২০২২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পুজোর পরের দিন, প্রতিমা বিসর্জনের দিন, বিসর্জন হল সরস্বতীর বরপুত্রীর, কি অদ্ভুত সমাপতন! আমরা কলকাতা দূরদর্শনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানালাম ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যেবেলা। স্টুডিও ‘এ’-র ফ্লোর থেকে। ফ্লোর অ্যাসিস্টান্ট ভাইয়েরা লতাজির ছবি দিয়ে সাজিয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন থেকে শুরু করে ক্যামেরাম্যান, প্রডাকশনের সবাই খুবই তৎপর, আমি আমার অতিথিদের নিয়ে গিয়ে বসলাম। দেবজ্যোতি মিশ্র, শ্রীকান্ত আচার্যর সঙ্গে ছিল এক নবীন শিল্পী মধুরা ভট্টাচার্য, আর ছিলেন স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়, যিনি লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং তাঁর হাজার হাজার গান সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টায় নিমগ্ন রয়েছেন।
২২.
অনেকদিন আগের একটা কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমি টিভিতে সবে কাজ শুরু করেছি, ১৪ জুলাই আর ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানের কথা আগেই বলেছি, তারপর ‘তরুণদের জন্য’ সঞ্চালনা করতাম। নিয়মিত ঘোষণার দায়িত্বে তখনও আসিনি। সেই সময় অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। যেমন, শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সংঘ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাব্য নাট্য ‘গান্ধারীর আবেদন’ অভিনয় হয়েছিল। রবীন্দ্র সদন ও শিশির মঞ্চের পর রাধা স্টুডিওর ফ্লোরে। অবশ্যই শর্মিষ্ঠাদির যোগাযোগে। সুসীমাদি (মুখার্জি) গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র লালটুদা মানে সুবীর মিত্র, দুর্যোধন তপনদা (মল্লিক) এবং দ্রৌপদী আমি। শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘের একটি বিখ্যাত প্রযোজনা ‘তাসের দেশ’ টেলিভিশনে করার প্রস্তাব ছিল, সেই কারণে বিভাস চক্রবর্তী আমাদের রিহার্সাল দেখতেও এসেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। সন্তোষ সেনগুপ্তর পরিচালনায় ‘নটীর পূজা’ করেছিলাম টিভিতে, সে কথা বোধহয় আগে বলেছি।
এতদিন লিখেছি যেসব সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি তার গল্প, এবার বলি, দূরদর্শনের ‘রূপকথা’ অনুষ্ঠানে একাধিকবার আমার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তার গল্প। সবকটির প্রযোজক নন্দিনী চ্যাটার্জী। একবার কবিপক্ষে হয়েছিল ‘ঠাকুরবাড়ির ফ্যাশন’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠান। এই বিষয় নিয়ে যেহেতু আমার গবেষণামূলক কাজ আছে, তাই আমি ছিলাম সেদিনের বিশেষজ্ঞ। ভারী সুন্দর করে সাক্ষাৎকার নিয়েছিল জয়িতা গোস্বামী। অন্তরা দাস দু’টি পৃথক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার নিয়েছে, সেও ভালো সঞ্চালক। একটির বিষয় ছিল ‘পদ্য পোশাক’, আমাদের দেশে আমিই যার উদ্ভাবক। আমার শ্রাবস্তীর পদ্য পোশাকের পসরা ফ্যাশন জগতে সাড়া ফেলেছিল বিস্তর। দূরদর্শন যে আমার এই ভূমিকাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
অন্য অনুষ্ঠানটি ‘ঠাকুর বাড়ির সাজ’ প্রসঙ্গে, আমি ছাড়াও সে অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে ছিল সুচিস্মিতা দাশগুপ্ত। ওই সময়ে সে ‘কাদম্বরী’ ছবিটির পোশাক পরিকল্পনা করেছিল। ঠাকুরবাড়ির ফ্যাশন হোক বা সাজ, আমি কিন্তু দু’বারেই তাঁদের ধারা অনুসরণ করেই সেজে বসেছিলাম, পরনে ঢাকাই শাড়ি। আরেকবার আমি আর শাশ্বতী সাক্ষাৎকার দিতে বসেছিলাম ‘কথায় কথায়’ অনুষ্ঠানে।
অবসর গ্রহণের পর বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি। তেমনই কয়েকটি বলি। এক ২৫ বৈশাখের সকালে স্টুডিও ‘বি’ সেজে উঠল ফুলের বাহারে ও রবীন্দ্রনাথের ছবিতে। তাঁর ছবির সামনে আমার বসার জায়গাটিও সুসজ্জিত। আমি পরেছি আজকের দিনের উপযুক্ত এক শাড়ি, শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী বাটিক। লাইভ টেলিকাস্ট শুরু হলে চিরাচরিত রীতিতে নমস্কার করে বললাম, ‘আরবার ফিরে এল উৎসবের দিন, বসন্তের অজস্র সম্মান, ভরি দিল তরুশাখা কবির প্রাঙ্গণে, নব জন্মদিনের ডালিতে…’।
এই দিনটা তো আমাদের গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো করার দিন, তাই তাঁর কথা দিয়েই সূচনা। আমার কথা-মুখ শেষ হলে জোড়াসাঁকোর অনুষ্ঠান, মাঝে মাঝে স্টুডিওতে ফেরা, তারপর কখনও রবীন্দ্রসদন, এইভাবে এগিয়ে যাওয়া। আমার কাজ মালাকরের ফুলের পর ফুল সাজিয়ে মালা গাঁথা। এসবের মধ্যে যখন অবকাশ পাওয়া যাচ্ছে, তখন চলছে আমাদের ফটো সেশন, নন্দিনী (অনুষ্ঠান প্রযোজনার দায়িত্বে ও ছিল) আর উৎপল (মৈত্র) ছিল স্টুডিও-তে অন ডিউটি, সেই আমাদের ‘নির্মাণ’ তথ্যচিত্রের টিমের সদস্য, এগুলো উপরি পাওনা, তাই ছবি তোলা তো হবেই!
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ৮ মার্চ আমরা ‘ঘরে বাইরে’-তে অনুষ্ঠান করতাম সব সময়, অবসর নেওয়ার পরেও ওই বিশেষ দিনে ডাক পেয়েছি। মনে আছে, ঋকুর প্রযোজনায় একবার ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতাশঙ্কর ও আমি ছিলাম। সঞ্চালক মেয়েটি খুব মিষ্টি, সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অনুষ্ঠান।
৯ অগাস্ট কলকাতা দূরদর্শনের জন্মদিনে যেমন অনুষ্ঠান করতাম, তেমনই ১৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় দূরদর্শনের জন্মদিনে লাইভ টেলিকাস্টে বসেছিলাম রাজীব ভট্টাচার্যের আহ্বানে এবং স্নেহাশিস সুরের সঞ্চালনায়। অনুষ্ঠানে আরও অনেকের সঙ্গে বিশ্বনাথ দাসও ছিলেন, এক সময়কার স্পোর্টস প্রডিউসার, পরে স্টেশন অধিকর্তা হয়েছিলেন।
তবে এ পর্যায়ে অর্থাৎ, অবসর গ্রহণের পর থেকে আজ অবধি আমার কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সুরসাধিকা কিংবদন্তী শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের স্মরণ অনুষ্ঠান। ২০২২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পুজোর পরের দিন, প্রতিমা বিসর্জনের দিন, বিসর্জন হল সরস্বতীর বরপুত্রীর, কি অদ্ভুত সমাপতন! আমরা কলকাতা দূরদর্শনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানালাম ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যেবেলা। স্টুডিও ‘এ’-র ফ্লোর থেকে। ফ্লোর অ্যাসিস্টান্ট ভাইয়েরা লতাজির ছবি দিয়ে সাজিয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন থেকে শুরু করে ক্যামেরাম্যান, প্রডাকশনের সবাই খুবই তৎপর, আমি আমার অতিথিদের নিয়ে গিয়ে বসলাম। দেবজ্যোতি মিশ্র, শ্রীকান্ত আচার্যর সঙ্গে ছিল এক নবীন শিল্পী মধুরা ভট্টাচার্য, আর ছিলেন স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়, যিনি লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং তাঁর হাজার হাজার গান সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টায় নিমগ্ন রয়েছেন। এছাড়াও ছিল উস্তাদ রশিদ খানের তাঁর লতাদিদি সম্পর্কে কিছু কথা, অন্তরা চৌধুরী, তার ঘর থেকে যুক্ত হয়েছিল আমাদের স্টুডিওর সঙ্গে, সবই সম্ভব টেকনিক্যাল কারিকুরিতে। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘আমি যে গান গেয়েছিলেম’। এটি কোনও করুণ গাথা ছিল না, ছিল লতাজির গান ও তাঁর জীবন উদযাপনের অনুষ্ঠান।
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….
চিরাচরিত অবিচুয়ারি প্রোগ্রাম থেকে আলাদা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় মেলানো গানে কথায় স্বতঃস্ফূর্ত এক অনুষ্ঠান। দেবু (দেবজ্যোতি মিশ্র) দারুণ একটা কথা বলেছিল লতাজি সম্পর্কে, ‘আজ তাঁর অমরত্বের দ্বিতীয় দিন’, আমি শেষ করেছিলাম এই বলে যে,‘যতদিন পৃথিবীতে সুর থাকবে ততদিন লতা মঙ্গেশকর থাকবেন’।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ২১: ক্যামেরার সামনে আড্ডা মেরেছি , আবার তাঁর অবিচুয়ারি প্রোগ্রামও করতে হয়েছে
পর্ব ২০: রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির একশো বছর উদযাপন করেছিলাম দূরদর্শন কেন্দ্রে
পর্ব ১৮: হুইল চেয়ারে করে দূরদর্শনে শেষ অভিনয় করতে এসেছিলেন তৃপ্তি মিত্র
পর্ব ১৭: বাংলা টেলিভিশনে সেই প্রথম ‘মা ও মেয়ে’ নিয়ে সিরিজ অনুষ্ঠান
পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্যচিন্তা নিয়ে তথ্যচিত্র সেই প্রথম
পর্ব ১৫: ট্রেনে শুটিং-এর সময় সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’
পর্ব ১৪: দূরদর্শনের জন্য প্রথম তথ্যচিত্র করা আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার!
পর্ব ১৩: সেন্ট পল ক্যাথিড্রালকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর সাপ্তাহিকীর শুটিং হয়েছিল!
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে