ঋতুদা তন্ময় হয়ে শুনছেন আমাদের কথা। প্রায় একটা মিনি-ইন্টারভিউ অথবা পুলিশি জেরা। মনে মনে ভাবছি, এসব জিজ্ঞেস করছে কেন, ছাপবে?
২.
দরজার ফাঁক দিয়ে যেটুকু চোখে পড়েছিল, কোঁকড়া চুল আর বড় স্টিল ফ্রেমের চশমা। কালো টি-শার্ট আর জিন্স পরা অতিশয় স্মার্ট লোকটা হেসে, ‘বসো তোমরা’ বলে আপ্যায়ন করেছিলেন। একটু অবাকই লাগছিল, কারণ আগে ঋতুপর্ণর যত ছবি দেখেছি, সবই ফুলছাপ পাঞ্জাবি পরা। এই পোশাকে বেশ মানায় তো দেখছি! কোনও ভানভনিতার লাইনে গেলেন না ভদ্রলোক। সরাসরি বললেন, তোমাদের গান আমি শুনেছি, আমার অ-ও-ও-সম্ভব ভাল লেগেছে। এ স্টেটমেন্টের প্রত্যুত্তরে জড়তা কাটিয়ে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’-টুকুও বলতে পারেনি কেউ। চন্দ্রিল বোধহয় খুব নীচু কণ্ঠে একটা ‘আচ্চা’ প্রকাশ করেছিল।
–কে লেখে তোমাদের গান?
–আমি আর চন্দ্রিল লিখি।
–‘রোগা বোলো না’– এটা কার লেখা?
–চন্দ্রিল।
–‘মঙ্গলগ্রহে মানুষ থাকে না?’
–চন্দ্রিল।
–তবে যে বললে তুমিও লেখো?
–হ্যাঁ, লিখি তো, মানে এই দুটো গান আমার লেখা নয়।
–‘খেলছে শচীন’ গানটা কার?
–ওটা আমাদের একসঙ্গে লেখা।
–তাই! একসঙ্গে কী করে গান লেখা যায়?
এ প্রশ্নের উত্তরে একটু হতাশ হয়ে পড়লাম। কী বলি? চন্দ্রিল তড়িঘড়ি বলল, “মানে, একলাইন ও লেখে, একলাইন আমি, মানে কখনও আলোচনা করে দু’জনে ঠিক করলাম একটা কিছু।” ঋতুপর্ণ অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
–এরকমটা কখনও শুনিনি, খুব অভিনব, কোলাবরেটিভ ফর্ম। তোমাদের অ্যালবাম আছে?
তাড়াতাড়ি আমি বলি– হ্যাঁ, আমাদের পরপর দু’-বছর অ্যালবাম বেরিয়েছে। ‘আর জানি না’, ‘গাধা’।
–কেন এমন নাম?
–আসলে প্রথম ক্যাসেটের পর ভেবেছিলাম আর এগোব না। মানে একটাই, তাই ‘আর জানি না’। আর ‘গাধা’ তো আমাদের একটা গান আছে, এছাড়া তৃতীয় সুর, ষষ্ঠ সুর ব্যাপারটা কে না জানে!
ঋতুদা তন্ময় হয়ে শুনছেন আমাদের কথা। প্রায় একটা মিনি-ইন্টারভিউ অথবা পুলিশি জেরা। মনে মনে ভাবছি, এসব জিজ্ঞেস করছে কেন, ছাপবে আনন্দলোকে?
দরজায় ঘন ঘন নক। স্লাইড ডোর খুলতে গিলোটিনে মাথা গলানোর মতো স্বকুঘোর মুখ। ‘ঋতু…’। ওঁর মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। ঋতুদা বললেন, ‘নিয়ে এসো। তোমরা কিছু মনে করবে একটা অন্য কাজ করলে?’ এমন ভদ্রতার সঙ্গে আমরা পরিচিত নই ঠিক। তিনজনই তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঘরে প্রবেশ করলেন ‘নির্ঘাৎ নায়িকা’। স্বকুঘো ঋতুদার চেয়ারের পাশে এসে ফিসফিস করে কীসব বলতে লাগলেন। সেদিন থেকেই সার বুঝেছি, সিনেমার কথা ফিসফিস করেই বলতে হয়। ঋতুদা কী একটা যেন বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাওড়া থেকে আসতে পারবে তো?’
এই প্রথম মেয়েটির গলা শুনলাম। ‘পারব।’
একে ছোট ঘর, তার মধ্যে তিনটে অচেনা ছেলে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির নিশ্চয়ই অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। অথবা হচ্ছিল না। কিছু কিছু নারী আছে, যারা রাস্তায় হাঁটলে, মানুষ-ফুটপাথ-ল্যাম্পপোস্ট-হাইড্রেন সবই ভ্যানিশ হয়ে যায়। সুনীলের লেখায় এদের দেখা পাওয়া যায়। এ হল সেই গোত্রের। বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঋতুদা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার ভাল নাম অর্পিতা তো?’
এই প্রথম মেয়েটির ঠোঁটে হাসির আভা! ‘হ্যাঁ, অর্পিতা পাল।’
ফের ফিল্ডিং শুরু করলাম পুরনো পজিশনে।
–তোমাদের লিরিক বুক আছে?
মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। “ঠিক বই নয়, তবে ‘গাধা’ ক্যাসেটের ভেতর একটা বুকলেট আছে। আমার আর ওর বানানো।” চন্দ্রিল জানাল।
–একটু দিতে পারবে?
–হ্যাঁ, অবশ্যই।
এইবার একটু গুমট লাগতে শুরু করেছে। এইটুকু চাওয়ার জন্য এত ঘটা করে ডাকা! কোনও মানে হয়! সমুদ্র যখন খুব শান্ত, তখনই সবচেয়ে, তুমুল ঢেউটা ওঠে। ঋতুদা বলে উঠলেন, ‘আমার খুব ইচ্ছে এই আনন্দলোক অ্যাওয়ার্ড শো-তে তোমাদের একটা স্পেশাল পুরস্কার দেওয়ার। তোমাদের আপত্তি আছে?’
মুখ দিয়ে কথা সরছে না কারও। তেলা লুচি না পেলে বাঁচি। অ্যা-অ্যা-অ্যাওয়ার্ড! মনের ভেতর পাখি ওড়াওড়ি করছে তখন। এডিটর’স চয়েস অ্যাওয়ার্ড, বাংলা কালচার-এ একটা নতুন ধারার জন্য। খুশির গ্যাসবেলুন হয়ে তিনজন হাঁ করে বসে রইলাম। আচ্ছা কী মনে হয় তোমাদের, কে দিতে পারে তোমাদের অ্যাওয়ার্ড? মনে মনে তখন গজগজ করছি। যে কেউ দিলেই হবে। ঋতুপর্ণ, স্বকুঘো, এমনকী, এই অচেনা মেয়েটা– যে কেউ। পেলেই হল। ‘আচ্ছা, কাজল দিতে পারে তোমাদের অ্যাওয়ার্ড?’– এই প্রশ্নটার পর বুকের ভেতর একটা বিচ্ছিরি গুড়গুড়ানি শুরু হল। এই প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বলারও কোনও সাহস আমাদের নেই। কিন্তু কাজল এখনও কনফার্ম করেনি। কাকে যেন একটা ফোন করলেন ঋতুপর্ণ। খুব বাহারি ইংরিজিতে কথা-টথা বলে জানালেন, ‘রাবিনা কনফার্মড।’ যাক, আমরা একটু আশ্বস্ত হলাম। ধড়ে প্রাণ পাওয়ার মুহূর্তেই ঋতুপর্ণর নয়া সংযোজন, ‘কিন্তু রাবিনা কি তোমাদের সঙ্গে যাবে?’ ভাবলাম বলি, রাবিনা যদি না-ও চায়, আমরা কিন্তু একদম রাজি। রাবিনা যাবে না, ঋতুপর্ণ অসম্ভব রকমের ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন। ওই অখণ্ড নীরবতায় বাগড়া দিল চন্দ্রিল, ‘যখন চাইছেন, তখন আপনিই তো আমাদের দিয়ে দিতে পারেন।’
ঋতুপর্ণ ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন খানিক। তারপর বললেন, ‘সেটা হয় না।’ ওই সময়টায় উপল মুখ দিয়ে কোনও শব্দ উচ্চারণ করত না, একেবারে বোবার বাবা। আমি তখন মরিয়া, ‘কলকাতায় কি কেউ নেই যে এটা দিতে পারে?’ ঋতুপর্ণ ঠোঁট উল্টে ভাবতে বসলেন। একটু পরে বললেন, ‘বুঝতে পারছি না।’ মুনমুন সেন থেকে মনোহর আইচ– অনেকগুলো নামই মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু ঋতুপর্ণর নারাজ ভঙ্গি দেখে আর উত্থাপন করিনি সেসব। এরপর অনেক অনেক ‘আনন্দলোক অ্যাওয়ার্ড’ চলে গিয়েছে। শুধু দেওয়ার লোক পাওয়া গেল না বলে চন্দ্রবিন্দুর কপালে আর শিকে ছিঁড়ল না কখনও। এখন ওটিটিতে কাজলকে দেখলে খুব খারাপ লাগে, বেচারি জানলও না, আমাদের সঙ্গে স্টেজ শেয়ার করার সৌভাগ্য থেকে সে বঞ্চিত রইল চিরকাল।