অভিনেতার কাজ হল, অভিনয়ের প্রয়োজনে, চরিত্রের দাবি মেনে বয়সটাকে কমানো এবং বাড়ানো। আমি যেমন ২৫ বছর বয়সে ৮০ বছরের চরিত্রে অভিনয় করেছি। এটা একটা নিয়ত প্রক্রিয়া, চলছে-চলবেই। কিন্তু আমার এটাও মনে হয়, অভিনেতার অভিজ্ঞতার বয়স যত বাড়ে, নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চরিত্রের যে বলবার কথা এবং বয়সকে সে নতুন করে আবিষ্কার করে।
১৪.
অভিনয় প্রসঙ্গে দারুণ একটা কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলেছিলেন– এ কোনও হরবোলার কাণ্ড নয়, নকলনবিশিও নয়। অভিনয় বস্তুটা হচ্ছে, যা নাকি ‘স্বাভাবিকের পর্দা ফাঁক করিয়া ভিতরের লীলা দেখাইবার ভার নেয়।’ এই অনুভব অভিনেতার অভিনয় জীবনের শুরুর দিকে থাকে না। অভিনয়ের বয়স যত বাড়ে, তত সেই উপলব্ধি গাঢ় হয়। আমি অভিনেতা হিসেবে শুরুর দিকে যে অভিনয় করছিলাম, তা করে হয়তো প্রশংসিতও হচ্ছিলাম, কিন্তু সে-মুহূর্তে বুঝতে না পারলেও মধ্যতিরিশে পৌঁছে আমি অনুভব করতে পেরেছি, আমার অভিনয়ের শুরুর দিকের খামতিকে। সেটা একান্ত অভিনেতার নিজস্ব উপলব্ধি। দর্শক তা অনুধাবন করতে পারত কি না জানি না। ফলত মঞ্চে ওপরে দাঁড়িয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে যে সংলাপ বলতাম, এর যে প্রক্রিয়া, এর ছন্দ-লয়, তাকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করতে শিখলাম অভিনয়ের মধ্য দিয়ে।
অভিনেতা হিসেবে সেই বিবর্তনকে কিন্তু আমি অনুভব করতে পারছি, বুঝতে পারছি। আর বুঝতে পারছি বলেই একটু নতুন কিছু, বাড়তি কিছু অভিনয়ে ঢেলে দেওয়ার তাগিদ আমার মধ্যে তৈরি হচ্ছে। নিশ্চিতভাবে সেটা দর্শকের চোখেও আকর্ষণীয় লাগছে। ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ নাটকে ‘ড. চৌধুরী’ বলে আমলার যে চরিত্রটি আমি করেছিলাম, সেই চরিত্রটির বয়স ছিল ৪৫। আর সেই চরিত্রে আমি যখন অভিনয় শুরু করেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল ২২। মাঝে ১৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন আমি সেই চরিত্রটায় অভিনয় করছি, তখন কিন্তু আমি একথা বলতে পারছি না, যে ‘ড. চৌধুরী’র বয়স এখন ৬০ বছর , কিংবা ষাট পেরিয়ে গিয়েছে। কারণ, তাকে, অর্থাৎ সেই চরিত্রটিকে আমি দেখছি সেই ৪৫ বছরের চরিত্র হিসেবেই। কিন্তু আমি অর্থাৎ সেই চরিত্রে অভিনয় করছেন যিনি, তার বয়স কিন্তু ৩৫। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে বয়সের দিক থেকে চরিত্রের আরও সমীপবর্তী হচ্ছেন অভিনেতা। একইসঙ্গে চরিত্রটির বয়সকে অন্যভাবে আবিষ্কার করছে সে।
অভিনেতার কাজই তাই। তার কাজ হল, অভিনয়ের প্রয়োজনে, চরিত্রের দাবি মেনে বয়সটাকে কমানো এবং বাড়ানো। আমি যেমন ২৫ বছর বয়সে ৮০ বছরের চরিত্রে অভিনয় করেছি। এটা একটা নিয়ত প্রক্রিয়া, চলছে-চলবেই। কিন্তু আমার এটাও মনে হয়, অভিনেতার অভিজ্ঞতার বয়স যত বাড়ে, নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চরিত্রের যে বলবার কথা এবং বয়সকে সে নতুন করে আবিষ্কার করে। এটা কিন্তু অভিনেতার কোনও বাহ্যিক লক্ষণ নয়। এই নিয়ত প্রক্রিয়া বা পরিবর্তন যা কিছু, সব অভিনেতার মনের মধ্যে, অন্তরের অন্দরমহলে চলে। চলতেই থাকে। এই বদলটা আসে ভিতর থেকে।
এই বদল অভিনয় বা নাট্যকলাকে এমনভাবে বদলে ফেলে, যেটা সিনেমায় সম্ভব নয়। সেটা রিলিজড বা প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পর আর কিন্তু পরিবর্তনের সুযোগ নেই অভিনেতার কাছে। কিন্তু মঞ্চাভিনেতার কাছে সে-সুযোগ আছে। নাটকের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে অভিনেতা তার যাপনে এই অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ফলে অভিনয়েরও নিজস্ব একটা বয়স আছে। আমরা যদি একটা দীর্ঘসময় ধরে সেই অভিনয়টা চালাতে পারি, তাহলে সে অভিনয়ের বয়স, সমকাল সব মিলে মিশে এমন একটা অনুভূতি অভিনেতার মধ্যে তৈরি করে, যে অনুভূতি অভিনয়কে নতুন মাত্রা দেয়। বা বলা ভালো, অভিনয়ে নতুন রং যোগ করে।
আমি জানি না, শিল্পের অন্যান্য শাখায় যাঁরা রয়েছেন, সেই কবি-সাহিত্যিক শিল্পীরা তা কেমনভাবে অনুভব করেন। তবে ব্যক্তিগত পরিসরে অনেক সময়েই পরিচিত কবিবন্ধুকে আক্ষেপ করতে দেখেছি, তার প্রথমদিকের লেখা কবিতা নিয়ে। আক্ষেপের স্বরে বলেছেন, এখন হলে ওইভাবে কবিতাখানি লিখতাম না। অনেকে আছেন, শুরুর দিকে লেখা গল্পকে কাঁচা-কাজ বলে মনে করেন। আজ হলে হয়তো সেটা অন্যরকমভাবে পরিবেশন করতেন গল্পকার। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটাই একটা সম্ভাবনা। অর্থাৎ করা যেত। আর অভিনেতা হিসেবে আমি সেই পরিবর্তনটা করতে পারি। কারণ, অভিনয় একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমার বয়স কিংবা বেঁচে থাকা, অভিনীত চরিত্রটিকে বেঁচে থাকার নতুন উপকরণ জুগিয়ে দিচ্ছে। সে যেন নাছোড়বান্দা বাচ্চার মতো অভিনেতাকে বলে চলেছে, আমাকে যদি আরও সাজিতে তুলতে চাও, সাজাও। ক্ষতি নেই। যদি নির্ভার করতে চাও, তাই কর।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
……………………………………………
অনেক সময় দর্শকরা অভিনেতাকে প্রশ্ন করেন, একটা চরিত্রে অভিনয় করতে করতে একঘেয়েমি গ্রাস করে না? মনে হয় না, যন্ত্রের মতো হয়ে যাচ্ছেন? তাদের বোঝাই কি করে, অভিনেতা অভিনয়ের বয়স-দিনকাল-মুহূর্ত, তার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তার হদিস অর্থাৎ তালা খোলার চাবির নাগাল পেতে পারে, তাহলে সে একঘেয়েমি বোধ করবে না। কারণ, প্রতিদিনই সে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছে। তার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে, অভিনয়ের বয়স। এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, তাহলে তো প্রতিদিনই পাল্টে পাল্টে যাবে অভিনয়? নিশ্চয় পাল্টাবে। তবে তা রাতারাতি নয়। সময় লাগবে। সময়ের সঙ্গে বয়স যে বাড়ে, যে অভিজ্ঞতা বাড়ে, তাই শিক্ষা দিয়ে দেয়, তাতে অভিনয়েরও বয়স বাড়ে। অভিনয় আরও প্রাণবন্ত হয়, আরও প্রাঞ্জল হয়ে স্থায়িত্ব লাভ করে দর্শক-হৃদয়ে।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৩। অভিনয়ের বয়স প্রভাবিত করে অভিনেতার যাপনকে
পর্ব ১২। অভিনয় যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই তৈরি করে আশঙ্কা
পর্ব ১১। অভিনেতার বিপদ লুকিয়ে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে
পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?