সিনেমায় অ্যাকশন এভাবে প্রায় স্বতন্ত্র একটি আকর্ষণ করে নিল কীভাবে? বুঝতে হবে, হরর ছবির ‘ভয়’-এর মতোই, অ্যাকশন জিনিসটা আদ্যন্ত সিনেম্যাটিক একটি ‘ইভেন্ট’। বাস্তবে সংঘর্ষ এবং ভায়োলেন্সের চেয়ে পর্দার সংঘর্ষ এবং ভায়োলেন্স একেবারেই আলাদা। বাস্তবে যদি আমরা ভায়োলেন্স দেখি, তাহলে তা বিকর্ষণ এবং ভীতির উদ্রেক করবে। আদপেই তা উপভোগ্য হবে না। কিন্তু পর্দায় দেখলেই তা উদ্রেক করবে ‘থ্রিল’-এর। সিনেমার সমস্ত প্রকরণ-সম্পাদনা, শব্দ সংযোজন, ফ্রেমিং, কোরিওগ্রাফি এবং সর্বোপরি এই সবকিছু দিয়ে নির্মিত একরকমের ‘ভ্রম’ বা ইলিউশন– একত্রে অর্কেস্ট্রেট না করতে পারলে একটি অ্যাকশন সেট-পিস নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।
২১.
অ্যাকশন ছবিকে ঠিক জঁর বলা যায় না। অ্যাকশন যে কোনও রকম ছবিতে থাকতে পারে। জেমস বন্ডের ছবিগুলি আদতে স্পাই থ্রিলার, ঠিক যেমন ‘মিশন ইম্পসিবল’ হল স্পাই থ্রিলার এবং ‘হাইস্ট’ (heist) ছবির মিশ্রণ। গ্যাংস্টার ছবিতে অ্যাকশন থাকতে পারে, ওয়েস্টার্নে ঘোড়সওয়ারদের বন্দুকবাজি আমরা হামেশাই দেখতাম, দেখতাম ট্রেন-ডাকাতির দৃশ্য, বা অন্তিম শুটআউট। তাই অ্যাকশন যে কোনও ধরনের ছবিতে আসতে পারে।
কিন্তু জঁর নামক ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই দর্শকদের অনুধাবনের ওপর নির্ভরশীল। তাই দর্শকদের মনে যদি অ্যাকশন ছবি ভিন্ন জঁর হিসেবে জায়গা করে নেয়, তাই সই।
সিনেমায় অ্যাকশন এভাবে প্রায় স্বতন্ত্র একটি আকর্ষণ করে নিল কীভাবে? বুঝতে হবে, হরর ছবির ‘ভয়’-এর মতোই, অ্যাকশন জিনিসটা আদ্যন্ত সিনেম্যাটিক একটি ‘ইভেন্ট’। বাস্তবে সংঘর্ষ এবং ভায়োলেন্সের চেয়ে পর্দার সংঘর্ষ এবং ভায়োলেন্স একেবারেই আলাদা। বাস্তবে যদি আমরা ভায়োলেন্স দেখি, তাহলে তা বিকর্ষণ এবং ভীতির উদ্রেক করবে। আদপেই তা উপভোগ্য হবে না। কিন্তু পর্দায় দেখলেই তা উদ্রেক করবে ‘থ্রিল’-এর। সিনেমার সমস্ত প্রকরণ-সম্পাদনা, শব্দ সংযোজন, ফ্রেমিং, কোরিওগ্রাফি এবং সর্বোপরি এই সবকিছু দিয়ে নির্মিত একরকমের ‘ভ্রম’ বা ইলিউশন– একত্রে অর্কেস্ট্রেট না করতে পারলে একটি অ্যাকশন সেট-পিস নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। সিনেমায় নাচের মতোই অ্যাকশন দৃশ্যের নির্মাণ একটি ভিন্ন ধরনের স্কিল, তাই আমরা অনেক সময়েই দেখতে পাই যে একটি মধ্যমানের ছবিতে হয়তো উন্নতমানের একটি অ্যাকশন সিকোয়েন্স আমাদের চমকে দিল।
………………………………………..
অ্যাকশন দৃশ্যে অনেক ক্ষেত্রেই অভিনেতা হয়ে যান কিঞ্চিত গৌণ, বৃহত্তর সিনেম্যাটিক আয়োজন হয়ে যায় মুখ্য। সেইজন্যই কখন যে নায়কের জায়গায় তার বডি-ডাবল বা স্টান্টম্যানের অনুপ্রবেশ ও অন্তর্ধান ঘটেছে, তা আমরা খেয়ালই করি না। সেই জন্যই প্রতি ‘মিশন ইম্পসিবল’-এর পর্ব মুক্তি পাওয়ার আগে এত বিস্তৃত ‘বিহাইন্ড দ্য সিনস’ দেখিয়ে আমাদের জানাতে হয় যে এই দৃশ্যগুলিতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছেন স্বয়ং টম ক্রুজ।
………………………………………….
এইখানে অ্যাকশন এবং ভায়োলেন্সের মধ্যে আমাদের একটু তফাত করতে হবে, যদিও এই নিয়ে পরের কিস্তিতে আরেকটু বিস্তারিত বলার ইচ্ছে আছে। দুটো অবশ্যই সম্পৃক্ত। ভায়োলেন্স ছাড়া অ্যাকশন হবে কী করে? কিন্তু ভেবে দেখুন, ‘মিশন ইম্পসিবল’ বা ‘ধুম’ সিরিজের ছবিতে, এমনকী জেমস বন্ডের ছবিতে আপনি ভীতি-উদ্রেককারী রক্তপাত কি সেভাবে দেখতে পান? হালের ‘অ্যানিমাল’ বা ‘মার্কো’-তে যেভাবে পান? না, সেই ছবিগুলি অনেকটাই বিস্তৃত এবং অসম্ভব স্টান্টের ওপর নির্ভরশীল। একটি গ্যাংস্টার ছবিতে পরের পর খুনোখুনি আমরা দেখছি ধরুন। আবার সেভাবেই পরের পর খুন দেখছি সিরিয়াল কিলার নিয়ে স্ল্যাশার জাতীয় হরর ফিল্মে। এই ধরনের ছবির ভায়োলেন্স ঠিক ‘ধুম’-এর অ্যাকশনের মতো নয় তো। তাই, একেবারে সম্পৃক্ত হলেও তফাত আছে। তফাত হল অভিঘাতের, অ্যাকশন দৃশ্যে যেটা ‘থ্রিল’, ভায়োলেন্সে সেটাই ‘dread’ উদ্রেক করে। দুটোর অভিঘাত ভিন্ন।
সেরকমই, অ্যাকশন অনেক ক্ষেত্রেই স্কিল-নির্ভর।
যেমন ধরা যাক, ব্রুস লি অভিনীত ছবিতে। তার স্বল্পকালীন জীবনে মূলধারার ছবিতে ব্রুস লি যে শুধু আমেরিকান ছবিতে নায়কের এশিয়ান এথনিক পরিচয়ের দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন তাই নয়, হংকং-য়ে অভিনীত ছবিগুলিতে লি–র শরীর অন্য রাজনীতির গল্প বলতে থাকে শারীরিকতাতেই। কিন্তু প্রসঙ্গ শুধুমাত্র এথনিক শারীরিকতার নয়। ব্রুস লি ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসছেন মার্শাল আর্টের বহু শতাব্দী ধরে লালন করা স্কিল-সেট, যা হলিউডে একেবারেই নতুন।
ব্রুস অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত নন; বলা যায় সব ছবিতেই উনি একটি মিথিক ভূমিকাতেই অভিনয় করেছেন। কিন্তু সেই পারফরম্যান্সে তিনি অদ্বিতীয়। উনি বিখ্যাত ওঁর মার্শাল আর্ট ভিত্তিক ফাইট সিনগুলির জন্য। এখন সেই দৃশ্যগুলো ফিরে দেখলে বিচিত্র কিছু ব্যাপার চোখে পড়ে। অ্যাকশন সিনেমা বেশিরভাগ সময়েই অভিনেতাদের শারীরিক পটুত্ব, অ্যাক্রোব্যাটিক স্কিলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। সে অর্থে শারীরিক যুদ্ধের দৃশ্যের সঙ্গে ক্রীড়ার তফাত নেই খুব বেশি। কিন্তু সিনেমায় তার সঙ্গে জড়িত হয়ে যায় সম্পাদনা, আলোকসম্পাত, ক্যামেরার চাতুরি ইত্যাদি। অতএব ক্যামেরার সম্মুখবর্তী বাস্তবতার সঙ্গে, বা এমনকী তার ওপর সিনেমার লিখনের পরতের পর পরতে চড়তে থাকে– বাস্তবতা সম্পূর্ণ বদলে ‘সিনেম্যাটিক’-এ পরিণত হয়।
তার মানে কী? মানে হল এই, অ্যাকশন দৃশ্যে অনেক ক্ষেত্রেই অভিনেতা হয়ে যান কিঞ্চিত গৌণ, বৃহত্তর সিনেম্যাটিক আয়োজন হয়ে যায় মুখ্য। সেইজন্যই কখন যে নায়কের জায়গায় তার বডি-ডাবল বা স্টান্টম্যানের অনুপ্রবেশ ও অন্তর্ধান ঘটেছে, তা আমরা খেয়ালই করি না। সেই জন্যই প্রতি ‘মিশন ইম্পসিবল’-এর পর্ব মুক্তি পাওয়ার আগে এত বিস্তৃত ‘বিহাইন্ড দ্য সিনস’ দেখিয়ে আমাদের জানাতে হয় যে এই দৃশ্যগুলিতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছেন স্বয়ং টম ক্রুজ। বন্ডের ছবিতে তার প্রয়োজন হয় না, কারণ আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, সেরকম দৃশ্যে বন্ডের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন তিনি নন, আছেন তাঁর বডি-ডাবল বা স্টান্টম্যান।
কিন্তু ব্রুস লি-র ক্ষেত্রে তা হওয়ার জো নেই। কারণ ব্রুস অভিনীত ফাইট দৃশ্যগুলি এইভাবে স্টান্ট-নির্ভর নয় (যেভাবে জ্যাকি চানের ছবি ধরুন, জ্যাকি চানও নিজের স্টান্ট নিজে করার জন্য বিখ্যাত), বরং তা স্কিল নির্ভর। সেই জন্যই ব্রুসের ফাইট দৃশ্যগুলিতে খুব জরুরি হয়ে যায় তার মুখ। আপনি তার অভিব্যক্তি দেখছেন, হঠাৎই দেখবেন চকিতে তার সমস্ত শরীর ক্ষিপ্র হয়ে গেছে! শরীর থেকে মুখ, মুখ থেকে শরীর– এরকম একটা সংকোচন-বিস্তারের ছন্দ চলতে থাকে। তার শৈলী প্রায় মন্থরিত গতি থেকে চকিত ক্ষিপ্রতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। স্থৈর্য ও মন্থরতার সময়ে তার শরীরের সৌকর্য ও মুখ ছাড়া কিছুই দেখার থাকে না, ফ্রেমে আর সবকিছুই স্থবির, ব্রুসের দৃষ্টি দৃশ্যকে একটি সাইকোলজিকাল উৎকণ্ঠার দিকে নিয়ে যায়, তারপর আসে হঠাৎ গতি।
ব্রুসের ফাইট সিন দেখলে বোঝা যায় যে আসলে তিনি হলিউডের এই ‘সিনেম্যাটিক’-কেই পর্যুদস্ত করছেন। ফাইট সিনের সবচেয়ে জরুরি উপকরণ– নাটকীয়তা ছাড়া– হল ছন্দ, যা ক্যামেরার কোনও পরিবর্তন ও সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি হয়, অভিনেতারা সেই সুতোয় পুতুল হয়ে ওঠেন প্রায়। কিন্তু ব্রুস যখন ক্যামেরার সামনে, তখন ক্যামেরা ও সম্পাদনার ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তার শরীর ও মুখের যুগলবন্দি।
হংকং-য়ের ক্যামেরা এই ধরনের পারফরম্যান্সের সঙ্গে অভ্যস্ত। তারা বিভিন্ন পারফর্মারদের নিয়ে কাজ করতে করতে নিজস্ব শৈলীর ঘরানা তৈরি করে নিয়েছে মার্শাল আর্টের ছবিতে। কিন্তু পর্যুদস্ত হয় ছয় ও সাতের দশকের হলিউডের ক্যামেরা, যারা এতে অভ্যস্থ নয়। কোথায় ক্যামেরার অবস্থান ও অ্যাঙ্গেল বদলাবে, কোথায় পড়বে যতিচিহ্ন, কোথায় শটের ডিউরেশন কমবে বা বাড়বে স্থির করছে তারকার শরীর। সেই জন্যই দৃশ্যগুলিতে শটের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে, কমতে থাকে কাট– স্থির নিষ্পলক দৃষ্টিতে ব্রুসের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া হলিউডের ক্যামেরার আর কিছু করার উপায় থাকে না। প্রথম বিশ্বের উন্নত ইন্ডাস্ট্রিয়াল শৈলীর চেয়ে তৃতীয় বিশ্বের স্কিল ও ঐতিহ্য নির্ণায়ক এই ছবিতে প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। তাই ব্রুস নিজে কান্টনিজ ও আমেরিকান বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও লি’র শৈলীতে উঠে আসে প্রতীচ্যের শারীরিক শিক্ষা। এভাবেই হলিউডে যে অভিনেতার একদমই পার্শ্ব ও গৌণ চরিত্রে থাকার কথা ছিল, তিনি অকালমৃত্যুর আগে ও পরে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তিসম।
…পড়ুন এই কলামের অন্যান্য পর্ব…
২০. গথিক ও তান্ত্রিক– প্রাগাধুনিকের ভীতি
১৯. ভিন্নতার আতঙ্ক– দ্য এক্সরসিস্ট এবং লাভক্রাফট
১৭. কালচার ইন্ডাস্ট্রির ফ্যান্টাসি কি মূলত ভিন্ন মধ্যযুগের কল্পনা?
১৬. কল্পবিজ্ঞান শুধু ইতিহাসের মোড় বদলেই পাল্টায়নি, ইতিহাসের বিরুদ্ধেও গেছে
১৫. সাই-ফাই, ফ্যান্টাসি, হরর– তিনটে জঁরেই অবাস্তব নিজেকে মেলে ধরেছে বাস্তবের মতো করে
১৪. ফিউডাল রক্ষণশীলতা থেকে পুঁজিবাদী শিকড়হীনতায় পতনের গল্প বলে গডফাদার ট্রিলজি
১৩. গ্যাংস্টার জঁর– সভ্যতার সূর্যগ্রহণের মুহূর্ত ছায়ামূর্তিদের গল্প বলার সময়
১২. ফাম ফাতাল নারীর আর্কেটাইপের কি কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, না সে কেবলই একটি ‘টাইপ’?
১১. রহস্যসন্ধানীর পালাবদল, ফিল্ম নোয়া আর আমরা
১০. ফিল্ম নোয়া– নাগরিক আলোর মধ্যে আঁধারের বিচ্ছুরণ
৯. ‘দ্য হেটফুল এইট– এখন ওয়েস্টার্ন যেরকম হতে পারত
৮. একটি মৃতদেহ দেখানো ও না-দেখানোর তফাত থেকে বোঝা যায় ‘শোলে’ শুধুমাত্রই অনুকরণ নয়
৭. যখন জঁর নিজেকে নিয়েই সন্দিহান
৬. আমেরিকার ‘হয়ে ওঠা’-র কল্পগল্প
৫. একটি সভ্যতার হয়ে ওঠার মিথোলজি
৪: পশ্চিমে এল এক নারী, বেজে উঠল অমর সংগীত
৩. জঁরের ফর্দ– দৃশ্য, শব্দ, প্রেক্ষাপট
২. ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং তার পূর্বসূরি দুই নায়ক ও একটি ছদ্মবেশী জঁর
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved