
এই কি ধর্মের স্বরূপ? যা যুগে যুগে বিপন্নতার মাঝে মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে, নাকি ভরদুপুরে লোকসমাগম ব্রিগেড দেখেছিল ধর্মের প্রেত! আমাদের রাজনৈতিক কূপমণ্ডুকতা আজ সেই তলানিতে যেখানে দাঁড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের বৈরাগ্যকে পরীক্ষা দিতে হয়। অথচ ভারত-আত্মার অনুসন্ধানে যে ধর্মীয় বোধ তাঁরা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেখানে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী ছুতমার্গ ছিল না। আমিষ-নিরামিষের রক্তচক্ষু ছিল না।
২৮.
ইতিহাস এই শহরের শিরায়। কল্লোলিনীর কোলাহলে ইতিহাস ফিসফিসিয়ে কথা বলে। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে চলে বেড়ায়। শহরের বুকে ওই যে একফালি ময়দান– তাই এই নগরের ফুসফুস। আর ব্রিগেড? সে তো ইতিহাসের আঁতুড়ঘর। ব্রিগ্রেডের যে কোনও জমায়েতই আসলে মানুষের, একথা আমরা মনে করতাম।
‘আমরা’– মানে পশ্চিমবঙ্গে যারা থাকি। সিপিএম-এর ব্রিগ্রেড জমায়েত হোক কিংবা তৃণমূলের, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাক হোক বা অতীতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-জ্যোতি বসুদের ডাক– আমরা ‘জমায়েত’ বলতেই বুঝতাম, যে কোনও মানুষের তাতে প্রবেশ থাকবে অবাধ। অগণন মানুষের ভিড়ে গমগমে হবে ব্রিগেড। কালো কালো মাথার ভিড়ে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্ন জাগরিত হবে, সেই ভিড় ঠিক মিশে যাবে শহরবাসীর ইতিকথায়।

মানুষ, আমাদের চিরচেনা রক্তমাংসের মানুষ, সে আসতে পারে, শুনতে পারে, মাঝপথে উপেক্ষা করে চলে যেতে পারে, ঘাসে হাত বুলোতে পারে, পাশের বন্ধুর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেও কি পারে না? জমায়েত– এত বড় এক শব্দ, যেখানে ছেলেমানুষী নিয়মশৃঙ্খলার চেনা বুনিয়াদগুলো ভেঙেচুরে যায়। কিন্তু এই ‘জমায়েত’ শব্দটা যদি হঠাৎই ক্ষুদ্র হয়ে ওঠে? জমায়েত যদি চিহ্নিত করতে চায় শুধু ধর্ম, স্রেফ খাদ্যরুচি? নেপথ্যে যদি থাকে বিশেষ কোনও কারণ? তখন কি ব্রিগেডের চেনা অনুভূতিগুলো ফিকে হয়ে, জমাট বাঁধে না একরাশ মনখারাপ, বিতৃষ্ণার মেঘ?
কলকাতা ব্রিগেড ময়দানে, যে মানুষটি চিকেন প্যাটিস বিক্রি করছিলেন, তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন প্রায় ২০ বছর ধরেই তিনি এই পেশায়, অথচ কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি তাঁর সঙ্গে। তিনি ধর্মপরিচয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থলোভী নেতা, তার স্তাবকদের মতো তিনি ধর্ম বেচেন না। যা বেচেন, তার নাম খিদে।

লোকে খিদে পেলে, কিনে খায়। তাঁরও খিদে মেটে। খিদের কাছে সমস্ত কিছুই তুচ্ছ হয়ে ওঠে। ব্রিগ্রেডে এই সেদিনও, চিরকালের মতো, জমায়েতে তিনি গিয়েছিলেন খাবার বেচতেই। কিন্তু অন্যদিনের মতো ব্রিগেড তাকে গ্রাসাচ্ছাদনের নির্ভরতা দিতে পারেনি। বদলে মুঠো ভরে দিয়েছে একরাশ অপমান, লাঞ্ছনা। তিনি অপদস্ত হলেন। মার খেলেন। উল্টে দেওয়া হল তাঁর চিকেন প্যাটিসের লৌহপেটিকা। হাজার তিনেক টাকার ক্ষতি হল। সে ক্ষতি না-হয় সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে, হয়তো বা। কিন্তু চেনা ময়দানে, চেনা জলহাওয়ায় তাঁর ওপর যে আঘাত নেমে এসেছে, সেই ভয়, সেই দুঃখ কি সহজে চলে যাবে?
কী ছিল তাঁর অপরাধ? তিনি গীতাপাঠের ‘পবিত্র’ ময়দানে অস্পৃশ্য, ম্লেচ্ছ ‘আমিষ’-এর কারবার খুলে বসেছিলেন! সেই পসার গীতা-সিক্ত জনতাকে বিভ্রান্ত করছিল, আমিষ ভক্ষণে আদর্শচ্যুত করার উপক্রম করছিল! হায় রে, পোড়া বঙ্গদেশ! কত রঙ্গ-রসে ভরা। ভাবতে অবাক লাগে এ বাংলাভূম রত্নগর্ভা! এই সোনার বাংলায় অনুরণিত হয় রবি ঠাকুরের গান, শ্রীরামকৃষ্ণের শাশ্বতবাণী, স্বামী বিবেকানন্দের চিরজাগ্রত প্রেরণা, কাজী নজরুলের ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু-মুসলমান’-এর সাম্যবাণী।

এই কি ধর্মের স্বরূপ? যা যুগে যুগে বিপন্নতার মাঝে মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে, নাকি ভরদুপুরে লোকসমাগম ব্রিগেড দেখেছিল ধর্মের প্রেত! আমাদের রাজনৈতিক কূপমণ্ডুকতা আজ সেই তলানিতে যেখানে দাঁড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের বৈরাগ্যকে পরীক্ষা দিতে হয়। অথচ ভারত-আত্মার অনুসন্ধানে যে ধর্মীয় বোধ তাঁরা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেখানে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী ছুতমার্গ ছিল না। আমিষ-নিরামিষের রক্তচক্ষু ছিল না। দুর্ভাগ্য যে, আজও আমরা শ্রীরামকৃষ্ণ বা স্বামী বিবেকানন্দের উদার ধর্মচিন্তার সারটুকু গ্রহণ করতে পারিনি। কন্যাকুমারীতে একাকী উপলখণ্ডের উপর নিবিড় ধ্যানে যেদিন মগ্ন হলেন স্বামী বিবেকানন্দ, সেদিন তাঁর বুকের মধ্যে জ্বলে উঠেছিল অপূর্ব এক আলো। সেই বৈদিক যুগ থেকে যে সনাতন ভাবনা মন্থন হয়ে চলেছে ভারতসাগরে, তারই অমৃত যেন আলো হয়ে ধরা দিয়েছিল ভারতমাতার শ্রেষ্ঠ সন্তানের বুকে। বহু উপলব্ধির স্তর পেরিয়ে স্বামীজি সেদিন দর্শন করেছিলেন বিশ্বরূপ। ভারতমাতৃকার বিশ্বরূপ।
বহু ধর্ম, বহু ভাবনা, বহু সাধনার মিলনক্ষেত্র এই ভারতবর্ষ। সেই শ্বাশ্বত অনুভবটিকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই ভারতবাসীর মুক্তি– ‘তিনি উপলব্ধি করলেন, ধর্মই ভারতবর্ষের মেরুদণ্ড। তাঁর সমাহিত বিশুদ্ধ গহন চিত্তে ধ্বনিত হল এই বাণী– যে আধ্যাত্মিক প্রভাবে ভারতবর্ষ একদিন বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল, সেই আধ্যাত্মিক অনুভূতিরই জাগৃতি ঘটাতে হবে। আর সেই জাগরণ ঘটাতে হবে সর্বসাধারণের মধ্যে। জনগণের অভ্যুদয় ছাড়া ভারতের অভ্যুদয় সম্ভব নয়।’ ভারতের ‘অধ্যাত্মমহিমোজ্জ্বল’ আত্মাটিকে আপনার মধ্যে ধারণ করেই সেদিন আগামীর ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। স্বামীজি হয়তো আজ দেখে দুঃখিতই হবেন যে, সেই ভারতের অভ্যুদয় এখন আমিষত্বে বেড়াজালে বন্দি। সস্তা প্রশ্নের প্রবচনে গিয়ে ঠেকেছে। আর বাংলার বুকে সেই ন্যক্কারজনক ঘটনা আরও পীড়াদায়ক।

শীত পড়েছে। দূষণ নিয়ে কথাবার্তা এখন স্বাভাবিক। গায়ে যে-কেউ চরিয়ে নিচ্ছে সোয়েটার, কোট, চাদর। তবু আরেক শীত, মানুষের পাশে না থাকার শীত, এ কলকাতাকে এখনও জাঁকিয়ে ধরেনি। গত দু’দিন, সোশাল মিডিয়া থেকে সংবাদমাধ্যম, নিরন্তর ওই প্যাটিস বিক্রেতার পক্ষে কথা বলে গিয়েছে। বলেছে, ময়দান মন্দির নয়। বলেছে, গীতাপাঠ করেও আত্মসংযম তৈরি হয়নি। বলেছে, দিনের শেষে স্বামীজির সেই উক্তি: জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
হ্যাঁ। এই বিষ-হাওয়ায়, দূষিত হাওয়ায় কলকাতার যত না শ্বাসকষ্ট হয়, তার চেয়ে বেশি শ্বাসরুদ্ধকর লাগে যখন এক গরিব প্যাটিস বিক্রেতা, নিজের ২০ বছরের পেশায় যিনি কখনও আক্রান্ত হননি, আক্রান্ত হলেন গীতাপাঠের আসরে। খাস কলকাতার বুকে, আর কোনও শীতে এমন দূষণ হয়েছে কি?

কলকাতার ব্রিগেড, অজস্র ইতিহাসের সাক্ষী। তার কেবলমাত্র পরিচয় গীতাপাঠের ময়দান হিসেবে নয়। যে প্যাটিস বিক্রেতা আমিষ খাবার বিক্রি করছিলেন, তিনি রুজি-রোজগারের টানেই ব্রিগেড চত্বরে উপস্থিত ছিলেন, গীতাপাঠের নির্মলতাকে বানচাল করার অভিসন্ধিতে নয়। অথচ ধর্মের রঙিন চশমা চোখে আমরা তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে এনেছি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণে। চাইলেই সেই আমিষ খাবার এড়িয়ে যাওয়ার সহজ অভিপ্রায় গীতাপাঠে ‘উন্মুখ’ উপস্থিত জনতা দেখাতে পারতেন। তার বদলে যে হিংস্রতার পথ তাঁরা বেছে নিয়েছেন, সেটাই গীতার পরিপন্থী। কারণ, গীতা নিষ্কলুষ প্রেম, মুক্তির কথা বলে। বিভাজনের কথা বলে না।
এই বাংলায় এককালে নাগরিক কবিয়াল গিটারের সুরে ঝঙ্কার তুলেছিলেন– ‘আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু।’
তা আমরা বুঝব আর কবে!
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ২৭: রিলের পুজোয় রিয়েল পুজোর গন্ধ নেই!
পর্ব ২৬: আমার মূর্তির অনতিদূরে যদি রমার একটা মূর্তি করা যায়
পর্ব ২৫: তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলাদেশি’ ভাষায় ‘সোনার বাংলা’, আর বাংলায় ‘জনগণমন’ লিখেছিলেন?
পর্ব ২৪: বর্ষাকাল মানেই বাঙালির কনফিউশনের বন্যা!
পর্ব ২৩: ও ক্যাপ্টেন! মাই ক্যাপ্টেন!
পর্ব ২২: শচীন-বিরাটরা আসেন-যান, ভারত থেকে যায়
পর্ব ২১: কিং কোহলি দেখালেন, ধৈর্যের ফল বিরাট হয়
পর্ব ২০: মনকে শক্ত করো টেস্ট, রাজা আর ফিরবেন না
পর্ব ১৯: মুকুল কিংবা ফিলিস্তিনি বালক, খুঁজে চলেছে যে যার ঘর
পর্ব ১৮: ধোনিবাদ: ধাঁধার চেয়েও জটিল তুমি…
পর্ব ১৭: সাদা সাদা কালা কালা
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved