোলে বাঁ-ধারে হাভানা রেস্তোরাঁ– উঠে গেছে রাশিয়ার মাটি থেকে ‘হাভানা’ নামটি– আছে শুধু রেস্তোরাঁ লেখাটা। অথচ বাস্তবকে উপেক্ষা করে উদ্ধত ভঙ্গিতে মাথা তুলে এখনও দাঁড়িয়ে আছে ওই মনুমেন্টটা। ওই স্লোগান। সেনাবাহিনীতে, পার্লামেন্ট ভবনে, এমনকী যে সংবিধান আদালতে কমিউনিস্ট পার্টির বিচার চলছে সেখানেও বিচারকমণ্ডলীর মাথার ওপর ঝুলছে কাস্তে-হাতুড়ি প্রতীকচিহ্ন। গত মাসের শেষে মস্কোর প্রসিকিউটর অফিস থেকে আদালতের যে-কাগজ আমার স্ত্রী পেয়েছে, সেখানেও ওই ছাপ এবং লেখা– সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রসিকিউটর অফিস।
রাশিয়ার টাঁকশাল থেকে ছ’টি মুদ্রার একটি সেট বেরিয়েছে– প্রতিটি এক রুবল মানের– বার্সেলোনা অলিম্পিক্সের স্মারক মুদ্রা। সেটটার সরকারি দাম ১৪৫০ রুবল– বাইরে অন্তত চারগুণ বেশি। মুদ্রার গায়ে বড় বড় অক্ষরে মুদ্রিত সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর সেই পরিচিত প্রতীকচিহ্ন। তবে এখানে সরকারকে একটি চালাকি খাটাতে হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে বাজারে ছাড়া হলেও মুদ্রার গায়ে প্রবর্তনের সময় মুদ্রিত হয়েছে ১৯৯১ সাল। কিছু বলার নেই– তখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল।
এসবই প্রতীকধর্মী। মনে করিয়ে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও দেশের মানুষ মানসিকতার দিক থেকে সেখান থেকে খুব একটা দূরে নেই। সোভিয়েত সমাজের ওপর আধুনিক বাজার অর্থনীতি চাপানোর যত চেষ্টাই হোক-না-কেন, পরিবর্তনের তেমন সুফল ফলছে কোথায়? দোকান কর্মচারী থেকে শুরু করে সরকারি আমলা, আইন প্রণয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, বিচারকমণ্ডলী, প্রচার মাধ্যম সকলেরই সেই পুরনো মনোভাব– কাজের ধারা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনি আছে।
দ্রব্যমূল্য অন্তত চল্লিশ গুণ বৃদ্ধি পেলে কী হবে আজও সরকারি দোকানে ক্রেতাকে লাইনে দাঁড়িয়ে জিনিস কিনতে হয়। কারণ? সেই ঘাটতি। পরন্তু আরও কয়েকটি নতুন উপসর্গ– দোকান কর্মচারীর সংখ্যাল্পতা। কাউন্টারে তাড়া তাড়া নোট গুনে এঁটে উঠতে পারছে না– সময় লাগছে অনেক। সরকারি দোকানের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে একই কাউন্টারে মুদির দোকানের সামগ্রী থেকে মনিহারি পর্যন্ত সবই বিক্রি হচ্ছে। কালবিরুদ্ধ হলেও এখনও টিকে আছে সোভিয়েত ব্যবস্থা।
অনিশ্চয়তা
মস্কো, ২৪ নভেম্বর ১৯৯২
স্থিরতা নেই কোথাও আজকের মস্কোর জীবনযাত্রায়। পরিবর্তন দ্রুত চলছে– এত দ্রুত যে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা কঠিন।
মস্কোর পাতাল রেলের গোর্কি পার্ক স্টেশন থেকে বেরিয়ে বিশাল চত্বরটার ওপর ফুলের দোকান। আমার মস্কোবাসের জীবনে বরাবর দেখে অভ্যস্ত। এই পথে কারও সঙ্গে দেখা করতে হলে ওই দোকানের সামনে সাক্ষাৎকারের স্থান নির্দেশ করতাম। সেদিনও এক বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার স্থির করেছিলাম ওই জায়গায়। যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে দেখি ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে বৃত্তাকার সেই কাচের দোকানঘরটা। দু’দিন আগেও সেটা ওখানে ছিল। চত্বরটা ঘিরে এখন খোপ খোপ দোকানপাট আর পসারির মেলা। ভাগ্য ভালো এককালে দোকানটা যেখানে ছিল, তারই কাছাকাছি আন্দাজ করে বন্ধু অপেক্ষা করছিল। সেও অবাক।
সেই একই অঞ্চলে সম্প্রতি আরও একটি পরিবর্তন দেখে আরও বেশি বিস্মিত হয়েছিলাম। ওই ফুলের দোকানের পরেই ছিল একটা সাধারণ শৌচালয়। পেরেস্ত্রৈকার আমলে সেটার আধুনিকীকরণ হয়, মিউজিক সিস্টেমও বসানো হল সেখানে, তবে ঢুকতে গেলে দক্ষিণা দিতে হত। ‘প্রগতি প্রকাশন’ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ওই অঞ্চলে তেমন আর যাতায়াত ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুকাল পরে চত্ত্বর পেরিয়ে সেই শৌচালয়ের দিকে পা বাড়াতে দেখি সেখান থেকে টাটকা রুটির সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। বেসরকারিকরণের সুযোগে কবে যে সেটা বেকারিতে পরিণত হয়েছে তা জানা ছিল না এতদিন।
এমন পরিবর্তন হামেশাই ঘটছে। যে-কিওস্ক থেকে খবরের কাগজ কিনতাম, একদিন সকালে গিয়ে দেখি সেখানে বিক্রি হচ্ছে নানারকম বিদেশি পণ্য– পেপসি, কোক, চকোলেট আরও কত কি। এ তো ভালো! শহরের কোনও কোনও জায়গা থেকে রাতারাতি বেমালুম লোপাট হয়ে যাচ্ছে খবরের কাগজের কিওস্ক। মালিক সকালে এসে দেখে জায়গা ফাঁকা– কে বা কারা খোপটাই সরিয়ে নিয়ে গেছে রাতের বেলায়। রাতারাতি রংচং করে খানিকটা দূরে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে খুলে বসেছে মনিহারি দোকান।
কিয়েভ্স্কি স্টেশনের কাছে বড় দোকানটাতে ঢুকলাম– ভাবলাম যদি চাল-ডাল কিছু পাওয়া যায়। এখানেও ভেতরে ঢুকে অবাক হওয়ার পালা। বিশাল দোকানঘরের মধ্যে দু’টি সারিতে খোপ খোপ দোকান– চটকদার জুতো, হালকা আর কড়া পানীয়। দামি দামি খাদ্যদ্রব্যের সমারোহ– অধিকাংশই বিদেশি, পিলে-চমকানো দাম।
সোভিয়েত আমলে দোকানে পণ্যদ্রব্যের বৈচিত্র্য না থাকলেও অনেকখানি জায়গা জুড়ে তৈরি হত এক-একটি দোকানঘর– হয়তো ক্রেতাদের লাইনে দাঁড়াতে সুবিধা হবে বলে। এখন বেসরকারিকরণের ধাক্কায় সেই সুপারমার্কেট ধরনের দালানগুলি কমার্শিয়াল শপ-এর ভোগে লাগছে। একটি-দু’টি করে দোকানঘরের এককোণে ঠাঁই নিতে নিতে শেষকালে পুরো জায়গাটারই দখল নিয়ে ফেলছে। গত একবছর হল ছাঁটাই হতে হতে যে গুটি কয়েক সরকারি দোকান কর্মচারী বহাল ছিল, তারাই কো-অপারেটিভের নাম করে সেগুলি হস্তগত করে কমার্শিয়াল শপকে ভাড়া দিয়ে দিচ্ছে। দু’-পক্ষেরই লাভ– নতুন দোকানগুলির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে কো-অপারেটিভ, তথা সম্পত্তির মালিকরা। জিনিসপত্রের দামেরও কোনও নিশ্চয়তা নেই। একই চাল সেদিন ছিল ৫৬ রবুল/কিলোগ্রাম, পরদিন ৫৭, অন্য এক প্যাড়ার দোকানে ৬৭, একই দালানের আর এক দোকানে ৭২, একই ব্রান্ডের সিগারেট কোনও দোকানে ৬০, কোনও দোকানে ৯০ রুবল/প্যাকেট।
সরকারি ডাক পরিবহন– সেখানেও নিত্য-নতুন মাশুল নিত্য-নতুন ভাড়া। ডাকমাশুল গত ছয় মাসের মধ্যে চারবার বাড়ল– মোট পাঁচগুণ। পরিবহন ভাড়া পঞ্চাশ কোপেক থেকে এক রুবল হয়েছে গত ছয় মাসে। মাস খানেকের মধ্যে তিন হবে। পাতাল রেলের ভাড়ার জন্য মাত্র কয়েক মাস আগে চালু হয়েছিল পঞ্চাশ কোপেকের বিশেষ ধাতব টোকেন, তা বাতিল করে মাসখানেক আগে চালু হল প্লাস্টিক টোকেন। তাও পাল্টাবে হয়তো। এখন শোনা যাচ্ছে প্লাস্টিক টোকেনের দাম এক রুবলের বেশি পড়ে যাচ্ছে, পড়তায় পোষাচ্ছে না, তাই তার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কোনও কোনও স্টেশনে ঢোকার মুখে একটা লম্বা চোঙার ভেতরে এক রুবলের নোট ফেলে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎশক্তি নিয়ন্ত্রিত প্রবেশপথের গেটে টোকেন ফেলে ঢুকতে গেলে যে বিদ্যুৎশক্তি খরচ হয়, তার সাশ্রয় হল। আদিম প্রথা। কিন্তু আরও একটি স্যুভেনিরের সংখ্যা বাড়ল। ধাতব টোকেনের মতো এটিও একটি স্যুভেনির হয়ে গেল।
কিন্তু সব অনিত্যের মধ্যেও একটিই নিত্য চিরস্থায়ী, যার সঙ্গে বাজারের টিকি বাঁধা– সবুজ ডলার– চিরসবুজ, স্ফীত হতে হতে অতিকায় দানবের আকার ধারণ করে গ্রাস করে ফেলছে রাশিয়ার বাজার, তার ক্ষুধার সঙ্গে তাল রেখে নিত্য বাড়ছে বাজারদর।