১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পুনশ্চ’ ছবিতে সেই টানাপোড়েন দেখিয়েছেন মৃণাল সেন। আবার কোনও কোনও পুরুষ ভালো মনেই মেনে নিতেন বাড়ির মেয়েদের কাজে যাওয়া। হাত লাগাতেন বাড়ির কাজে। মালতী মজুমদার যেমন বলছিলেন, রাতে তরকারি কুটে পরের দিন সকালের কাজ এগিয়ে রাখতেন তিনি। বউমা ভূতের ভয় পাবে বলে পাশের চৌকিতে বসে থাকতেন শ্বশুর। স্মৃতি দাশ বলছিলেন, তিনি দিল্লিতে বদলি হয়ে গেলে তাঁর স্বামীই দেখতেন দুই সন্তানকে।
২৭.
পাশে দু’খানা ঘরে ভাড়া নিয়ে থাকে একা রমণীটি
স্বামীপরিত্যক্তা। একা। নাকি নিজে পালিয়ে এসেছে?
কেরানি মার্চেন্ট ফার্মে। সন্ধ্যায় সেই মক্ষীরানি
সাজগোজ দৃষ্টিকটু, পাড়ার লোকের চোখে বালি।
এই বিশ্রী পরিবেশে নরেনের লেখা হয় নাকি?
হাতে কিন্তু ভারী কাজ। চাপ, দেহে মনে।
কেউ তো জানে না তিনি নামাচ্ছেন বাংলায় প্রথম
কর্মরতা মহিলার জীবনের মৌলিক কাহিনি…
নরেন্দ্রনাথ মিত্র সিরিজ: ২
(দেহমন: ১৯৫০), যশোধরা রায়চৌধুরী
আমাদের লেখায় বারে বারে এসেছে নরেন্দ্রনাথ মিত্রর লেখার প্রসঙ্গ। বস্তুত, প্রথম যুগের ‘চাকরি-করা মেয়ে’দের জীবনের জটিলতা তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা এক কথায় তুলনারহিত। বিশ্বযুদ্ধ আর দেশভাগের পরে মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েদের অনেকেই চাকরি করতে বেরন, বিশেষত ওপার বাংলার বাস্তুহারা মেয়েরা। এতকাল যাঁরা ছিলেন ঘরের ভিতরে, সংসারের কাজে উদয়াস্ত নিরত, তাঁরা যখন প্রথম বাইরে বেরলেন, তখন পুরুষেরা কী চোখে দেখলেন তাঁদের? মূলধারার সাহিত্যিকরা অবশ্য সেই যুগের মেয়েদের বদলে যাওয়া জীবনকে নরেন্দ্রনাথ মিত্রর মতো সংবেদনশীল চোখে দেখেননি। সেলস গার্ল, শিক্ষিকা, সমাজকল্যাণ দফতরের মহিলাকর্মী, ডাক্তার, নার্স, অভিনেত্রী, মায় বিমানসেবিকা– বিচিত্র পেশার মেয়েদের কথা লিখেছেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর বহু কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে ঘরে-বাইরে চাকরিরতাদের লড়াই। তবু মহিলাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জিনিসটাকে ভালো চোখে দেখেননি লেখক আশুতোষ। ‘আশা আর বাসা’ গল্পে আশুতোষ দস্তুরমতো তত্ত্ব খাড়া করেন, আশা আর বাসা– দুটোকে একসঙ্গে বাড়ানো যায় না, বিশেষত, কোনও মহিলার এজেন্সির (সক্রিয় উদ্যোগ) মাধ্যমে তো নয়-ই। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ বেঁধে দেয় সংসার-জীবনের নিয়ম-নীতি।
সেই যুগের পুরুষের চোখে মেয়েদের জীবনযুদ্ধ, তাঁদের বঞ্চনা আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কাহিনি কীভাবে ফুটে উঠত, আজকের কিস্তিতে সে কথাই তুলে ধরব।
ছয়ের দশকে বারাসত হাসপাতালে টিবি হেলথ ভিজিটরের চাকরি করতেন কবিতা রায়চৌধুরী। তাঁর কথা পাই জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মেয়েলি জীবন, ভাগাভাগির পরে’ প্রবন্ধে। কবিতার কথায়, “প্রথম দিন গেছি… আমাকে চাবি দিয়েছে, তালাটা আর খুলতে পারি না! যে ভদ্রলোক চাবিটা দিয়েছেন, তাঁর কী হাসি– ‘চাকরি করতে এসেছে, তালাই খুলতে পারে না!’ পরে অবশ্য বেশ মিলমিশ হয়ে গিয়েছিল।”
আমাদের কাজের সূত্রে প্রথম যুগের চাকরিরতাদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে এমন নরমে-গরমে কেটেছে তাঁদের কর্মজীবন। একই প্রবন্ধে পাই সূর্যনগরের বাসিন্দা অজিত দণ্ডের কথা– “প্রথম প্রথম কয়েক বছর মেয়েরা চাকরি করত না তেমন… আমি বলতে পারি, ডালহৌসিতে ওয়ান পার্সেন্ট মেয়েও চাকরি করত না… ওই সুযোগটা তো বিধান রায় করে দিলেন… আমার স্পষ্ট মনে আছে, পেপারে দিছিল, বিধান রায়কে কোট করে…‘এখানে আমি ফুল ফুটাব।’ এর ভাল-মন্দ দুইটাই আছে। অনেকের সুবিধা হচ্ছে, আবার আমি বলব, এতে ছেলেদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে…।”
মেয়েরা ছেলেদের প্রতিযোগী হয়ে আসায় ছেলেরা বিপন্নতায় ভুগছে, অস্বস্তি বোধ করছে, যাতায়াতের পথে বা কর্মক্ষেত্রে তাদের বিরূপ আচরণে তারই প্রকাশ ঘটছে– এমন নজির ছড়িয়ে রয়েছে সিনেমায়, সাহিত্যে। আমরা সেই সব বারবার তুলে ধরেছি আমাদের আগের পর্বগুলিতে।
শক্তিপদ রাজগুরুর ‘মেঘে ঢাকা তারা’র কাহিনিতে আমরা দেখি, নীতা মাথা ঘুরে পড়ে গেলে তার পুরুষসঙ্গীরা অশ্লীল ইঙ্গিত করে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তার শিকার হয় ‘মহানগর’-এর আরতি, ‘অনুপমা’ ছবির অনুপমা (১৯৫৫)। অনুপমাকেও শুনতে হয়– মেয়েরা চাকরিতে ঢুকছে বলেই ছেলেগুলো চাকরি পাচ্ছে না। ‘কাচ কাটা হীরে’ ছবিতে অফিসে উমার ফোন এলে পুরুষ সহকর্মীরা হাসাহাসি করে, বিশ্রী ইঙ্গিতে তাকে লজ্জায় ফেলে (১৯৬৬)।
এ-সব সামলে কর্মস্থলে টিকে থাকতে মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে বেশি বেশি কাজ করতেন, মন দিয়ে কাজ করতেন, সময়ে আসতেন, সময়ে বেরতেন। ‘খেরোর খাতা’য় লীলা মজুমদার লিখছেন, “ঢের বেশি যত্ন নিয়ে কাজ করত মেয়েরা, ওপরওয়ালারা খুব খুশি হতেন। পুরুষ সহকর্মীরা হিংসে করে বলত, ‘মেয়েদের বুদ্ধি কম কিনা, না খাটলে ওদের চলবে কেন! আমরা কেমন ম্যানেজ করে নিই দেখেননি?” ‘ম্যানেজ করা’ মানে কাজ না করে ধরা না পড়া। লীলা মজুমদার দেখিয়েছেন সংসারে এই ‘ম্যানেজ করা’য় মেয়েদের ব্যুৎপত্তি চিরকালীন।
লীলা মজুমদারের মতে, অফিসে ভালো কাজ করে মেয়েদের আত্মসম্মান এত বেড়ে যেত যে, তাঁরা সামান্য কাজের জন্য টেবিলে ঘণ্টি বাজিয়ে অধস্তন পুরুষ সহকর্মীকে ডেকে পাঠাতেন। নিজের হাতে তাঁরা পাখার সুইচ টিপতেন না, কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেতেন না। বাড়িতেও এই ‘মেয়ে চাকর’রা পারতপক্ষে হেঁশেলে ঢুকতেন না। রান্নার লোক রেখে কাজ সারতেন।
তবে লীলা মজুমদার হয়তো উচ্চবিত্ত মহিলাদের কথা লিখেছেন। আমরা যে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা অনেকেই বাড়িতে হেঁশেল সামলে তবেই অফিসে যেতে পারতেন।
বাড়ির পুরুষেরা কী চোখে দেখতেন কর্মরতাদের? কেউ নিজের উৎসাহে সচ্ছলভাবে থাকার জন্য কাজে পাঠাতেন বাড়ির মেয়েদের। কেউ বা মনে মনে আপত্তি পুষে রাখতেন, একার রোজগারে সংসার টানতে না পারার গ্লানি কুরে কুরে খেত, পুরুষের আত্মমর্যাদায় ঘা দিত। মেয়েদের রোজগারে কার অধিকার, পিতৃকুল না শ্বশুরকুলের, তা নিয়েও গোল বাধত সে যুগে, যেমন বাধে এ যুগেও।
১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পুনশ্চ’ ছবিতে সেই টানাপোড়েন দেখিয়েছেন মৃণাল সেন। আবার কোনও কোনও পুরুষ ভালো মনেই মেনে নিতেন বাড়ির মেয়েদের কাজে যাওয়া। হাত লাগাতেন বাড়ির কাজে। মালতী মজুমদার যেমন বলছিলেন, রাতে তরকারি কুটে পরের দিন সকালের কাজ এগিয়ে রাখতেন তিনি। বউমা ভূতের ভয় পাবে বলে পাশের চৌকিতে বসে থাকতেন শ্বশুর। স্মৃতি দাশ বলছিলেন, তিনি দিল্লিতে বদলি হয়ে গেলে তাঁর স্বামীই দেখতেন দুই সন্তানকে।
কর্মক্ষেত্রে সম্পর্ক তৈরি হলে অনেক সময়ে মিলে যেত ঘর আর বাহির। এ প্রসঙ্গেও মনে পড়ে লীলা মজুমদারের ‘মেয়ে-চাকরে’ প্রবন্ধটি। এক পুরুষ অফিসার টাকার লোভে বড়লোকের অশিক্ষিত, সে কালের স্ট্যান্ডার্ডে অসুন্দর এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। সে মেয়েকে কিছু দিন পরে ছেড়ে এসে আরেকটা বিয়ে করে। এদিকে তার প্রথম স্ত্রীকে লেখাপড়া শিখিয়ে ‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স’ থেকে পাশ করিয়ে আনল তার বাবা। মেয়েটি একটি বড় চাকরি পেয়ে অফিসের ‘বড় সাহেব’ হল। ঘটনাচক্রে সেই অফিসেই ‘একজন খুব ছোট সাহেব’-এর পদে কাজ করত তার স্বামী। মেয়েটি তাকে শক্ত শক্ত কাজ আর কড়া কড়া নোট দিতে থাকে। শেষে অসুবিধাজনক একটি জায়গায় বদলি করে নারীজাতির সম্মান রাখে।
তথ্যসূত্র:
‘মেয়েলি জীবন, ভাগাভাগির পর’, জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘দেশভাগ: স্মৃতি আর স্তব্ধতা’, সম্পা. সেমন্তী ঘোষ, গাঙচিল, ২০০৮।
… পড়ুন চৌকাঠ পেরিয়ে কলামের অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ২৬: বিজ্ঞাপনে উপার্জনক্ষম পাত্রীর খোঁজ পাওয়া যায় ১৯৫০ সাল থেকেই
পর্ব ২৫: রান্নাঘরে প্রযুক্তির দৌলতে চাকুরিরতা মেয়েরা সময়কে বাগে আনতে পেরেছিলেন
পর্ব ২৪: চাকরিরতা মায়েদের সুবিধার্থে তৈরি সন্তান পরিচর্যার ক্রেশ কলকাতায় বন্ধ হয়েছে বারবারই
পর্ব ২৩: ‘কে তুমি নন্দিনী’র মধ্যে কি লুকিয়েছিল চাকরিরতা মেয়েদের প্রতি সস্তা রসিকতা?
পর্ব ২২: প্রথম যুগের মেয়েরা কি আদৌ চাকরিতে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলেন?
পর্ব ২১: উদ্বাস্তু, শিক্ষক বা খাদ্য আন্দোলনে চাকুরিরতা মেয়েদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো
পর্ব ২০: অদক্ষ হলেও চলবে, কিন্তু মেয়েলি বৈশিষ্ট্য না থাকলে চাকরি পাওয়া ছিল দুষ্কর!
পর্ব ১৯: শৌচাগার নেই, এই অজুহাতে মেয়েদের চাকরি দেয়নি বহু সংস্থা
পর্ব ১৮: অফিসে মেয়েদের সখ্যকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিছক পরনিন্দা-পরচর্চার ক্ষেত্র মনে করেছিল
পর্ব ১৭: পুরুষ সহকর্মীদের ‘বন্ধু’ ভাবতে অস্বস্তি হত পাঁচ ও ছয়ের দশকের চাকুরিরতাদের
পর্ব ১৬: ট্রামের স্বস্তি না বাসের গতি, মেয়েদের কোন যান ছিল পছন্দসই?
পর্ব ১৫: অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শই শুধু নয়, চৌকাঠ পেরনো মেয়েরা পেয়েছিল বন্ধুত্বের আশাতীত নৈকট্যও
পর্ব ১৪: লীলা মজুমদারও লেডিজ সিট তুলে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন!
পর্ব ১৩: অল্পবয়সি উদ্বাস্তু মহিলারা দেহব্যবসায় নেমে কলোনির নাম ডোবাচ্ছে, বলতেন উদ্বাস্তু যুবকরা
পর্ব ১২: মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবির মিঠুর মতো অনেকে উদ্বাস্তু মেয়েই চাকরি পেয়েছিল দুধের ডিপোতে
পর্ব ১১: প্রথম মহিলা ব্যাঙ্ককর্মীর চাকরির শতবর্ষে ব্যাঙ্কের শ্রমবিভাজন কি বদলে গিয়েছে?
পর্ব ১০: সেলসগার্লের চাকরিতে মেয়েরা কীভাবে সাজবে, কতটা সাজবে, তা বহু ক্ষেত্রেই ঠিক করত মালিকপক্ষ
পর্ব ৯: স্বল্পখ্যাত কিংবা পারিবারিক পত্রিকা ছাড়া মহিলা সাংবাদিকরা ব্রাত্য ছিলেন দীর্ঘকাল
পর্ব ৮: অভিভাবকহীন উদ্বাস্তু মেয়েদের ‘চিরকালীন বোঝা’র তকমা দিয়েছিল সরকার
পর্ব ৭: মেয়েদের স্কুলের চাকরি প্রতিযোগিতা বেড়েছিল উদ্বাস্তুরা এদেশে আসার পর
পর্ব ৬: স্বাধীনতার পর মহিলা পুলিশকে কেরানি হিসাবেই দেখা হত, সেই পরিস্থিতি কি আজ বদলেছে?
পর্ব ৫: প্রেম-বিবাহের গড়পড়তা কল্পকাহিনি নয়, বাস্তবের লেডি ডাক্তাররা স্বাধীনতার নিজস্ব ছন্দ পেয়েছিলেন
পর্ব ৪ : নার্সের ছদ্মবেশে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও যৌন হেনস্তার কবলে পড়তে হয়েছিল
পর্ব ৩ : উদ্বাস্তু মেয়েদের রোজগারের সুযোগ মিলেছিল টাইপ-শর্টহ্যান্ডের কাজে
পর্ব ২ : পিতৃতন্ত্রের কাঠামোয় কিছু ফাটল নিশ্চয়ই ধরিয়েছিলেন সে যুগের মহিলা টেলিফোন অপারেটররা
পর্ব ১ : দেশভাগের পর ‘চঞ্চল চক্ষুময়’ অফিসে চাকুরিরত মেয়েরা কীভাবে মানিয়ে নিলেন?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved