ভালোবাসার চিঠি এখন আর কেউ লেখে না! চিঠির যুগটাই তো মরে ভূত হয়েছে। গোয়েটের ‘ওয়ার্থার’র মতো উপন্যাস, যে উপন্যাসের সবটাই প্রায় প্রেমপত্র, আর লেখা হবে বলেও মনে হয় না। গোয়েটের উপন্যাসের মতো রোমান্টিক উপন্যাস খুব কম পড়েছি জীবনে। এই উপন্যাসের নায়ক শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করছে। এক সময় ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই উপন্যাস নিষিদ্ধ হয়। কারণ, এই উপন্যাসে গোয়েটের লেখায় ভালোবাসার চিঠি নারী-পুরুষ– উভয়ের মধ্যেই সুইসাইডের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
৪০.
ইয়োহান ভলভগাং ভন গোয়েটে (১৭৪৯-১৮৩২) আমার মাস্টারমশাই। তাঁর ‘The Sorrows of Young Werther’ পড়ে আমি লিখতে শিখি ভালোবাসার চিঠি।
ভালোবাসার চিঠি এখন আর কেউ লেখে না! চিঠির যুগটাই তো মরে ভূত হয়েছে। গোয়েটের ‘ওয়ার্থার’র মতো উপন্যাস, যে উপন্যাসের সবটাই প্রায় প্রেমপত্র, আর লেখা হবে বলেও মনে হয় না। গোয়েটের উপন্যাসের মতো রোমান্টিক উপন্যাস খুব কম পড়েছি জীবনে। এই উপন্যাসের নায়ক শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করছে। এক সময় ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই উপন্যাস নিষিদ্ধ হয়। কারণ, এই উপন্যাসে গোয়েটের লেখায় ভালোবাসার চিঠি নারী-পুরুষ– উভয়ের মধ্যেই সুইসাইডের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। গোয়েটেকে বলা হতে লাগল, ডেঞ্জরাসলি রোম্যান্টিক এবং ডেঞ্জারাসলি হ্যান্ডসাম!
এহেন বিপজ্জনক কবি, সাহিত্যিক, ইন্টেলেকচুয়াল– সর্ব বিষয়ে যাঁর প্রজ্ঞা বিস্মিত করে, তাঁর ফ্রাঙ্কফুর্টের বাড়িতে সারাদিন কাটিয়েছে প্রান্তিক আমার নবীন বন্ধু আবির! অনেক দিন হয়ে গেল আবির জার্মানিতে। বুঝতে পারছি, ওখানেই তার শিকড় ক্রমে গভীর হচ্ছে। তবে আমার লেখার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। সে মহা উৎসাহে আমার ‘কাঠখোদাই’-এর জন্য পাঠিয়েছে বিপজ্জনক গোয়েটের লেখার টেবিল আর লেখার ঘরের ছবি!
এই সেই টেবিল যেখানে এই বিপুল জার্মান লেখক লিখেছেন তাঁর সব বিপজ্জনক ভাবনা, লিখেছেন তাঁর ‘ফাউস্ট’-এর মতো বিপজ্জনক পাপের লেখা, সমাজ-সংসার ভাঙার লেখা, লিখেছেন মারাত্মক সব প্রেমপত্র, নাড়িয়ে দিয়েছেন সংসারের ভিত, সমাজের স্থিতি, প্রশ্ন তুলেছেন ন্যায়-অন্যায়ের পরিচিত অবয়ব নিয়ে। এবং এই টেবিলে বসেই ৭২ বছর বয়েসে তাঁর ১৭ বছরের কিশোরী প্রেমিকা উলরিকে ভন লেভেটজো-কে লিখেছেন অসংখ্য তীব্র শরীর-কামুক প্রেমের কবিতা, লিখেছেন উলরিকের ১৭ বছরের মনে দেহে আগুন লাগানো চিঠি, তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন অসাধারণ পাণ্ডিত্য আর সংলাপ বিচ্ছুরণে।
তারপর একদিন বিহ্বল প্রেমিকাকে বলেছেন, ‘যদিও তুমি ১৭ আমি ৭২, পাশের ঘরে আমার বিছানায় গেছ তুমি কতবার, তোমাকে আমি আজও ভাসিয়ে দিতে পারি, করতে পারি দ্রব ও দাত্রী, আমাকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি কোথায়?’ এই লেখার টেবিলে মোমের আলোয় বসন্ত রাত্রে তৃতীয়বার উলরিকে-কে এ-কথা বললেন গোয়েটে। চুমু খেতে খেতে বারবার তাকে শুইয়ে দিলেন এই লেখার টেবিলে। আর বারবার বলতে লাগলেন, ‘নারী-পুরুষের সম্পর্কে কত যে পাপের, আর অন্যায়ের আর অন্ধকার অথচ লোভনীয় বিকৃতির ভাবনা ঢেউ তুলেছে আমার এই লেখার টেবিলে, তুমি কি জানো না সুন্দরী?’
‘জানি, সব জানি আমি’, বলল সেই ১৭ বছরের পরমা! ‘কিন্তু কী করব বল?’
‘কী করবে মানে?’ প্রেমিকাকে আরও একবার শুইয়ে দেন টেবিলের ওপর পৃথিবী-পাগল করা মহা পণ্ডিত লেখক, তারপর ধীরে ধীরে আলগা করতে থাকেন তার বসন। ১৭ বছরের বিভোল সুন্দরী বাধা দেয় না। কী সাবলীলভাবে রাজি হয় সে! বলে, ‘তোমার এই লেখার টেবিল আমাকে অবশ করে দেয়। আমার শরীরের সব জায়গায় ‘হ্যাঁ’ তোমার জন্য। আর কারও জন্য নয়। শুধু তোমাকে বিয়ে করতে বোলো না।’
‘কেন? কেন? কেন?’ চিৎকার করে ওঠেন ভুবন-বিখ্যাত জার্মান লেখক, দার্শনিক, ইন্টেলেকচুয়াল।
১৭ বছরের প্রেমিকা তাঁকে বলে, ‘কারণটা তুমি বুঝতে পারো না? তুমি এত বোঝো আর এইটুকু বুঝতে পারনি? আমার মা তোমাকে আমারই মতো ভালোবাসে। তোমার সঙ্গে আমার সহবাস মা সহ্য করতে পারবে না। আত্মহত্যা করবে।’
পৃথিবী-বিখ্যাত লেখক ও দার্শনিক আবছাভাবে শুধু বলেন, ‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না উলরিক।’
কিশোরী প্রেমিকা টেবিলের ওপর মোমের আলোয় চিৎ হয়ে শুয়ে ধীরে ধীরে গোয়েটের মাথাটি নিজের বুকের মধ্যে আঁকড়ে বলে, ‘আমার মাকে সুইসাইডের পথে ঠেলে দিও না। তোমার জন্যে ইউরোপ জুড়ে অনেক আত্মহত্যা হয়েছে ডার্লিং। এই শেষ পাপটা নাই করলে!’
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৩৯: লেখার টেবিল বাঙালির লাজ ভেঙে পর্নোগ্রাফিও লিখিয়েছে
পর্ব ৩৮: বঙ্গীয় সমাজে বোভেয়ার ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর ভাবনার বিচ্ছুরণ কতটুকু?
পর্ব ৩৭: ভক্তদের স্তাবকতাই পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র-কীর্তি স্থায়ী হতে দেয়নি, মনে করতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী
পর্ব ৩৬: একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে মারিও ভার্গাস লোসা যেন ছবি বিশ্বাস!
পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি
পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল