সাধারণভাবে কেল্লা তৈরি হত একটু উঁচু জমিতে, পাহার বা টিলার উপরে। কিন্তু জলাজমির কলকাতায় আর সেসব কোথায়? তাই কোম্পানি অন্য পথ নেয়। ফরাসি কেল্লা-বিশারদ ভুবাঁর (Vauban) মত অনুসারে উঁচু কোনও স্থাপত্যের বদলে খানিক নিচু, ছড়ানো, সাত-কোণ বিশিষ্ট, বিশেষ জ্যামিতিক আকৃতির কেল্লা বানানোর পরিকল্পনা করে কোম্পানি। আর এরই অনুষঙ্গে আসে কেল্লার আশেপাশের জমি পরিষ্কার করার প্রশ্ন। কেল্লার সীমানা আর শহরের বাড়িঘর রাস্তার মধ্যে বেশ খানিক ফারাক রাখা প্রয়োজন ছিল সুরক্ষার খাতিরে। সেই ভাবনা থেকে গ্রাম-জঙ্গল সাফ করে বিস্তীর্ণ ময়দান তৈরি করা হয়।
২১.
কলকাতার ফুসফুস হিসেবে ময়দানের পরিচিতি বেশ অনেক দিনের। উনিশ-বিশ শতকের নগর পরিকল্পনা বা শহর-স্বাস্থ্যের নানা নথিপত্রে এই কথা পাওয়া যায়। ময়দান রক্ষা করার কথা গত প্রায় দু’শতক জুড়ে নানা সময়ে নানা জন বলে এসেছেন। তবে এই ময়দানের দাবিদারও কম ছিলেন না। এখনও পরিবেশবিদদের সঙ্গে সাধারণ জনতার চাপানউতোর লেগেই থাকে ময়দানকে কেন্দ্র করে। কলকাতা বইমেলা যখন ময়দান থেকে সরিয়ে নেওয়া হল, তখন বই-প্রেমীদের হা-হুতাশ ছিল লক্ষ করার মতো। আজও অনেকে মনে করেন যে, ময়দানের মেলার স্বাদ আর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে এই টানাপোড়েন আজকের নয় শুধু। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই ময়দানের বিস্তীর্ণ এলাকার উপযুক্ত ব্যবহার কীভাবে করা যায়, তাই নিয়ে নানা মত ছিল।
গোড়া থেকেই নতুন ফোর্ট উইলিয়াম আর শহরের মাঝের এই বিশাল খোলা চত্বর নিয়ে টানাটানি ছিল সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে। ঔপনিবেশিক কলকাতায় বিভিন্ন পর্বে সামরিক আর বেসামরিক কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে বা ভারত সরকার আর বাংলার সরকারের মধ্যে কথা কাটাকাটি হত ময়দানকে ঘিরে। কয়েকজনের মনে হত, এই অঞ্চলের কিছু জায়গায় নানা আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করা উচিত। আবার বেশ কিছু মানুষ চিরকালই বিশ্বাস করতেন যে, কলকাতার যে সাধারণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, তার থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে ময়দানের সবুজ, তাই সেখানে কোনও বাড়ি-ঘর বানানোর অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।
এই গড়ের মাঠ তৈরি হয়েছিল আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে যখন নতুন কেল্লা বানানোর কাজ শুরু হয়। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময়ে পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোম্পানি প্রথমে ভেবেছিল সেটাই খানিক মেরামত করে নেওয়া বা পুরনো কেল্লার আশেপাশেই নতুন একটা বানিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু রবার্ট ক্লাইভের মত ছিল আলাদা। তিনি লন্ডনের কর্তাদের রাজি করালেন নতুন কেল্লা গড়ার ব্যাপারে। প্রচুর টাকা খরচ করে প্রায় দু’দশক ধরে বানানো হয়েছিল নতুন ফোর্ট উইলিয়াম। এবং সেই কেল্লা আজকের ডালহাউসি অঞ্চল (যেখানে পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম ছিল) থেকে বেশ খানিক দক্ষিণে সরে এসে নদীর ধারে গোবিন্দপুরে গড়ে উঠেছিল। গ্রাম থেকে বহু লোকজনকে সরিয়ে কাজ শুরু হয় কেল্লার। দেশীয় শক্তি বা ফরাসিদের আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে ইংরেজ কোম্পানি বিশেষ শক্তপোক্ত এক কেল্লা গড়ার কথা ভাবে। এই নতুন ফোর্ট উইলিয়ামের নকশা বা সামগ্রিক পরিকল্পনা সেই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের কেল্লার রীতিনীতি থেকে বেশ খানিক আলাদা ছিল। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের কথা আমরা চিরকালই শুনে আসছি। কিন্তু কেল্লা বললে আমাদের চোখের সামনে যে বিরাট একটা স্থাপত্য ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে কোনও মিলই নেই ফোর্ট উইলিয়ামের।
এই নতুন কেল্লা তৈরি হয়েছিল বেশ নিচু জমিতে, খানিক লোকচক্ষুর আড়ালে। সাধারণভাবে কেল্লা তৈরি হত একটু উঁচু জমিতে, পাহার বা টিলার উপরে। কিন্তু জলাজমির কলকাতায় আর সেসব কোথায়? তাই কোম্পানি অন্য পথ নেয়। ফরাসি কেল্লা-বিশারদ ভুবাঁর (Vauban) মত অনুসারে উঁচু কোনও স্থাপত্যের বদলে খানিক নিচু, ছড়ানো, সাত-কোণ বিশিষ্ট, বিশেষ জ্যামিতিক আকৃতির কেল্লা বানানোর পরিকল্পনা করে কোম্পানি। আর এরই অনুষঙ্গে আসে কেল্লার আশেপাশের জমি পরিষ্কার করার প্রশ্ন। কেল্লার সীমানা আর শহরের বাড়িঘর রাস্তার মধ্যে বেশ খানিক ফারাক রাখা প্রয়োজন ছিল সুরক্ষার খাতিরে। সেই ভাবনা থেকে গ্রাম-জঙ্গল সাফ করে বিস্তীর্ণ ময়দান তৈরি করা হয়। কেল্লা আক্রমণ করতে এলে যাতে অনেক দূর থেকেই শত্রুপক্ষকে নজর করা সম্ভব ছিল। প্রাথমিকভাবে তাই ময়দান জরুরি ছিল সামরিক কারণে, স্বাস্থ্য বা পরিবেশের প্রশ্ন তখন কারও মাথায় আসেনি।
এই নতুন কেল্লা আর ময়দান কলকাতার মানচিত্রে পাকাপাকিভাবে নানা বদল নিয়ে আসে। কেল্লা, ময়দান, তার বিপরীতে চৌরঙ্গী, এবং কিছুকাল পরে তৈরি হওয়া গভর্নর হাউস– ইউরোপীয় কলকাতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই অঞ্চল। গোবিন্দপুর থেকে উচ্ছেদ হওয়া অনেক পরিবারকে কোম্পানি ক্ষতিপূরণ হিসেবে জমি দেয় শহরের উত্তরে। সেই থেকেই উত্তর ভাগ হয়ে ওঠে দেশীয় এলাকা। উনিশ শতকের কোনও মানচিত্রে নজর দিলে দেখা যাবে কেল্লা, ময়দান, আর বাকি শহরের মধ্যে কী বিরাট পার্থক্য। কেল্লা আর ‘এসপ্ল্যানেড’ ম্যাপের এক কোণ জুড়ে রয়েছে, আর বাকি শহরটায় পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট। এই ছবি থেকেও অনুমান করা যায় ময়দানের বিশালতা।
সি. আর. উইলসন ইংরেজ কলকাতা নিয়ে কোম্পানি আমলের নানা নথিপত্র জোগাড় করে বিশ শতকের গোড়ায় বেশ কিছু বই লেখেন। আদি কলকাতায় ইউরোপীয়দের নগর-জীবন নিয়েও নানা নিবন্ধ ছাপান তিনি। ফোর্ট আর ময়দান নিয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল,
Fort William is the largest fortification in India and in its day an excellent piece of military engineering. Its area is two square miles; its full garrison, ten thousand men. Its ditches and ramparts, its piles of shot, and six hundred guns are a perpetual wonder to the stranger from the country. But the ordinary citizen who trudges round it afoot, or skims round it on his bicycle, cares for none of these things. To him the fort suggests thoughts of golf, football, cricket, hockey, races, anything rather than military defence: for the common which forms the glacis of the fort is the play-ground of Calcutta.
বিশ শতকের গোড়ায় প্রকাশিত এই লেখায় দেখা যাচ্ছে যে, কোম্পানির আমলে কেল্লা বা ময়দানের যে সামরিক অর্থ ছিল, তা সাম্রাজ্যের রাজধানীতে আর বিশেষ মানে বহন করে না। সাধারণ জনতার কাছে ময়দান হয়ে উঠেছিল বিনোদনের স্থান। খেলাধুলো, সার্কাস, পিকনিক ছাড়াও পশুচারণার জমি হিসেবেও ব্যবহার করা হত এই প্রান্তর। অন্যদিকে, উনিশ শতক জুড়ে বিভিন্ন সময়ে ময়দানের কোনও অংশে সরকারি দপ্তর বা বাড়ি বানানোর কথা উঠলেই নানা তর্ক লেগে যেত। একবার জেনারেল পোস্ট অফিসের নতুন বাড়ি তৈরি করার কথা ওঠে ময়দানে। লন্ডন থেকে কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরস আপত্তি জানিয়ে চিঠি লেখে কলকাতার কর্তাদের। একইভাবে ডালহাউসি ইন্সটিটিউট বা কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির নতুন বাজার ময়দানে বানানোর প্রস্তাব যখন আসে সরকারের এক পক্ষ থেকে, তখনই অন্য আরেক পক্ষ তীব্র আপত্তি জানিয়ে নাকচ করে দেয় সেই মত। তবে সবসময়ে যে ময়দান বাতিল হয়েছে, তা নয়। বিশ শতকের প্রথম অর্ধে সম্রাজ্ঞীর স্মৃতিতে নির্মিত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এখানেই গড়ে ওঠে। কিন্তু ময়দান সংরক্ষণের ধারণা বা ভাবনা সবসময়েই আলোচনায় থেকেছে। তবে এই সব আলাপ-আলোচনা থেকে এটাও স্পষ্ট হয় যে, কলকাতার মতো শহরে প্রথম থেকেই বিস্তীর্ণ খোলা এলাকার অভাব কেমন ছিল। সাম্রাজ্যের ক্ষমতা প্রদর্শন বা এক নির্দিষ্ট শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শহর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে জমির চাহিদা চিরকালই ছিল কলকাতায়। ফলে ময়দান নিয়ে তর্ক-বিতর্ক লেগেই ছিল। স্বাধীনতার পরও সেই তরজা বজায় ছিল। তবে রাজনৈতিক কারণেই হোক বা খেলা-মেলা-বিনোদনের জন্যই হোক, গড়ের মাঠ ধীরে ধীরে কলকাতার নাগরিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট