Robbar

দূরদর্শনে হাসুদি দেখিয়েছিলেন প্রতিমা দেবীর থেকে শেখা নৃত্যশৈলী

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 28, 2025 9:08 pm
  • Updated:January 28, 2025 9:35 pm  

রবীন্দ্রসান্নিধ্য ধন্য যাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা বলা বাকি রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে যাঁরা নৃত্যের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন তাঁদের মধ্যে কবির দৌহিত্রী বুড়ি বা নন্দিতা (পরে কৃপালনী) তো ছিলেনই, ছিলেন আরও অনেকে, তেমনই দু’জনের সঙ্গে আলাপচারিতা করার সুযোগ হয়েছিল, এঁরা হাসু, মমতা নামেই পরিচিত ছিলেন। মমতাদির পা তখন আর চলে না। হাসুদি তখনও সচল, নৃত্যভঙ্গিমা দেখাতে সক্ষম।

চৈতালি দাশগুপ্ত

২৩.

বিসর্জন। প্রতিমা বিসর্জন। পুজোকে ঘিরে কত অনুষ্ঠানের, কত সরাসরি সম্প্রচারের কথা বলেছি, বিসর্জনের দিনের উন্মাদনার কথা বলা বাকি রয়ে গিয়েছে এখনও। হ্যাঁ, উন্মাদনাই বটে! যেদিন প্রথম ভিড় পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম বাজা কদমতলা ঘাটে। আগের দিন থেকে প্রস্তুতি চলছিল অর্থাৎ ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে হোমওয়ার্ক, যেমন আমার সব কাজের পূর্বেই থাকে। বাড়িটা আমাদের ছোটখাটো লাইব্রেরি, কাজেই অসুবিধে নেই। রাধারমণ মিত্রর ‘কলকাতা দর্পণ’ থেকে পড়ে নিলাম কলকাতার ঘাট সংক্রান্ত তথ্য, বিশেষত বাজা কদমতলা ঘাটের ইতিহাস।

Kolikata Darpan || Radharaman Mitra || কলিকাতা দর্পণ || রাধারমণ মিত্র

গিয়ে দেখি আরও অনেক চ্যানেলই এসেছে, তবে আমাদের সরকারি চ্যানেল বলে  বাড়তি কিছু সুবিধে সর্বক্ষেত্রেই থাকে। যেখানে দাঁড়িয়ে সরাসরি সম্প্রচার শুরু করব, তার পরিসরটা অনেকখানি। আমার সহযোগী হিসেবে সেদিন ছিল পদ্মনাভ দাশগুপ্ত।

Padmanabha Dasgupta Filmography | Biography of Padmanabha Dasgupta | Padmanabha Dasgupta | Indian Film History
পদ্মনাভ দাশগুপ্ত

আমি কখনও প্রতিমা বিসর্জন দেখিনি, ছেলেবেলায় আমাদের হাজরা রোডের বাড়ির সামনে দিয়ে একের পর এক প্রতিমা বিসর্জনের জন্য যেত গঙ্গার দিকে কিন্তু কীভাবে জলে ফেলা হয় অত বড় কাঠামোর দেবী মূর্তিকে তা কেবল ছবিতেই দেখেছি, সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। কেন জানি না খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন, মনে হচ্ছিল একের পর এক শিল্পের জলাঞ্জলি হচ্ছে। আমার এই অনুভূতি নিতান্তই ব্যক্তিগত– তার সঙ্গে ধারাভাষ্যের কোনও সংগতি নেই, সেখানে আমার কাজ একের পর এক সুচারু রূপে বিবরণ দিয়ে যাওয়া। মনকে বুঝিয়ে ছিলাম, এই তো জগতের নিয়ম, আবাহন আছে মানেই তার বিসর্জন হবে।Durga Puja 2024: ইছামতিতে প্রতিমা বিসর্জন, নদীর ঘাটে দর্শনার্থীদের ভিড় Durga Puja 2024 Durga Idol Immersion in Ichamati River

দূরদর্শনে কাজ করার সূত্রে কত যে অমূল্য অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার কথা তো এতদিন ধরে বলছি, সকল সময় মনে হয়, কত মানুষের আর নেশার সঙ্গে এশা মেলে, আমার মিলে ছিল সে আমার পরম সৌভাগ্য। এমনই আরেকটি দিনের কথা বলি, আরেক বিসর্জনের। ইছামতী নদী তীরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম প্রতিমা বিসর্জন, সেও দূরদর্শনের কল্যাণে, টাকি যাওয়া এবং সেই অনবদ্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা। কী সেই দৃশ্য? ইছামতী নদীর মাঝখানে এসে দাঁড়ায় দুই বাঙলার নৌকো দু’দিক হতে, সারি দিয়ে দাঁড়ায় তারা, তারপরে এক সময় শুরু হয় বিসর্জনের পালা। সেই মুহূর্তগুলি আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

Photo Story Durga Idol Immesion In Basirhat দুর্গা বিসর্জন
ইছামতী-তে প্রতিমা বিসর্জন

‘দুই বাংলা’ শব্দ দু’টি লিখতে গিয়ে মনে পড়ল, এক একুশে ফেব্রুয়ারি সকালের কথা, স্টুডিওতে বসলাম আমার খুব প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় এক মানুষকে নিয়ে, নাম তাঁর প্রতুল মুখোপাধ্যায়, যিনি স্পর্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘বাঙলা আমার দৃপ্ত শ্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর-ধনুক…’। স্বভাবতই প্রতুলদা কথার মাঝে মাঝে গান গেয়েছিলেন।

প্রতুল মুখোপাধ্যায়

একজন মানুষের কথা বলা হয়নি, ভারি স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য তাঁর, অসামান্য বৈদগ্ধ আর নম্রতার মিশেল সেই সৌন্দর্যে– কৃষ্ণা বসু। দূরদর্শনের শুরুর দিন থেকেই তাঁদের পরিবারকে চিনতাম। ডাক্তার শিশির কুমার বোসের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পঙ্কজদার ঘরে সেই সাদা-কালোর যুগে। মেয়ে শর্মিলাকেও মনে আছে। ভালো গান গাইত। কৃষ্ণাদিকে পেয়েছি আমাদের ‘ঘরে বাইরে’র একাধিক অনুষ্ঠানে। আমার আর রঞ্জনার (গিরি) ডাকে সাড়া  দিয়েছেন সবসময়। অবশ্যম্ভাবী ভাবে সেখানে  উঠে এসেছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং নেতাজি ও তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রসঙ্গ।

Lesser known facts about Krishna and Sisir Kumar Bose's love life
শিশির কুমার বোস-কৃষ্ণা বসু

সেপ্টেম্বরের এক বর্ষণমুখর সকালে গিয়েছিলাম ব্যারাকপুরের গান্ধীঘাটে গান্ধী-মিউজিয়মে শুটিং করতে। বিষয় ছিল, গান্ধীজির সঙ্গে বিশিষ্ট কিছু মানুষের সম্পর্ক নিয়ে, যেমন নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ, সরোজিনী নাইডু, আবুল কালাম আজাদ। দোসরা অক্টোবর গান্ধীজির জন্মদিনে বিশেষ অনুষ্ঠান হিসেবে নিবেদন করা হবে সেই উদ্দেশ্যেই যাওয়া। বৃষ্টির মধ্যে তো কোনও রকমে গিয়ে পৌঁছনো গেল, মিউজিয়ামের সর্বোচ্চ দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি আমাদের আপ্যায়ন করলেন কিন্তু অক্লান্ত বর্ষণে আউটডোরে যা শট নেওয়ার দরকার ছিল, তা পিছিয়ে গেল, সংরক্ষণাগারের ভেতরে শুটিং করে তারপর অপেক্ষা করতে হল বহুক্ষণ। বৃষ্টি ধরলে গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা ফেস করলাম, মিউজিয়ামের সিঁড়িতে বসে ওখানকার অধিকর্তার সাক্ষাৎকার নিলাম। সেদিন আমি ছিলাম নো মেকআপ লুকে, ক্যামেরাম্যান রমন আর প্রযোজক আদিত্য সেটাই চেয়েছিল। অনুষ্ঠানের শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘গান্ধীজি ও তাহাদের কথা’।

কথার পরে কথা আসে, নেতাজি থেকে গান্ধীজির কথা এল আর গান্ধীজির কথা থেকে মনে পড়ল সরলা দেবী চৌধুরাণীর কথা। স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে, রবীন্দ্রনাথের ভাগনি সরলা তাঁর আত্মকথা লিখেছেন, ‘জীবনের ঝরাপাতা’। এই বইকে উপজীব্য করে অনুষ্ঠানটি মূলত করব ঠিক করেছিলাম, তারপরেই মনে পড়ে গেল তপতীদির কথা– তপতী সেনগুপ্ত। সরলা দেবীকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাই অনুষ্ঠানে তিনি এলেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে।

রবীন্দ্রসান্নিধ্য ধন্য যাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা বলা বাকি রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে যাঁরা নৃত্যের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন তাঁদের মধ্যে কবির দৌহিত্রী বুড়ি বা নন্দিতা (পরে কৃপালনী) তো ছিলেনই, ছিলেন আরও অনেকে, তেমনই দু’জনের সঙ্গে আলাপচারিতা করার সুযোগ হয়েছিল, এঁরা হাসু, মমতা নামেই পরিচিত ছিলেন। মমতাদির পা তখন আর চলে না। হাসুদি তখনও সচল, নৃত্যভঙ্গিমা দেখাতে সক্ষম। ওঁর কাছে দেখেছিলাম প্রতিমা দেবীর কাছে শেখা নৃত্যশৈলী। হাসুদিকে (ভালো নাম সুকৃতি) নিয়ে পরে আরেকবার অনুষ্ঠান করেছিলাম, সেবার ক্যামেরায় ছিল উৎপল।

SMARAKA GRANTHA: Marriage of Nandita (daughter of Mira), grand daughter of Rabindranath
কবির সঙ্গে দৌহিত্রী নন্দিতা দেবী

অন্য আরেকটি অনুষ্ঠানের কথা বলি, শান্তিনিকেতনের এককালের ছাত্রী প্রতিমা রায়চৌধুরীর (ডাকনাম হাসি) স্মৃতিচারণ। তাঁর গুরুদেবকে নিয়ে কত গল্পই যে শুনিয়েছিলেন, বলেছিলেন তাঁদের সময়কার শান্তিনিকেতনের কথা, আচার্য নন্দলাল বসু (ওঁরা বলতেন ‘মাস্টারমশাই’), রামকিঙ্কর বেজ (ওঁদের কিঙ্করদা), এমন সব বিশিষ্ট মানুষের গল্প ধরা পড়েছিল স্মৃতিকথায়। অনুষ্ঠানের শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘সেই স্মৃতি মনে আসে ফিরে ফিরে…’।

……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………

পর্ব ২২: নিছক অবিচুয়ারি নয়, দূরদর্শনে লতা মঙ্গেশকর-স্মরণ ছিল তাঁর গান ও জীবনের উদযাপন

পর্ব ২১: ক্যামেরার সামনে আড্ডা মেরেছি , আবার তাঁর অবিচুয়ারি প্রোগ্রামও করতে হয়েছে

পর্ব ২০: রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির একশো বছর উদযাপন করেছিলাম দূরদর্শন কেন্দ্রে

 পর্ব ১৯: কাদম্বরী-রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাজার চলতি কল্পিত কদর্য গল্পের বিরুদ্ধাচরণ করেই দূরদর্শনে করেছিলাম ‘শ্রীমতী হে’

পর্ব ১৮: হুইল চেয়ারে করে দূরদর্শনে শেষ অভিনয় করতে এসেছিলেন তৃপ্তি মিত্র

পর্ব ১৭: বাংলা টেলিভিশনে সেই প্রথম ‘মা ও মেয়ে’ নিয়ে সিরিজ অনুষ্ঠান

পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্যচিন্তা নিয়ে তথ্যচিত্র সেই প্রথম

পর্ব ১৫: ট্রেনে শুটিং-এর সময় সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’

পর্ব ১৪: দূরদর্শনের জন্য প্রথম তথ্যচিত্র করা আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার!

পর্ব ১৩: সেন্ট পল ক্যাথিড্রালকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর সাপ্তাহিকীর শুটিং হয়েছিল!

পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে

পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!

পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন

পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে

পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম

পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস

পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে

পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই

পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে

পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!

পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন

পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে