আমি রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ার আগে এই মানুষটিকে প্রায় ভাবতে চেষ্টা করি। মুসুরির ল্যান্ডোর। সোজা খাড়াই উঠেছে মুসুরি থেকে। সেখানে জঙ্গল আর পাহাড় ঘেরা তাঁর আইভি কটেজ। লেখার টেবিলে বসে নব্বুই বছর বয়েসে তিনি লিখছেন আরো একটি নতুন বই। তাঁর লেখার টেবিল তাঁকে বলছে, রাস্কিন তোমাকে এবার লিখতেই হবে অ্যাবাউট ইওর লাভ অ্যান্ড লস, অ্যাবাউট ইওর ফ্রেইলটিস অ্যান্ড লোনলিনেস।
৩৪.
কিনেছিলাম ২২ জুন শনিবার ২০২৪-এর রাত্রে প্রেস ক্লাবে। তরুণ সেখানে এসে বইটা দিয়েছিল আমার হাতে। বইয়ের নাম ‘হোল্ড অন টু ইওর ড্রিমস’। লেখক রাস্কিন বন্ড। পেঙ্গুইন বুকস থেকে প্রকাশিত। সমস্ত বইটা একটা চিঠি: ‘আ লেটার টু ইয়ং ফ্রেন্ডস’। যতদূর জানি ২০২৪-এ প্রকাশিত এই বই এখনও পর্যন্ত রাস্কিন বন্ডের সাম্প্রতিকতম। এর পর তাঁর আর কোনও বই বেরোয়নি।
তাঁর বয়স নব্বুই। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। মায়োপিয়া বেড়েই চলেছে। ঠাওর করতে না পেরে তাঁর ভালোবাসার বেড়াল মিনুর ওপরে বসে পড়েছিলেন: ‘My eyesight is terribly poor now and one sunny morning, book in hand, I sat down in my easy chair, only to rise immediately, for I had sat on Minu. She shrieked in anguish for I am no lightweight. I apologized humbly and took my book elsewhere, leaving her the sole occupant of the easy chair.’
এখন কিন্তু চেয়ারটা পুরোপুরি মিনুর। ও নিজের অধিকারের জোরে চেয়ারটা পেয়েছে। এবং সেখান থেকে কটমট করে আমাকে দেখছে, যাতে আমি আর কাছে ঘেঁষতে না সাহস পাই। আমি যদি অন্য মানুষ হতাম গল্পটাও অন্য রকম হত। ওই অন্য লোকটা মিনুকে চেয়ার থেকে তুলে জানালা দিয়ে বের করে দিত। এমনকী, ছুড়েও ফেলে দিতে পারত। কিন্তু মিনু আমাকে খুব ভালো করেই চেনে। মিনু জানে আমার বিবেক আছে। নীতিবোধ আছে। আমি অতটা হৃদয়হীন হতে পারব না। মিনু আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে বুঝেছে জন্তু-জানোয়ারের বিবেক বলে কিছু নেই। ওটা মানুষের থাকে। মিনু নিজের কিন্তু কোনও বিবেক নেই। ইঁদুর ধরে সেটাকে খতম করার আগে তাকে খুব যন্ত্রণা দেয়। কিছু মানুষও মিনুর মতোই বিবেকহীন। এই ধরনের মানুষের মধ্যে জন্তুর ভাবটাই বেশি। মানুষের ভাগ কম। মানুষ হয়েও তারা অন্য মানুষদের অত্যাচার করে।
মিনু বোমা বানাতে পারে না। কিছু মানুষ বোমা তৈরি করে। যাতে সেই সব বোমা অন্য মানুষরা ব্যবহার করতে পারে। মানুষের এই এত বুদ্ধি খরচ হচ্ছে এমন কিছু তৈরি করতে যা একদিন মানবজাতিকেই শেষ করবে। কিন্তু আমরা কি রক্ষার যোগ্য? মনে তো হয় না, যখন ভেবে দেখি মানুষ নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস চাইছে।
কী চমৎকার লেখা বলুন! ভালো লাগছে না পড়তে? রাস্কিন বন্ড আমার মন খারাপের ওষুধ। যত বয়স বাড়ছে, মনখারাপ বাড়ছে। মনের আর কী দোষ? যেদিকে তাকাচ্ছি শুধু ধস নামছে। সামলাবার উপায় নেই। এই চুরি, জোচ্চুরি, লোভ, মিথ্যে কথা, নিষ্ঠুরতা, হানাহানি, ক্ষমতা আর অর্থ উপার্জনের মতলব ও শঠতা, এবং মতিহীন দিশাহারা দৌড়– এই সব মিলিয়ে আমি বিশ্বাস করুন, খুব খারাপ আছি। এবং মনের কথা বলার মতো, বোঝার মতো কোনও মানুষ নেই চারপাশে। আমি বেঁচে আছি একটি মূল কারণে: বই পড়তে ভালো লাগে তাই। আর একটা ভালো বই পড়ার পর যখন বুঝতে পারি নিজে কতটা খারাপ লিখি– মনখারাপ লাগে, কিন্তু হতাশ হই না। ওই মনখারাপটা লেখা নিয়ে নতুন করে ভাবায়। লিখতে শিখি।
কিন্তু রাস্কিন বন্ডের ‘লেটার্স টু ইওর হার্ট’, ‘লোন ফক্স ডান্সিং’, ‘লুকিং ফর দি রেইনবো: মাই ইয়ার্স উইথ ড্যাডি’, ‘কামিং রাউন্ড দি মাউন্টেইনস’, ‘ফলিং ইন লাভ এগেন’, ‘গোল্ডেন ইয়ার্স’, ‘মাই টল গ্রিন ফ্রেন্ডস’ এইসব কেন বারবার পড়ি জানেন, কেন আমার বিছানার পাশে সারিবদ্ধ রাস্কিন বন্ড? কেননা এই মহৎ মানুষ এবং লেখকটির সরল সোজা মনটিকে আমি ভালোবাসি। আর ভালোবাসি তাঁর লেখার ভাষা, তাঁর ভাবনার প্রাণস্পর্শ, তাঁরা বেদনার মর্মিতা। যে কয়েকবার দেখা হয়েছে– তাঁর সঙ্গে কথা বলে, তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে, তাঁর সঙ্গে সাইডার পান করে মুগ্ধ হয়েছি। যখন খুব গভীর বিষাদে ভুগি, পালাতে চাই, কোথায় পালাই, কোথা ভেসে যাই– তখনই পড়ি বন্ড। রাস্কিন বন্ড। আসতে আসতে মেঘ কাটে। মনখারাপ পাতলা হয়, ফেরে প্রত্যয়। কখনও কখনও রামধনু। বিষাদের মেঘের গায়ে সাতটি ভিজে রং। খুব কি খারাপ? রাস্কিন বন্ডের কাছে আমার এই প্রাপ্তির মূল্য আরও বুঝতে পারছি প্রান্ত বয়সে। ক’দিন আগের কথা বলি। ঘুমিয়ে পড়ার আগে খাটে ঠেস দিয়ে, হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে পড়ছি এই ভাষা ও ভাবনার প্রকাশ:
Running after something you desire often creates an elusive target or prey. It is better to let it come to you, as it will if you are any good. Love, success, happiness and wealth are inclined to take fright and vanish if you pursue them too ferociously. The bee or the butterfly must come to the flower. The flower doesn’t have to go anywhere.
ফুলকে কোথাও যেতে হয় না। ফুলের কাছে সবাই আসে। এর পর দীর্ঘ চিঠির শেষে বন্ড লিখলেন:
So hang on to your dreams, my young friends. Don’t give up on them. They keep us going, and along the way, there are many pleasant diversions.
Be kind my friends. Be wise and strong and do not take from anyone their dream, their song.
আমি রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ার আগে এই মানুষটিকে প্রায় ভাবতে চেষ্টা করি। মুসুরির ল্যান্ডোর। সোজা খাড়াই উঠেছে মুসুরি থেকে। সেখানে জঙ্গল আর পাহাড় ঘেরা তাঁর আইভি কটেজ। লেখার টেবিলে বসে নব্বুই বছর বয়েসে তিনি লিখছেন আরও একটি নতুন বই। তাঁর লেখার টেবিল তাঁকে বলছে, রাস্কিন তোমাকে এবার লিখতেই হবে অ্যাবাউট ইওর লাভ অ্যান্ড লস, অ্যাবাউট ইওর ফ্রেইলটিস অ্যান্ড লোনলিনেস। আর আপনি টেবিলটাকে বলছেন, লিখেছি তো সব কথা আমার আত্মজীবনী ‘লোন ফক্স ডান্সিং’-এ। টেবিল বলল, না লেখনি, তোমার বিয়ে না-করার কথা। সত্যি কথাটা তোমাকে লিখে যেতেই হবে। মাঝে মাঝে একটা ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। রাস্কিন বন্ড লিখছেন তাঁর শেষ মাস্টার পিস। হিমালয় জ্বলছে তাঁর জানলায়। আর একটা মস্ত বড় জংলি চাঁদ উঠেছে আইভি কটেজ ভাসিয়ে দিয়ে। তিনি কলম ধরেছেন শেষ বারের মতো। সমস্ত ভারত অপেক্ষায়।
আর অপেক্ষায় রাস্কিন বন্ডের আইনানুসারে দত্তক নেওয়া নাতনি সৃষ্টি বন্ড, যে মেয়েটিকে ছোট্টবেলা থেকে মনের মতো করে তৈরি করেছেন ইংরেজ লেখক-দাদু আর যার সঙ্গে খুনসুটি করতে সেলিব্রিটি লেখক-দাদুর সবথেকে ভালো লাগে। ‘প্রতি সকালে সৃষ্টি আমার জন্যে তৈরি করে পৃথিবীর সেরা মিল্ক স্ট্রবেরি শেক। যার স্বাদ-গন্ধ-রং আমার জীবনে সবচেয়ে লোভনীয় গিফ্ট’, লিখেছেন রাস্কিন বন্ড!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল