‘তিতলি’র শুটিংয়ে মিঠুনদা প্রথম প্রথম ঘর থেকে বেরতেন না। পরের দিকে বোর হয়ে গিয়ে স্বমহিমায় বেরিয়ে এলেন। জুনিয়র এডি’র মধ্যে সারণকে তো আগে থেকে চিনতেনই, আমাদের সঙ্গেও এই বিজন প্রান্তরে গল্প করতে শুরু করলেন। মিঠুনদা স্মৃতিঘেরা এক মানুষ। একটানেতে যেমনতেমন হলেও তিনটানেতে রাজা উজির, আর চারটানেতে দুখী। এসব সময়ে ছেলেবেলা উপচে পড়ত তাঁর দু’চোখে। সত্তরের আগুন দশক আর পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়চ্ছে মিঠুনদা। শেষদিকটা মনখারাপ করতেন। সমাজতন্ত্রের সুদিন আর এল না। যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম… এই অবধি বলে গলা ধরে যেত তাঁর।
২৪.
সমতলের মানুষের চেয়ে পাহাড়ি মানুষ অনেক বেশি ভদ্রসভ্য হয়। শিলিগুড়িতে মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে যে আদেখলাপনা ছিল, পাহাড়ে তার লেশমাত্র নেই! চিনতে পারলে ভিড় করছে, চোখমুখ আলো করা হাসি দিচ্ছে, কিন্তু ওই অবধিই। সকলে জানে এখানে কাজ হচ্ছে, আর কাজের প্রতি একটা সম্মান আছে সবার। মিঠুনদা নিজে সমতলের মানুষ, কিন্তু তাঁর সঙ্গে ঘোরে সর্বক্ষণের প্রহরী বাহাদুর। ছায়ার মতো আগলে রাখে সুপারস্টারকে। কখন জলের বোতল বা কখন মলমল– না বলতেই বোঝে। নেপালদেশের মানুষ এই বাহাদুর। সারা ইউনিট অবাক হয়ে দ্যাখে তার সিরিয়াসনেস। একদিন দেখি, লাইটারে আগুন জ্বেলে পটকার সলতে ধরার মতো কী যেন করছে। কাছে এসে দেখি, সে হাতে করে সিগারেট ধরাচ্ছে। হাতে কেন? কারণ, ওটা মিঠুনদার সিগারেট! তাকে টিকেয় আগুন লাগিয়ে দিতে হয়, পুরনো গড়গড়া সিস্টেম। পাহাড়ের মানুষ মিঠুনদার কাছে ঘেঁষতে চাইলে ফড়ফড় করে কী যেন বলত বাহাদুর। সাবটাইটেল থাকলে নিশ্চিত বোঝা যেত, বাছাই করা নেপালি গালি। মিঠুনদার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-নিরাপত্তার একান্ত দায়িত্ব শুধু তারই। সিনেমার প্রোডাকশনের মতো ত্যাঁদড় ও হেল্পফুল লোক খুব কম হয়। তারা বাহাদুরের সঙ্গে ভাব জমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের এই গায়ে-পড়া বন্ধুগিরি মোটেই ভালো চোখে দেখল না বাহাদুর। সে মোটেও কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে আসেনি। তার কাজ সুপারস্টারের খিদমত খাটা।
‘তিতলি’র শুটিংয়ে মিঠুনদা প্রথম প্রথম ঘর থেকে বেরতেন না। পরের দিকে বোর হয়ে গিয়ে স্বমহিমায় বেরিয়ে এলেন। জুনিয়র এডি’র মধ্যে সারণকে তো আগে থেকে চিনতেনই, আমাদের সঙ্গেও এই বিজন প্রান্তরে গল্প করতে শুরু করলেন। মিঠুনদা স্মৃতিঘেরা এক মানুষ। একটানেতে যেমনতেমন হলেও তিনটানেতে রাজা উজির, আর চারটানেতে দুখী। এসব সময়ে ছেলেবেলা উপচে পড়ত তাঁর দু’চোখে। সত্তরের আগুন দশক আর পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়চ্ছে মিঠুনদা– আমাদের অলি-গলি পর্যন্ত মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল ওই ক’দিনে। শেষদিকটা মনখারাপ করতেন। সমাজতন্ত্রের সুদিন আর এল না। যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম… এই অবধি বলে গলা ধরে যেত তাঁর।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
খোদ মন্ত্রী রয়েছেন যখন, নিরাপত্তার ফাঁস তো থাকবেই। ঋতুদা নিজের হাতে লিখে একটা নোট পাঠাল। সৌজন্যর খাতিরেই দেখা করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল ঋতুদা। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে নিরাপত্তারক্ষী এসে বলে, ‘কিছু মনে করবেন না, মাননীয় মন্ত্রী দেখা করতে চাইছেন না।’ যে-সময়ের ঘটনা, ঋতুপর্ণ ঘোষ কিন্তু জাতীয় স্তরের বেশ সাড়া জাগানো নাম। এই দেখা না-করাটা আমাদের প্রত্যেকের চোখেই খুব অদ্ভুত লেগেছিল। সেই রাতে সারণের পিছনে আরও বেশি করে লাগা হয়। ঋতুদার যথেষ্ট মনে লেগেছিল ঘটনাটা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সারণ আবার ‘ঘোষিত’ সিপিএম। এইসব সময়ে সে-ও কিছু একটা ফুট কাটত। ব্যাস, আবার শুরু হয়ে যেত লাগ-দনাদন। ঋতুদা বা রিনাদি একটু কড়া সুরেই সিপিএমের সমালোচনা করতেন, আমার মনে হত সারণের পিছনে লাগবে বলে। সত্যি সত্যি অতটা রাগ হয়তো ছিল না।
সরকারি লগহাউজগুলোর সামনের রাস্তায় শুটিং হচ্ছে, কিছু পুলিশ এসে অন্য দিকটায় করতে বলল। কেন? কারণ তৎকালীন পর্যটনমন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায় রয়েছেন তখন ওখানেই। খোদ মন্ত্রী রয়েছেন যখন, নিরাপত্তার ফাঁস তো থাকবেই। ঋতুদা নিজের হাতে লিখে একটা নোট পাঠাল। সৌজন্যর খাতিরেই দেখা করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল ঋতুদা। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে নিরাপত্তারক্ষী এসে বলে, ‘কিছু মনে করবেন না, মাননীয় মন্ত্রী দেখা করতে চাইছেন না।’ যে-সময়ের ঘটনা, ঋতুপর্ণ ঘোষ কিন্তু জাতীয় স্তরের বেশ সাড়া জাগানো নাম। এই দেখা না-করাটা আমাদের প্রত্যেকের চোখেই খুব অদ্ভুত লেগেছিল। সেই রাতে সারণের পিছনে আরও বেশি করে লাগা হয়। ঋতুদার যথেষ্ট মনে লেগেছিল ঘটনাটা। আর একটাও কথা বলেনি এটা নিয়ে। মিঠুনদা সেদিনও ‘ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন সেভেন্টি’ বলে ঝুলি খুলে বসেছিলেন। বিশ্বজোড়া যৌথ খামার না দেখার কষ্টে মনখারাপও করেছিলেন খুব। এসব সময় বাহাদুর তোয়ালে মোড়া একটা বোতল থেকে দ্রাক্ষারস জাতীয় কিছু একটা ঢেলে হাতে হাতে এগিয়ে দিত। তোয়ালে ঢাকা থাকত বলে ড্রিঙ্কটার নাম জানতে পারিনি কোনও দিন। সারণের অভিজ্ঞতা বলছে, মিঠুনদা ব্র্যান্ডি খেতেন। স্কচ খেতেন না। তবে ভীষণ দিলদরিয়া এক মানুষ, আমরা যা চাইতাম, তাই খাওয়াতেন।
রাজনীতি-শুটিংনীতি– সব হই হই করে যখন চলছে, তখন একটা কাণ্ড ঘটল! শুটিং চলাকালীনই খবর এল, নেপালে একটা বড় আকারে ম্যাসাকার ঘটেছে। রাজা ও রাজ-পরিবারের বেশ কয়েকজনকে মেরে ফেলেছেন রাজারই ছোট ভাই। রাজনৈতিক ভাবে নেপাল তখন এমনিই সমস্যায় জর্জরিত, তার মধ্যে এমন একটি ঘটনা চমকে দিল সকলকে!
পাহাড়ের খবর পাহাড় জুড়ে ছড়ায়। ঘন চাপ কালো মেঘের মতো শোকের চাদর ছড়িয়ে পড়ল উপত্যকায়, স্থানীয় মানুষজনের চোখের দৃষ্টি গেল পাল্টে। রাতে খাবার সময় যখন বাহাদুরকে দেখা গেল না, তখন সবার মনে পড়ল, বাহাদুরের তো দেশ ওটাই। কোথায়, বাহাদুর? খুঁজে পাওয়া গেল না সারা সন্ধে। শুধু রাতে একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। একটানা আর্তনাদের মতো সে আওয়াজ। একবার শুনলে যা ভোলা খুব শক্ত। বুঝতে অসুবিধে হয়নি– বাহাদুর কাঁদছে। আর ওইরকম কান্না শুনে ঘুমোনো যায় না কখনও। কতদিন বাহাদুর দেশছাড়া? বম্বে পাকাপাকি আস্তানা হয়ে গিয়েছে কবে। তবু রাজা হারানোর দুঃখ, তার কাছে বাবা হারানোর চেয়েও বড়। কী অপরিসীম এক আনুগত্য, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, একজন বাহাদুরের কান্না শুনে অবাক হচ্ছি এখানে, খোদ নেপাল দেশটায় না জানি কী ঘটছে? যে বিশ্বাস ও যুক্তিতে আমরা বাঁচি, সেখানে রাজতন্ত্রকে একটু খাটো চোখেই দেখা হয়, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বিপ্লব– এইসব শব্দবন্ধে তো আমাদের যৌবনের দেওয়াল লিখন। যদি এতটাই আনুগত্য থাকত কোনও আন্দোলনের প্রতি, তাহলে তো প্রবাসে দৈবের বশে এক ঝাঁক মেধা মুখ লুকোত না, আফসোসের গ্লাসে পড়ত না বিশ্বাসের চোনা, যে কান্না বাহাদুরের আছে, সেই কান্না বুঝি বয়ে বেড়ায় সব ব্যর্থ বাহাদুর বিপ্লবী?
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?