আড্ডার শেষে আসল মতলব ফাঁস করল পরমা ও দেবুদা। পরমার একক অ্যালবাম বেরবে। আমি কি ‘যাও ফিরে বৃষ্টি’ গানটা দেব? প্রস্তাবটা শুনে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। তার মানে, ঋতুদার বাড়িতে শোনা গানটা দেবুদার ভালো লেগেছিল? না দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, পরমা এতদিনের বন্ধু! ইনফ্যাক্ট ঋতুদার সঙ্গে প্রথম আলাপও ওরই জন্য।
৩০.
মেঘপিওনের ব্যাগের ভেতর মনখারাপের দিস্তা, মনখারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা।
–ঠিক লাগছে লেখাটা? খুব জুভেনাইল হয়ে যায়নি তো?
এ-কথা কে জিজ্ঞেস করছে আমাকে? খোদ ঋতুপর্ণ ঘোষ! যিনি আগামী সময়ে ব্রজবুলি ভাষাতেও গান রচনা করবেন এবং কালজয়ীর স্বীকৃতি পাবেন। আসলে ঋতুদা হয়তো আমাকে বা চন্দ্রিলকে একটু বেশি ভালো লিরিসিস্ট হিসেবে দেখত, ভরসা করত। এর আগে আমি শুনেছি ঋতুদা টুকটাক লিরিক লিখেছে। তারা-র সুমন্ত্র মিত্র, অসম্ভব সুন্দর গান করে, আনন্দবাজার থেকে দু’জনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক, সেই সুমন্ত্রদার ক্যাসেটের অনেকগুলো গান ঋতুদার লেখা। একজন ডিরেক্টর নিজেই যখন তাঁর ছবিতে গান লেখেন, তাঁর ইমেজারি, শব্দ ব্যবহারের ওজন– বহুলাংশে নির্ভুল হয়। ফলে আমার বলার অপেক্ষা রাখে না গানটা কীরকম হয়েছে। কোথাও একটা অভিমান কাজ করছিল। যখন বলেছে, আর ক’টা দিন ওয়েট করতে পারত না ঋতুদা! বাংলা ছবিতে প্রথম গান– একটা স্বপ্ন তো আমিও বুনতে শুরু করেছিলাম। গলার ভেতরে সেসব খারাপ লাগা কাজ করছিল। তাও যতটা সম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করলাম– সুর হয়ে গিয়েছে?
‘দেবু করেছে একটা, আমার ভালো লেগেছে।’
‘আর গাইবে কে?’
‘শ্রীকান্ত আচার্য গাইবে, এখনও রেকর্ডিং হয়নি।’
অভিমান আরও তীব্র হল। মানে সবই ঠিক ছিল। শুধু আমিই জানতাম না। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ার তাল করছি, সেসময় আবার ‘দেবুদা’ মানে দেবজ্যোতি মিশ্র চলে এল। ঋতুদা অম্লানবদনে বলল, ‘দেবু, অনিন্দ্য একটা গান বানিয়েছে, ওকে বলেছিলাম তো বানাতে, তাই। তুই শুনবি একবার?’
দেবুদা বলল, ‘নিশ্চয়ই, শোনা।’
বাতিল হয়ে যাওয়া গান শোনাতে কার ভাল লাগে? আমার তখন ওখানে আর থাকতেই ইচ্ছে করছে না তো গান গাওয়া! বিরসবদনে শোনালাম। আমার একটা কাজ আছে বলে কেটেও পড়লাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘তিতলি’ মুক্তি পাওয়ার আগে গানটি বাজারে ছাড়া হয়নি। বাংলা সিনেমার প্রথম প্রোমোশনের অস্ত্র হিসেবে গানের গুচ্ছ ভিডিও ছাড়ার তখন চল ছিল না। শ্রীকান্তদা গানটা গেয়েওছিল এত ভালো! দেবুদার সুরও মিশে ছিল পাহাড়ি কুয়াশায় ঝিম ধরা সকাল। ফলে গানটার অবশ্য পরিণতি ছিল হিট। কেবল আমার সঙ্গে গানটার সম্পর্ক দাঁড়াল, প্রেমের প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া বন্ধুর মতো। ফলে যারা আমার কাছ থেকে গানটা চেয়েছিল, দিইনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘তিতলি’ এই ঘটনার মাস তিনেক পর মুক্তি পায়। প্রত্যাশামতোই হিট করে। মিঠুন চক্রবর্তীর লুক ও অভিনয়, কঙ্কনার দারুণ পারফরম্যান্স– কাগজগুলোতেও প্রশংসা সর্বত্র। এর সঙ্গেই জুড়ে থাকা মন্তব্য, লিরিসিস্ট ঋতুপর্ণ একশোয় একশো পাবেন এমন গানের জন্য। আমার বন্ধুরা জানত এ ছবির সহকারী পরিচালক আমি। সিনেমা দেখতে গিয়ে তারা টাইটেল কার্ডে আমার নাম দেখে খুবই উত্তেজিত ছিল। এই অবধি ঠিক আছে, তাদের কেউ কেউ আমায় ফোন করতে শুরু করল, শুরুর গানটা কোনওভাবে জোগাড় করে দিতে পারি কি না। ‘তিতলি’ মুক্তি পাওয়ার আগে গানটি বাজারে ছাড়া হয়নি। বাংলা সিনেমার প্রথম প্রোমোশনের অস্ত্র হিসেবে গানের গুচ্ছ ভিডিও ছাড়ার তখন চল ছিল না। শ্রীকান্তদা গানটা গেয়েওছিল এত ভালো! দেবুদার সুরও মিশে ছিল পাহাড়ি কুয়াশায় ঝিম ধরা সকাল। ফলে গানটার অবশ্য পরিণতি ছিল হিট। কেবল আমার সঙ্গে গানটার সম্পর্ক দাঁড়াল, প্রেমের প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া বন্ধুর মতো। ফলে যারা আমার কাছ থেকে গানটা চেয়েছিল, দিইনি।
‘আর জানি না’, ‘গাধা’, ‘ত্বকের যত্ন নিন’– এই তিনটে ক্যাসেট আমাদের পরপর বেরিয়েছিল। ২০০১-এ শুরু করি চন্দ্রবিন্দুর চতুর্থ অ্যালবামের কাজ। এই অ্যালবামের শুরুর গান ছিল– নীল নির্বাসন। গানটা তৈরি করা হয়েছিল রাজা দাশগুপ্তর টেলি সিরিয়াল ‘স্বপ্ননীল’-এর জন্য। এই সিরিয়ালের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিল বিরসা, ডেবিউ হয়েছিল শক্তিশালী এক অভিনেত্রী কনীনিকার। সিরিয়ালের গানটা যখন রেকর্ড করা হচ্ছে, তখন হারমনির জন্য পরমা ছিল। দেবুদাও আমাদের সাহায্য করবে বলে চলে আসে। এর আগে ‘ত্বকের যত্ন নিন’ অ্যালবামেরও ভোকাল অ্যারেঞ্জমেন্টের দায়িত্বে ছিল দেবুদা। ফলে আমাদের গানবাজনা, কম্পোজিশন– এসব বিলক্ষণ নখদর্পণে ছিল। ‘চ’ অ্যালবামে ‘স্বপ্ননীল’ গানটা দুটো অন্তরা জুড়ে পূর্ণাঙ্গ গান হিসেবে মুক্তি পেল। উপল, পরমা– এই কম্বিনেশনেই গাওয়া হয়েছিল। নতুন ক্যাসেটের প্রস্তুতির মাঝে দেবুদা একদিন ফোন করল– আয়।
আড্ডার শেষে আসল মতলব ফাঁস করল পরমা ও দেবুদা। পরমার একক অ্যালবাম বেরবে। আমি কি ‘যাও ফিরে বৃষ্টি’ গানটা দেব? প্রস্তাবটা শুনে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। তার মানে, ঋতুদার বাড়িতে শোনা গানটা দেবুদার ভালো লেগেছিল? না দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, পরমা এতদিনের বন্ধু! ইনফ্যাক্ট ঋতুদার সঙ্গে প্রথম আলাপও ওরই জন্য, এটা খুব খুশির খবর যে, রোজগেরে গিন্নি-র ব্যস্ততার মাঝখানে ও ক্যাসেট করছে। ‘তিতলি’ থেকে ফিরে আসা গান, পরমার ‘ঘরে ফেরার গান’-এ ঘর পেল। যা হোক, একটা হিল্লে হল যাও ফিরে বৃষ্টির। দেবুদার অনুরোধে আরও চারটে গান লিখে দিয়েছিলাম। ‘আমি তোমার সাথে একলা হতে চাই’ গানটার অন্তরা-ও। আমার নিজের ব্যান্ডের বাইরে এতটা ইনভলভ হয়ে আর কোনও অ্যালবামে কাজ করিনি। দেবুদা ভীষণ সুন্দর একটা সুর করেছিল, সেই সুরে যতদূর মনে পড়ে, আমি ‘ডাকহরকরা’ বলে একটা লিরিক লিখেছিলাম। গানটা যায়নি সেবার। আমি লিরিকটা হারিয়ে ফেলি, দেবুদাও ভুলে যায় সুরটা। আরও অনেক উদাসীন গুনগুনের সঙ্গে এই গানটাও হারিয়ে যায়।
ঋতুদা পরমার অ্যালবামটা শুনে আমায় ফোন করল একদিন। ‘যাও ফিরে বৃষ্টি’ গানটা খুব সুন্দর তো। বললাম, ‘তোমার ভাল লেগেছে বুঝি?’ জানাল, ‘খুউউউভ।’
প্রত্যুত্তরে ‘ও’ ছাড়া আর কিছু বলার মুখ ছিল না আমার।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?