রচনাবলির ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশ অনুসারে ‘রবীন্দ্রনাথ-অঙ্কিত প্রচ্ছদে ও রঙিন নামচিত্রে ভূষিত হইয়া ১৩৩৬ আশ্বিনে মহুয়া কাব্যের প্রথম প্রকাশ’। ইংরেজি সময় অনুসারে তা হল ১৯২৯-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে ‘মহুয়া’র প্রচ্ছদটি লিনোকাট বলে মনে হয়। কিছুটা চিনে ক্যালিগ্রাফির ধাঁচে বইয়ের পাতা কালো রঙের বিস্তৃত পরিসরে গ্রন্থনামের তিনটি অক্ষর পর পর ভারটিকালি সাজানো। পশ্চাৎপট এবং অক্ষর উভয়েই কালো রঙে রঞ্জিত, কেবল তীক্ষ্ণ সরল রেখার জ্যামিতিক আকারে গঠিত অক্ষর যেন অন্ধকার আকাশপটে রুপোলি বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলসে উঠেছে। উড-কাট বা লিনোকাটের ছবিতে যেমন দেখায় ঠিক তেমনই। তবে এখানে পুরোটাই কালি-কলমে আঁকা হয়েছে, অথচ এফেক্ট হয়েছে কাঠ-খোদাইয়ের। তাহলে কি এই সময় রবিঠাকুর কাঠ-খোদাই ছবি দেখেছিলেন?
২৮.
খয়েরি মলাটে জড়ানো রবীন্দ্ররচনাবলি সাজানো রয়েছে পড়ার ঘরের তাকে। সংখ্যা অনুসারে প্রত্যেকটা খণ্ড পর পর রাখা, যাতে সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। সকাল-সন্ধে সেদিকে তাকিয়ে ভাবি, এই বিপুল সাহিত্য সম্পদের কতটুকুই বা আজ অবধি পড়ে উঠতে পেরেছি! গভীর অনুধ্যানের সঙ্গে পড়ার কথা না-হয় ছেড়ে দিলাম, আলগোছে দৃষ্টিতেই বা এর কত ভাগ পড়েছি? এত কবিতা, এত গান, গল্প-উপন্যাস-নাটক প্রবন্ধ ইত্যাদি কি অনায়াসে উঠে এসেছে তাঁর কলমে! সে কোন অলৌকিক শক্তিবলে? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না– এত লেখা তিনিই লিখেছেন! কোন মায়ামন্ত্রে রচিত হয়েছে এই রচনাসম্ভার, কোন ম্যাজিক স্টিকের সাহায্যে! তবে তাঁর হয়ে কি কলম ধরেছিলেন একাধিক লেখকের একটা টিম? বইয়ের সেলফ অহরহ সেই প্রশ্ন মনের মধ্যে উসকে দিয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়, আছে কয়েক সহস্র চিঠি– যা এখনও পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে প্রকাশ পেয়ে চলেছে! হিসেবমতো কেবল বাংলা চিঠিপত্রের মুদ্রিত খণ্ডই গোটা কুড়ি। তা ছাড়া গ্রন্থিত হতে বাকি এমন অজস্র চিঠি ছড়িয়ে আছে, যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেলেও বইয়ের চেহারা পায়নি। আর ইংরেজি চিঠিপত্র? তার একটা বিরাট সংখ্যা এখনও অগ্রন্থিত, অপ্রকাশিতও। সত্যিই এ বুঝি কোনও মানুষের এক জীবনের পরিসরে সম্ভব নয়। কেবল কি তাই, রবিঠাকুরের মতো অমন খুঁতখুঁতে লিখিয়ে আর দু’টি মেলা ভার, ছাপার অক্ষরে প্রকাশের আগে কতবার তা সংশোধন করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই! কোনও লেখার ফাইনাল প্রুফ তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা– সে ছিল অসম্ভবের শামিল। একেকটা লেখা কতবার করে লিখেছেন, কেটেছেন, বদল করেছেন, শেষবেলায় আবার সংযোজন– তার সাক্ষ্য রবিঠাকুরের একাধিক পাণ্ডুলিপি। যেমন ‘রক্তকরবী’র কথাই ধরা যাক। হিসেব করলে, ‘রক্তকরবী’র পাণ্ডুলিপি সংখ্যা প্রায় ডজন খানেক। এ ছাড়া আরও দুয়েকটা অন্যত্র ছড়িয়ে থাকা আশ্চর্য নয়। ‘যক্ষপূরী’, ‘নন্দিনী’ থেকে ‘রক্তকরবী’ হয়ে উঠতে যে অজস্র পাঠ তার সবগুলো মুদ্রিত হয়েছে কিনা বলা শক্ত। মনে পড়ে, বিড়লা একাডেমীতে রবীন্দ্রনাথের খাতাপত্র চিঠি ইত্যাদির যে সংগ্রহ রক্ষিত, সেখানে ‘নন্দিনী’র একটা টুকরো পাণ্ডুলিপি এক সময় দেখেছিলাম। সেখানেও চোখে পড়েছে পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি আশ্রিত ছবি– যা গড়ে উঠেছে অনেকটা মুখোশের আদলে। পাণ্ডুলিপির সেই পাঠ কোথাও মুদ্রিত হয়েছে বলে জানা নেই। বিড়লা একাডেমির পক্ষ থেকে একবার সেই সংগ্রহ ছাপানোর উদ্যোগ নিয়েও অবশেষে তা বাতিল হয়েছিল কোনও অজানা কারণে। তাই মনে হয়, নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়া রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনার স্বাদ হয়তো চিরকাল আমাদের কাছে অধরা থেকে যাবে! তাঁর লেখা গানের ছত্রের মতো আমাদেরও বুঝি বলতে হবে, রবি ঠাকুরের সমস্ত লেখাকে চেনা এবং জানা আমাদের ‘ফুরাবে না’ শেষও হবে না।
তবে বিস্ময়ের এই ঘোর কাটিয়ে একবার তাকাতে চাই একটু অন্যদিকে। দেখতে চাই রবি, ঠাকুরের এই যে বিপুল বইয়ের সম্ভার, এমন আতিশয্যহীন পরিশীলিত শিল্পসম্মত মুদ্রণ পারিপাট্য– তার প্রচ্ছদ-সহ সামগ্রিক পরিকল্পনা কার হাতে ছিল? নেপথ্যে কি মূলত রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা কাজ করেছে? নাকি তাঁর আশপাশের শিল্পীবৃত্ত এর সবটুকু কাজ সেরে রেখেছেন? না কি প্রকাশনার ক্ষেত্রে রবি ঠাকুরের কথাই ছিল শেষকথা? একথা মনে হয়, বিশ্বভারতীর নিজস্ব প্রকাশনা বিভাগ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী পর্বের দিকে তাকিয়ে। আজ সে দিকে আমাদের নজর রইলো। খেয়াল করলে দেখব, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রথম তাঁর বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদ এঁকেছেন ‘মহুয়া’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। এর আগে প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে দেখেছি নন্দলাল, গগনেন্দ্রনাথ-সহ একাধিক দেশি-বিদেশি শিল্পী। কবির আঁকা প্রচ্ছদ এই প্রথম। তবে ‘মহুয়া’র নেপথ্যে একটা গল্প আছে। বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়ের আয়বৃদ্ধি হতে পারে– এই মনে করে ১৯২৮ নাগাদ বিবাহে উপহারযোগ্য দুয়েকটি বইয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রধানত প্রেমের কবিতা সংকলন, রবীন্দ্রনাথ এমন দু’টি বইয়ের নাম দেন ‘বরণডালা’ ও ‘রাখী’। রানী মহলানবিশের কথায়, ‘১৯২৮ সালে একদিন শ্রীযুক্ত প্রশান্ত মহলানবিশ কবিকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে কবি যদি তাঁর লেখার মধ্যে থেকে বিবাহে উপহার দেওয়ার যোগ্য কবিতাগুলো চয়ন করে দেন তাহলে বিশ্বভারতী পাবলিশিং সোসাইটি একটা আলাদা বই বেশ চকচকে ঝকঝকে করে উপহার দেওয়ার জন্য বের করতে পারে। এতে লোকেদের এই সুবিধে হবে যে কী বই কিনবে, সে ভাবনা ভাবতে হবে না; বিশ্বভারতীরও কিছু আয় বাড়বে। কথাটা কবির পছন্দ হয়েছিল। খুব উৎসাহের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলোচনা করে স্থির করলেন বইখানার নাম হবে ‘বরণডালা’, কারণ বিয়ের উপহারের পক্ষে ঐ নামটাই যোগ্য নাম’।
এইভাবে কিছু পুরোনো আর নতুন কবিতা মিলিয়ে বইয়ের কাজ চলতে থাকে, এর মাঝে হঠাৎ রবিঠাকুর বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলে ওঠেন ‘আমার কি কবিতা লেখার ক্ষমতা চলে গিয়েছে যে একখানা নতুন বই বের করবার জন্যে পুরোনো কবিতা ধার করতে হবে? আমি সব কটাই নতুন কবিতা দেব’। সবাই সানন্দে রাজি, তারপর অনেকগুলো কবিতা লেখা হলে নতুন কবিতার বই ছাপা হল বটে, তবে ‘বরণডালা’ পালটে সে বইয়ের নাম রাখা হল ‘মহুয়া’। এখানে বলে রাখা দরকার, ‘বরণডালা’ বা ‘রাখী’ কোনোটাই কবির জীবদ্দশায় প্রকাশ পায়নি। ৫০ বছর বাদে ১৯৭৮ সালে বিশ্বভারতী থেকে ‘রাখী’ প্রকাশিত হয় কানাই সামন্তের সংকলন ও সম্পাদনায়। এবারে ‘মহুয়া’র প্রচ্ছদ প্রসঙ্গে আসি। রচনাবলির ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশ অনুসারে ‘রবীন্দ্রনাথ-অঙ্কিত প্রচ্ছদে ও রঙিন নামচিত্রে ভূষিত হইয়া ১৩৩৬ আশ্বিনে মহুয়া কাব্যের প্রথম প্রকাশ’। ইংরেজি সময় অনুসারে তা হল ১৯২৯ এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে ‘মহুয়া’র প্রচ্ছদটি লিনোকাট বলে মনে হয়। কিছুটা চিনে ক্যালিগ্রাফির ধাঁচে বইয়ের পাতা কালো রঙের বিস্তৃত পরিসরে গ্রন্থনামের তিনটি অক্ষর পর পর ভারটিকালি সাজানো। পশ্চাৎপট এবং অক্ষর উভয়েই কালো রঙে রঞ্জিত, কেবল তীক্ষ্ণ সরল রেখার জ্যামিতিক আকারে গঠিত অক্ষর যেন অন্ধকার আকাশপটে রুপোলি বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলসে উঠেছে। উড-কাট বা লিনোকাটের ছবিতে যেমন দেখায় ঠিক তেমনই। তবে এখানে পুরোটাই কালি-কলমে আঁকা হয়েছে, অথচ এফেক্ট হয়েছে কাঠ-খোদাইয়ের। তাহলে কি এই সময় রবিঠাকুর কাঠ-খোদাই ছবি দেখেছিলেন?
বিষয়টা ভেবে দেখার। সময়ের নিরিখে ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগ প্রকাশিত হচ্ছে ‘মহুয়া’র কয়েক মাস পরেই, ১৯৩০-এর এপ্রিলে। রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ আগাগোড়া সেজে উঠছে নন্দলালের অজস্র লিনোকাট ছবিতে। যেখানে চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে থেকে আবির্ভূত হচ্ছে বিভিন্ন ফিগার, বিচিত্র সব আকার। আলো আর কালোর সে এক আশ্চর্য সমাহার। রবীন্দ্রনাথ কি নন্দলালের কাজ দেখছিলেন? ‘সহজ পাঠ’ যে ‘মহুয়া’র আগেই তৈরি হয়ে উঠছিল সে আভাস পাই প্রশান্তচন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিতে।
সেখানে লিখছেন, ‘সহজ পাঠের ছবির সাইজ ব্যয়সংক্ষেপের খাতিরে খর্ব করতে চাও এ প্রস্তাবে নন্দলাল দুঃখিত’। সেই চিঠিতেই তাঁর অধীর জিজ্ঞাসা, ‘সহজ পাঠ ছাপা শেষ হতে আর কতদিন দেরি’? অর্থাৎ ১৯২৮-এর আগস্টে মুদ্রিত বইয়ের খোঁজ চলছে। ‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে। মনে হয়, ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকার প্রসঙ্গ বাদ দিলে– ১৯৩০ সালে প্যারিসে কবির চিত্রপ্রদর্শনীর আগে এক অর্থে ‘মহুয়া’র প্রচ্ছদই রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত ছবি, যা কেবল কভার হিসেবে নয়, রবীন্দ্রচিত্রের নিজস্ব শৈলী হিসেবে ঘোষিত। কেবল তাই নয়, এ বইয়ের রঙিন ‘নামচিত্র’ যেন রবীন্দ্রনাথের আঁকা একখানা ল্যান্ডস্কেপ, সন্ধ্যার গাঢ় ছায়া সেখানে পট জুড়ে নেমে এসেছে। পাশাপাশি, ‘মহুয়া’র অগ্রজা ‘রাখী’ আর ‘বরণডালা’র মধ্যে ‘রাখী’র দু’টি প্রচ্ছদ চোখে পড়ে। যার একটি প্রায় সাদা-কালোতে আঁকা, যার অক্ষরের গড়ন রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে– ‘তীরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কাঁটার মতো। ফুলের মতো নয়, বিদ্যুতের রেখার মতো। ন্যুরালজিয়ার ব্যথার মতো। খোঁচাওয়ালা কোণওয়ালা গথিক গির্জের ছাঁদে, মন্দিরের মণ্ডপের ছাঁদে নয়’। রাখীর মনোক্রম কভারটি এইরকম, আরেকটি প্রচ্ছদ উজ্জ্বল লালকালোতে ঝলমল করে উঠেছে। ‘রাখী’ এই শব্দকে সেখানে যেন ঘিরে আছে রজনীগন্ধার এক ছড়া ছিন্ন মালা। এ ছবি ছাপা হয়নি, নইলে প্রায় এ ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথের আঁকা কভার ডিজাইনের এক অভিনব নমুনা আমাদের কাছে ধরা দিত।