ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর। বাংলায় এদের বিস্তার বেশি নেই যদিও। তবে উত্তর আর পশ্চিম ভারতে আকছার দেখা মেলে। আমাদের এখানে ময়ূরের পেখমের পালক দেখা যায় বেশি। দশকর্ম ভাণ্ডারে। তা দিয়ে হাতপাখা হয়, বালগোপালের কেশবর্ধন হয়, আর গোড়ার সাদা অংশ দিয়ে মাছ ধরার ছিপের ফাৎনা হয়। মানুষের বিচিত্র কারবার।
১১.
কার্তিকের বাহন ময়ূর।
ময়ূরবাহন কার্তিক ঠাকুর। দেবসেনাপতি। দক্ষিণ ভারতে কার্তিক ঠাকুরকে ‘মুরুগান’ বলা হয়।
কার্তিক ঠাকুর মা দুর্গার সঙ্গে একবার আসেন; আর কার্তিক মাসে একলা আসেন। বাংলায় ছড়া আছে ‘কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা, একবার আসে মায়ের সাথে, একবার আসে একলা’। ময়ূর সঙ্গে থাকে সবসময়।
এখানে বাঁশবেড়িয়া, কাটোয়াতে কার্তিক পুজোর খুব ধুম। নানা রূপে তাঁর আবাহন। বাবুকার্তিক, খোকাকার্তিক ইত্যাদি। ময়ূরের তা নয়। সে আপনমনে থাকে। কখনও পেখম মেলে, কখনও পেখম ঝুলিয়ে।
ঠাকুরদেবতার কম্পোজিশনে এই বাহনকে ফিট করানো খুব কঠিন। একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, ভারতের মূর্তিভাবনা মূলত স্থাপত্যকেন্দ্রিক। নটরাজ, পার্বতি বা চোল যুগের কিছু ব্রোঞ্জ মূর্তি ব্যতিক্রম। তাদের ৩৬০ ডিগ্রিতে ঘুরে দেখা যায়।
কিন্তু অধিকাংশ মূর্তিতেই চালি থাকে। অর্থাৎ সেগুলোর মধ্যেও একটা স্থাপত্য-নির্ভরতা আরোপ করা হয়ে থাকে। এর ফলে কী হয়, বাহনগুলোকে মুখোমুখি বা পরিভাষায় ‘ফোরশর্টেন’ করে নির্মাণ করলে তার নান্দনিক গুণ কিছুটা হলেও কমে যায়। তাই মূর্তিকার বা পাল মশায়েরা সবসময় বাহনদের স্থিতি নিয়ে নানা কম্পোজিশনের চেষ্টা চালিয়ে যান। একেবারে হাল ছেড়ে দিলে তাদের গুরুত্বহীন এবং অতি ক্ষুদ্রকায় করে নির্মাণ করেন।
কার্তিকের মূর্তিতে ময়ূরের পেখম দেখানো বেশ কঠিন কাজ। দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে এক কার্তিকের মূর্তি আছে। ১২ হাত। আহা! ময়ূরের সংস্থাপন এবং দেবতার অধিষ্ঠানের ভঙ্গি দেখার মতো। চোলযুগের শেষার্ধের কালো পাথরের এই মূর্তি ভারতশিল্পের অনন্ত বিস্ময়ের কথা বলে।
ময়ূরকে একটু পাশ ফিরিয়ে দেখালে পেখমটা কায়দা করা যায়। আর মুখোমুখি হলে ঠাকুরের পিছনে গোলাকৃতিভাবে পেখমটা মেলা থাকে। ময়ুরের সৌন্দর্য ওখানেই। ময়ূরী পেখমহীনতার কারণে একটু পিছিয়ে পড়া। সিংহের বেলায়ও তাই। পেখম আর কেশর দুই-ই পৌরুষ নির্ধারক। অন্তত বাহন নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এই পুরুষপ্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর। বাংলায় এদের বিস্তার বেশি নেই যদিও। তবে উত্তর আর পশ্চিম ভারতে আকছার দেখা মেলে। আমাদের এখানে ময়ূরের পেখমের পালক দেখা যায় বেশি। দশকর্ম ভাণ্ডারে। তা দিয়ে হাতপাখা হয়, বালগোপালের কেশবর্ধন হয়, আর গোড়ার সাদা অংশ দিয়ে মাছ ধরার ছিপের ফাৎনা হয়। মানুষের বিচিত্র কারবার।
অনুপম সৌন্দর্যের কারণে ময়ূরকে পুরাণে অমরত্বের প্রতীক বলে ধরা হয়। লাবণ্য, সম্ভ্রম, উৎকর্ষের স্বরূপ ময়ূর প্রতীকায়িত হয়েছে দীপদান থেকে সিংহাসনে। কার্তিক সরাসরি তার পিঠে চেপে বসলেও তা সিংহাসনের মর্যাদা পায় ১৬৩৫-এ, যখন শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুপম সৌন্দর্যের প্রতীক ময়ূর সিংহাসন তৈরি হল।
১৭৩৯ অবধি মুঘল সম্রাটরা তাতে আসীন ছিলেন। মিনিয়েচার পেইন্টিং-এ দেখা। তারপর নাদির শা ১৭৩৯-এ যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসাবে তা লুঠে নিল। ধ্বংস হল রত্নখচিত মহামূল্য আসন। এখন শুধুই ইতিহাস। কয়েক টুকরো তেহরান মিউজিয়ামে আছে। ইতিহাসের এক ভয়ংকর অধ্যায়ের সঙ্গে ময়ূর জুড়ে গেল।
কালে কালে তবুও সৌন্দর্য অক্ষত থাকে। ময়ূরেরা সুন্দরের বাহন হয়ে ফুটে ওঠে কাঁথার ফোঁড়ে, মাটির মন্দিরে, প্রদীপের হাতলে।
সুন্দরের শিখীপাখায় সেজে ওঠেন দেবতা।
… পড়ুন বাহনকাহন-এর অন্যান্য পর্ব …
১০. সন্ত্রাসেও আছি, সিদ্ধিতেও আছি
৯. শনির চেয়েও ভয়ংকর তার বাহনের দৃষ্টি
৮. জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে যে বাহনের অবাধ বিচরণ
৭. দেবতার চেয়ে মানুষের বাহন হিসেবেই কুকুর বেশি জনপ্রিয়
৬. বিশ্বকর্মার বাহন, রাজারও বাহন
৩. বাহন বিড়ালের ভার লাঘব করতে হয়েছিল স্বয়ং ঠাকুরকেই
১. মন্দিরের লাগোয়া তার আসন, তার কানে মনের বাসনা জানালে সরাসরি পৌঁছে যায় বাবার কাছে
এক একটা আশ্রম হচ্ছে এক একটা ক্ষেত্র। প্রতিটি ক্ষেত্রের একটা সাধনশক্তি থাকে। আশ্রমের যৌথ জীবনযাপন আসলে সৎসঙ্গের মতো। আমরা বলি, স্বাধিষ্ঠানে আমাদের আধ্যাত্মিক অগ্নি থাকে, স্বাধিষ্ঠান হচ্ছে নাভি থেকে চার আঙুল নীচে, যদি এই স্থান খুলে না যায়, তাহলে তার পক্ষে আধ্যাত্মিক জীবনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন।