রিনামাসি বলেছিল– এক্সপোজার, শাটার স্পিড– ইত্যাদি খুঁটিনাটি জানতে পারায় রিনাদির কাছে ক্যামেরা ব্যাপারটা অনেকটা খোলসা হয়েছে। ওকে গৌতমদা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কোনটার সঙ্গে কোনটা সম্পর্কিত। ফলে, ছবি তোলাটাও খানিকটা আয়ত্তে এসেছিল। গৌতমদাই মনে করিয়ে দিয়েছিল রিনামাসির একটা চমৎকার ছবির কথা। আলিপুর ব্রিজের ওপর একটা শকুনের ছবি।
১৫.
আজকে যে-ছবিটা আপনারা দেখবেন, তা ২০১৩ সালে আমার তোলা রিনামাসির ছবি। যদিও এর আগে-পরে বহু সময়ে, বহু বার ওর ছবি তুলেছি। ওর স্বামী, কল্যাণ রায়ের সুবাদেই এটা সম্ভব হয়েছে। কল্যাণদা কখনও আমাকে ছবি তুলতে বারণ করেনি। এমনকী, কল্যাণদা লিখছে, আমি ছবি তুলছি– এমনও হয়েছে, অথচ এতটুকু বিরক্ত হয়নি। কিন্তু এত যে ছবি তুলেছি নানা সময়ে ওদের বাড়িতে, সেসবের মধ্যে রিনামাসির মতে, মাত্র কয়েকখানাই ছবিই ঠিকঠাক– আজকের ছবিটা তারই মধ্যে একটা। একবার রিনামাসি বলেছিল, ‘আমাকে আর কল্যাণকে শুট করিস।’ সেদিন সারাদিনই রিনামাসি ও কল্যাণদার সঙ্গে অন্য কাজ করছিলাম। ফলে ছবি তুলতে তুলতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।
………………………………………………………………………….
কফিহাউসে আড্ডা মারছেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, কমলকুমার মজুমদাররা। চিদানন্দবাবুর তোলা একটা ছবি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেই ছবির বিষয়বস্তু: জলের মধ্যে এক শিশুর খাবার পড়ে গিয়েছে। এবং তার মুখে-চোখে এক অদ্ভুত বিরক্তি ও বিষাদ। সেই ছবি দেখে কমলকুমার মজুমদার রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘ওর খাবার পড়ে গিয়েছে জলে, তুমি পরবর্তীকালে ওকে কিছু কিনে দিয়েছিলে তো?’
………………………………………………………………………….
মাত্র ১০ বছর বয়সেই রিনামাসি একটা ‘বেবি ব্রাউনি’ ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু করেছিল। রিনামাসি বলেছিল, পরে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর ছবির তোলার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। আর এমনিও রিনামাসি ছোট থেকেই কাজ করছে, অভিনয় করছে, ফলে একটা পরিবেশ পেয়েছিল। সাতের দশকে গৌতম ঘোষ ওকে অ্যানালগ ক্যামেরায় ছবি তোলা শেখান। অপটিক্স, মিটার, লেন্স, লাইটের নানা রকম ব্যবহার।
ছোটবেলার সেই ছবি তোলার ইচ্ছে আবার ফিরে আসে এই সময়টায়। রিনামাসি বলেছিল– এক্সপোজার, শাটার স্পিড– ইত্যাদি খুঁটিনাটি জানতে পারায় রিনাদির কাছে ক্যামেরা ব্যাপারটা অনেকটা খোলসা হয়েছে। ওকে গৌতমদা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কোনটার সঙ্গে কোনটা সম্পর্কিত। ফলে, ছবি তোলাটাও খানিকটা আয়ত্তে এসেছিল। গৌতমদাই মনে করিয়ে দিয়েছিল রিনামাসির একটা চমৎকার ছবির কথা। আলিপুর ব্রিজের ওপর একটা শকুনের ছবি। রিনামাসি কিন্তু ছবি তোলা দেখেছে অনেককাল ধরেই। ওর বাবা, চিদানন্দ দাশগুপ্তও ছিলেন অ্যামেচার ফোটোগ্রাফার, কিন্তু ছবি তুলে গিয়েছেন ধারাবাহিকভাবেই।
চিদানন্দবাবুর ছবি তোলার ব্যাপারে একটা মজার ঘটনা বলি। গৌতমদার কাছ থেকে এই গপ্পটা শোনা। কফিহাউসে আড্ডা মারছেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, কমলকুমার মজুমদাররা। চিদানন্দবাবুর তোলা একটা ছবি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেই ছবির বিষয়বস্তু: জলের মধ্যে এক শিশুর খাবার পড়ে গিয়েছে। এবং তার মুখে-চোখে এক অদ্ভুত বিরক্তি ও বিষাদ। সেই ছবি দেখে কমলকুমার মজুমদার রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘ওর খাবার পড়ে গিয়েছে জলে, তুমি পরবর্তীকালে ওকে কিছু কিনে দিয়েছিলে তো?’
………………………………………………………………………….
পড়ুন প্রকাশ দাসের লেখা: রামকিঙ্করের রাধারানি: শান্তিনিকেতনের শিল্পকলা সাম্রাজ্যের প্রথম নগ্নিকা মডেল
………………………………………………………………………….
’৭৫ সালে পাহাড়ের কোনও একটা জায়গায়, ‘নিশিমৃগয়া’র শুটিং চলছিল। পরিচালক ছিলেন দীনেন গুপ্ত। রিনামাসির সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন আমার বাবা– বসন্ত চৌধুরীও। ওই শুটিংয়ের সময়ই বাবার কিছু ছবি তুলেছিল রিনামাসি। সই-ও করে দিয়েছিল ছবিতে। চমৎকার সেইসব ছবি, পরে আমি ব্যবহারও করেছিলাম।
আমার কাছে রিনামাসির তোলা আট ও নয়ের দশকের কিছু ছবির নেগেটিভ স্ক্যান করা রয়েছে। ফিল্মে ছবি তোলা থেমে গেল রিনামাসির, যবে থেকে শুরু করল আইফোন ব্যবহার করা। যদিও ছবি তোলা মোটেই ছাড়েনি। এখন আইফোনেই চমৎকার সব ছবি তুলে রিনামাসি নিয়মিত আমাকে পাঠায়। সেসব ছবি নিয়ে কথাবার্তাও হয়।
আমি ও রিনামাসি– দু’জনে মিলে অনেকবার ভেবেছি, যে, একটা এগজিবিশন করব ওর ছবির। যেহেতু অনেক দিন ধরে ওর ছবি দেখার একটা অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে আমার। রিনামাসি বলেছে, ‘এগজিবিশনটা তুই কিউরেট করিস।’ অনেকবার সেইসব ছবি নিয়ে বসা হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে ছবি নিয়ে। এমনকী, গ্যালারিতেও যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু শেষমেশ হয়ে ওঠেনি। আশা করি, সেই এগজিবিশনটা শিগগিরই হবে, কী বলো রিনামাসি?
…পড়ুন ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৪। তাল ও সুর দিয়ে তৈরি এক গ্রহে থাকতেন উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ
পর্ব ১৩। মৃণাল সেনকে এক ডলারেই গল্পের স্বত্ব বিক্রি করবেন, বলেছিলেন মার্কেস
পর্ব ১২: পুরনো বাড়ির বারান্দায় মগ্ন এক শিল্পী
পর্ব ১১। প্রায় নির্বাক গণেশ পাইন আড্ডা মারতেন বসন্ত কেবিনে
পর্ব ১০। আজাদ হিন্দ হোটেল আর সুব্রত মিত্রর বাড়ির মধ্যে মিল কোথায়?
পর্ব ৯। শান্তিনিকেতনের রাস্তায় রিকশা চালাতেন শর্বরী রায়চৌধুরী
পর্ব ৮। পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
পর্ব ১। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল