জীবন এই কারণে এত অনিশ্চিত অ্যাডভেঞ্চার। যা হওয়ার কথা থাকে, হয় না ঠিক সময়ে। যেমন, চোখের বালি। সেই কবে থেকে ঋতুদা প্ল্যান করে রেখেছে, কিন্তু হচ্ছে না কিছুতেই। ঋতুদাই জানাল, ‘শোন, চোখের বালি করতে এখনও ঢের দেরি, অন্য একটা ছবি করে ফেলছি তার মধ্যে। স্ক্রিপ্টটা শুনতে আয়।’
১৮.
‘চোখের বালি’ যেমনই লাগুক, এটা বুঝতে পারছিলাম, এই ছবিটা ঋতুপর্ণ ঘোষের ফিল্মোগ্রাফিতে একটা বড় জায়গা পাবে। ‘তারা’-র ভ্যানতারা কাটিয়ে যদি ওই ইউনিটে কাজ করা যায়, এর’ম একটা ইচ্ছেও উঁকি মারছিল মনে। কিন্তু চাকরি, মাসমাইনের নিরাপত্তা– সব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে দিন কাটছিল।
তারা-য় তখন দু’-তিন মাসে একবার করে মাইনে হয়। নিজের ওপরই রাগ হয়, এমন একটা চাকরি, যার প্রতিমাসে স্যালারিও ঢোকে না। এই ফাইনান্সিয়াল ফ্যাসাদ অফিসেও অনেকের শুরু হল। নতুন ক্রেডিট কার্ড পেয়ে জনগণ মনের আনন্দে জাহাজ কিনেছে। এবার তাদের স্টেটমেন্ট আসতে শুরু করেছে। মাসের টাকা মাসে না চোকালে চড়া সুদ। তখন মোবাইল আর ক্রেডিট কার্ডের বিল অফিসের প্রধান টপিক।
এটা এমন সময়ের কথা, যে সময় আমি হাতঘড়িও পরি না, আর জীবনে কোনও দিন সেলফোন ব্যবহার করব না– তেমনই পণ। ফলে অফিস বাবুয়ানির অন্যান্য হাঙ্গামে ফাঁসিনি সে-যাত্রায়। এইসব গোলোযোগের মধ্যে একদিন চন্দ্রিলের ফোন।
–শোন, তারা-র চাকরি ছেড়ে দিয়েছি আমি।
–সে কী? কেন?
–ইচ্ছে করছে না আর।
এমনি আড্ডায় মাঝে মাঝেই চন্দ্রিল বলত চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু মুখে বলা আর সত্যি ছাড়ার মধ্যে অনেক তফাত। ঋতুদার পর চন্দ্রিলের বেরিয়ে যাওয়া আরও একটু মনখারাপ বাড়িয়ে দিয়ে গেল। খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল তারা-র অফিস। পুরনো প্রোগ্রামগুলোর কী গতি হবে, তাও জানি না। আর এই চাকরিটাও এমন, এখানে আসি-যাই মাইনে পাই টাইপ নয়। কিছু একটা করে দেখাতেই হবে। আমাদের মনে হচ্ছিল, ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে যা আমরা আশা করি, পাচ্ছি না। হয়তো ওপরওলারা ভাবছিল, এদের নিয়ে আসা হল, কোনও ম্যাজিক করবে বলে, তার কিছুই করল না।
হাজারো অশান্তির মধ্যে একমাত্র আরামের জায়গা চন্দ্রবিন্দুর রিহার্সাল। কিছু গান, কিছু আড্ডা, রুটি-তরকা, থাম্পস আপ খেয়ে রাত কাটানো– এটাই একটা আলাদা ভালোলাগা ছিল। আমাদের খুব বেশি ফ্যান ছিল না। কিন্তু অনন্ত একটা ভালোলাগা ছিল গানকে ঘিরে। গৌতমদা চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে একটা গান বেঁধেছিলাম। ‘আমার ভিনদেশি তারা, একা রাতেরই আকাশে, তুমি বাজালে একতারা, আমার চিলেকোঠার পাশে’। বয়ে চলা অশান্তময় সময়টা পেরিয়ে এক নিশ্চিন্ত ভালোবাসার গান। প্রথমবার গানটা শুনে বেশ অবাকই হয়েছিল উপল, চন্দ্রিলরা। আমি আবার গোঁ ধরে বসেছিলাম, গানটা প্রকাশ করব না বলে। যাক গে, শেষমেশ ঠিক হল, পরের অ্যালবাম, মানে চন্দ্রবিন্দুর চতুর্থ ক্যাসেটে গানটা থাকবে।
গৌতম চট্টোপাধ্যায় চলে যাওয়ার পর তখন স্মরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে প্রায় রোজ। আজ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল, কাল রবীন্দ্রসদন। আমাদের সেখানে গাইতে ডাকে, আমরাও কোরাসে ‘যখন দেখি ওরা কাজ করে মাঠে প্রান্তরে’ গাই। শিশির মঞ্চের প্রোগ্রামে মনে হল ‘ভিনদেশি তারা’ গানটা প্রথমবার গাই। সেই মতো রিহার্সাল হল। অ্যাডলিবে গাওয়া হবে গানটা। আমি ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড উত্তেজিত ছিলাম। যে কোনও নতুন গান প্রথমবার মঞ্চে গাওয়ার একটা শিরশিরে অনুভূতি থাকে। আর এই গানটা, যেটা পাবলিক ফাংশনে গাওয়া নিয়ে এমনিই টেনশন ছিল। মঞ্চে তখন রঞ্জনপ্রসাদ গাইছেন। তারপর আমরা উঠব। প্রস্তুতি নিচ্ছি মনে মনে, আনমনা হয়ে গুনগুন করে ভাঁজছি নতুন গানটা, হঠাৎ শুনি কড়কড় কড়কড় আওয়াজ! ভূমিকম্প! না, শিশির মঞ্চের সামনে যে কাচটা ছিল, ভিড়ের চাপে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ভেঙে গিয়েছে। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন কখনও হয়নি। দর্শকদের আর্তনাদ, শিল্পীরা দিশাহারা, দমকল, পুলিশ– অনুষ্ঠান গেল বন্ধ হয়ে মাঝপথে। ‘ভিনদেশি তারা’ গাওয়া হয়নি আর সেদিন।
জীবন এই কারণে এত অনিশ্চিত অ্যাডভেঞ্চার। যা হওয়ার কথা থাকে, হয় না ঠিক সময়ে। যেমন, চোখের বালি। সেই কবে থেকে ঋতুদা প্ল্যান করে রেখেছে, কিন্তু হচ্ছে না কিছুতেই। ঋতুদাই জানাল, ‘শোন, চোখের বালি করতে এখনও ঢের দেরি, অন্য একটা ছবি করে ফেলছি তার মধ্যে। স্ক্রিপ্টটা শুনতে আয়।’
আমি অমনি টগবগ নেচে ইন্দ্রাণী পার্কে হাজির। ভালোবাসার গপ্প। মায়ের পুরনো প্রেমিককে মেয়েও মন দিয়ে ফেলেছে। মহা সমারোহে একদিন চিত্রনাট্য শোনা হল। অভিনেতারা কেউ ছিল না, পুরোটাই ডিরেক্টোরিয়াল আর টেকনিক্যাল টিম। শুনেই সবার খুব পছন্দ হয়ে গেল সিনেমাটা। ছবির নাম ‘তিতলি’। এই প্রথম ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তী, মায়ের ভূমিকায় অপর্ণা সেন, মেয়ের ভূমিকায় কঙ্কনা। তখন কঙ্কনার কোনও ছবি মুক্তি পায়নি। ঋতুদা বলল, ‘তুই অফিসে ছুটি চা, অ্যাসিস্ট কর এই ছবিটায়।’ আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘কিন্তু আমার তো চোখের বালিতে…’ ঋতুদা হাসল, ‘তখন আবার করিস।’
যে কোনও অযাচিত প্রস্তাব, তা যদি বেশ আকর্ষণীয়ও হয়, মানুষ ফাঁপরে পড়ে। কিন্তু আমি সে সময় তারা-র হাত থেকে পালাতে চাইছিলাম। আর একটা লোভ ভিতরে ভিতরে পেয়ে বসছিল, একমাস পাহাড়ে এর আগে থাকিনি। শুটিং মানে তো আসলে কাজের ছুতোয় বেড়ানোও। মন্দ হয় না পাহাড়ে পালালে। গেলাম বুদ্ধদেব গুহ’র কাছে ছুটি চাইতে। খুব একটা যে খুশি হয়েছিলেন ব্যাপারটায়, তা না। বরং ওঁর সন্দেহ হয়েছিল, আমি তল্পিতল্পা গুটিয়ে কাটছি কিনা! ফলে ব্যাজার মুখে আপদ বিদায় টাইপের একটা ছুটি মঞ্জুর হয়েছিল। ঘর থেকে বেরনোর সময় বললেন, ‘‘শোনো, তুমি কিন্তু এই দু’মাসের স্যালারি পাবে না, মনে রেখো।’’ তখন আমি এমনিই তিনমাসের মাইনে পাই। ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। ফলে চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘ও ঠিকাছে!’
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?