মৃত্যুর মৃদু আঘাতেই সমস্ত কিছু এক পলকে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আমি বলে যে কাঙালটা সবকিছুকে মুঠোর মধ্যে ধরতে চায়, সবকিছু মুখে পুরে গিলতে চায়, মৃত্যু ফাঁকি দেয় কেবল তাকেই। তখন মনের আক্ষেপে সংসারকেই ফাঁকি বলে সেই আমিটা যতই গালি দিক, সংসার একইরকম থাকে। সর্বত্রই মৃত্যুকে দেখা রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে মনের একটা বিকার।
২৪.
‘উপাসনাগৃহ’ শিরোনামে ধারাবাহিক লেখাগুলির শেষ, দুটি পর্ব শ্রাবণকে স্পর্শ করল। বাইশে শ্রাবণকে স্মরণ করে শেষ পর্বের জন্য বেছে নিলাম ‘মৃত্যু ও অমৃত’, যে অভিভাষণের শেষে ‘সোনার তরী’ কবিতার উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
মৃত্যুশোকের সঙ্গে সুপরিচিত কবি কিছুদিন আগে এক বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে বলছেন, ‘জগৎটা গায়ের চামড়ার মতো আঁকড়ে ধরেছিল, মাঝখানে কোনো ফাঁক ছিল না। মৃত্যু যখন প্রত্যক্ষ হল তখন সেই জগৎটা যেন কিছু দূরে চলে গেল, আমার সঙ্গে আর যেন সে অত্যন্ত সংলগ্ন হয়ে রইল না। এই বৈরাগ্যের দ্বারা আত্মা যেন নিজের স্বরূপ কিছু উপলব্ধি করতে পারল। সে যে জগতের সঙ্গে একেবারে অচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত নয়, তার যে একটা স্বকীয় প্রতিষ্ঠা আছে, মৃত্যুর শিক্ষায় এই কথাটা যেন অনুভব করতে পারলুম।’
সদ্যপ্রয়াত বন্ধু ধনী ছিলেন এবং ভোগীও। তাঁর জীবনে ভোগের আয়োজন অনেকের ঈর্ষারও কারণ ঘটিয়েছিল। সে সবকিছুই শ্মশানের একমুঠো ছাইয়ের মধ্যে যেন অনাদরে বিলুপ্ত হয়ে গেল। এই সময় মনে হয়, এজন্যই শাস্ত্রে বারে বারে মৃত্যুকে স্মরণ করে সংসারকে মিথ্যা মরীচিকা চিন্তা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। নাহলে ত্যাগ কঠিন হয়, ভোগের বন্ধনে জড়িয়ে থেকে আত্মা নিজের বিশুদ্ধ মুক্তস্বরূপকে উপলব্ধির পথ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন, সংসার কি সত্যিই মিথ্যা? তাঁর মনে হচ্ছে, সংসারকে মিথ্যা মরীচিকা বলে ত্যাগকে সহজ করে তোলার মধ্যে সত্যও নেই, গৌরবও নেই। বলছেন, ‘যে দেশে আমাদের টাকা চলেই না, সে দেশে আমাদের দেশের টাকার বোঝাটাকে জঞ্জাল বলে ফেলে দিতে পারার মধ্যে কোনও ঔদার্য নেই।’
রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে সংসার মোটেই মিথ্যা নয়। বন্ধুর প্রয়াণে সংসারের কোনও ক্ষতি হয়নি। সূর্যের আলোয় কালিমা পড়েনি, আকাশের নির্মল নীলিমায় দাগ পড়েনি। অফুরান সংসারের ধারা একইরকম পূর্ণ বেগে চলেছে। সংসারকে জোর করে মিথ্যা বললেই সংসার মিথ্যা হয়ে যায় না।
তাহলে অসত্য কোনটা? অসত্য হল সংসারকে আমার বলে জানা। আমার ওপরেই সব জিনিসের প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া মানে বালির ওপর ঘর বাঁধা। মৃত্যুর মৃদু আঘাতেই সমস্ত কিছু এক পলকে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আমি বলে যে কাঙালটা সবকিছুকে মুঠোর মধ্যে ধরতে চায়, সবকিছু মুখে পুরে গিলতে চায়, মৃত্যু ফাঁকি দেয় কেবল তাকেই। তখন মনের আক্ষেপে সংসারকেই ফাঁকি বলে সেই আমিটা যতই গালি দিক, সংসার একইরকম থাকে। সর্বত্রই মৃত্যুকে দেখা রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে মনের একটা বিকার। তাঁর উপলব্ধি, যেখানে অহং সেখানেই কেবল মৃত্যুর হাত পড়ে, আর কোথাও না। জগৎ কিছুই হারায় না, যা হারাবার হারায় কেবল অহং। যে ভোগী ব্যক্তি অহংকেই পূজা জোগাতে সারা জীবন খেটে মরে, মৃত্যুর সময় তার সেই ভোগস্ফীত অহং ‘সমস্তই রইল পড়ে, কিছুই নিয়ে যেতে পারলুম না’ বলে আক্ষেপ করে মরে।
………………………………………………………………………
‘সোনার তরী’ কবিতার অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন কবি– ‘মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করছে। তার জীবনের খেতটুকু দ্বীপের মতো, চারিদিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত, ঐ একটুখানিই তার কাছে ব্যক্ত হয়ে আছে। সেইজন্যে গীতা বলেছেন– অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত। অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা॥’ অব্যক্তের মধ্যে চরটি তলিয়ে যাবার সময় ঘনিয়ে এলে সমস্ত জীবনের কর্মের যা কিছু নিত্যফল সে সংসারতরণীতে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার সমস্ত নেয়, কিছুই ফেলে না। কিন্তু মানুষ যখন বলে, ‘আমাকেও নাও, আমাকেও রাখো’, সংসার বলে ‘তোমার জায়গা নেই, তুমি তো রাখবার যোগ্য নও’।
………………………………………………………………………
অনিত্য অহং আর সংসারের নিত্যতা, দুটোকেই স্পষ্ট করে জানতে বলছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘মৃত্যুর কথা চিন্তা করে এই অহংটাকেই যদি চিরন্তন বলে না জানি তা হলেই যথেষ্ট হল না– কারণ, সেরকম বৈরাগ্য কেবল শূন্যতাই আনে। সে সঙ্গে এও জানতে হবে যে এই সংসারটা থাকবে। অতএব আমার যা-কিছু দেবার তা শূন্যের মধ্যে ত্যাগরূপে দেব না, সংসারের মধ্যে দানরূপে দিতে হবে। এই দানের দ্বারাই আত্মার ঐশ্বর্য প্রকাশ হবে, ত্যাগের দ্বারা নয়– আত্মা নিজে কিছু নিতে চায় না, সে দিতে চায়, এতেই তার মহত্ত্ব। সংসার তার দানের ক্ষেত্র এবং অহং তার দানের সামগ্রী।’
‘সোনার তরী’ কবিতার অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন কবি– ‘মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করছে। তার জীবনের খেতটুকু দ্বীপের মতো, চারিদিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত, ঐ একটুখানিই তার কাছে ব্যক্ত হয়ে আছে। সেইজন্যে গীতা বলেছেন– অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত। অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা॥’ অব্যক্তের মধ্যে চরটি তলিয়ে যাবার সময় ঘনিয়ে এলে সমস্ত জীবনের কর্মের যা কিছু নিত্যফল সে সংসারতরণীতে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার সমস্ত নেয়, কিছুই ফেলে না। কিন্তু মানুষ যখন বলে, ‘আমাকেও নাও, আমাকেও রাখো’, সংসার বলে ‘তোমার জায়গা নেই, তুমি তো রাখবার যোগ্য নও’।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু-না-কিছু দান করে, সংসার সমস্তই গ্রহণ করে, রক্ষা করে। কিন্তু সেইসঙ্গে মানুষ যখন নিজের অহংটিকে চিরন্তন করে রাখতে যায়, সে চেষ্টা বৃথা হয়। অমর কবির সিদ্ধান্ত, ‘এই যে জীবনটি ভোগ করা গেল, অহংটিকেই তার খাজনাস্বরূপ মৃত্যুর হাতে দিয়ে হিসাব চুকিয়ে যেতে হবে। ওটি কোনোমতেই জমাবার জিনিস নয়।’
(সমাপ্ত)
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৩। জীবনে থমকে যাওয়াকে আমাদের দেশ অগৌরবের মনে করেনি
পর্ব ২২। কথা জিনিসটা মানুষের, আর গান হল প্রকৃতির
পর্ব ২১। আত্মার স্বরূপ শূন্যতা নয়, নিখিলের প্রতি প্রেম
পর্ব ২০। ভিতরের সাধনা আরম্ভ হলে বাইরে তার কিছু লক্ষণ টের পাওয়া যায়
পর্ব ১৯। মানুষের পক্ষে মানুষ হয়ে ওঠা সব থেকে কঠিন
পর্ব ১৮। যে হৃদয় প্রীতিতে কোমল, দুঃখের আগুন তাকেই আগে দগ্ধ করে
পর্ব ১৭। সাধনায় সাফল্যের আভাস মিললে সেই পথচলা সহজ হয়
পর্ব ১৬। প্রকৃতি ব্যক্তিবিশেষ মানে না, তার কাছে সকলে সমান
পর্ব ১৫। যিনি অসীম তিনি সীমার আকর হয়ে উঠেছেন ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা
পর্ব ১৪। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া
পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব