কোনও এক প্রলয়লীলা আমাদের জীবনবীণার সমস্ত আলস্যসুপ্ত তারগুলোকে কঠিনবলে আঘাত করলে তবেই হয়তো আমাদের মধ্যে সৃষ্টিলীলার আনন্দসংগীত বিশুদ্ধ হয়ে বেজে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আসবে কালবৈশাখী ঝড়, তার ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী রূপকে ভয় করলে চলবে না। সে বয়ে নিয়ে আসুক পরিপূর্ণতারই প্রকাশ।
১২.
সুজলা সুফলা বাংলায় এখন তাপপ্রবাহের দহন। কেবল সংবাদে আলোচনাসভায় নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় তাপের প্রখরতা অনুভবে ধরা দিচ্ছে। প্রকৃতির এই রুদ্ররূপের জন্য মানুষের কৃতকর্ম কতখানি দায়ী, সে বিষয়ে আলোচনার বিরাম নেই, কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিক আচরণে, ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক অথবা আন্তর্জাতিক আচরণে সচেতন সংযমের কোনও সামগ্রিক প্রয়াস প্রাধান্য পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ভারতীয় গণতন্ত্রের নির্বাচনী উত্তাপের মধ্যেও প্রকৃতির রোষশান্তির পথসন্ধানের ইঙ্গিত কিছু পাচ্ছি না। বরং লাদাখের শান্ত শীতলতাও ভোগাগ্নির আঁচে তপ্ত হয়ে ওঠার পরিচয় পেতে হচ্ছে।
‘না চাহিতে মোরে যা করেছ দান’ সেই মহাদানের যোগ্য হয়ে ওঠার সাধনাকে প্রাত্যহিক জীবনে ধারণ করার উপায় সম্পর্কে নির্দিষ্ট পথনির্দেশ রবীন্দ্রনাথের কাছে খুঁজে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন একজন শ্রদ্ধেয় পাঠক। শান্তিনিকেতন আশ্রমের জীবনচর্যায় উপকরণের বাহুল্য এড়িয়ে উদ্ভাবনের শক্তিকে বাড়িয়ে তোলার পরিসর চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রযুক্তির ব্যবহারে সতর্ক বিবেচনার পরামর্শ ছিল তাঁর। জীবনযাপনের ছন্দে প্রয়োজনের পরিমাণ না বাড়িয়ে, সর্বত্র সৌন্দর্য চেনার ইন্দ্রিয়চর্চায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আহার্যের স্বাদ বাড়ানোর জন্য শারীরিক পরিশ্রমকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন, ‘ক্ষুধা’ই যে সেরা ‘সস্’, এমন অভিমত ছিল তাঁর। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখে নিজেদের জীবনে তাকে গ্রহণ করবে মানুষ, মনুষ্যত্বের সার্থকতার সমবেত সাধনার সেই স্বপ্ন থেকে আজ ভোগসাধক আমরা অনেকখানি দূরে সরে এসেছি। কিন্তু, কবির তখনকার সময়েও, সেই স্বপ্ন যে অধরাই থাকছিল, সে কথাও রবীন্দ্রনাথের নানান অভিব্যক্তির মধ্যে বারে বারে প্রকাশিত হয়েছে। গত সপ্তাহে যে ‘নববর্ষ’ অভিভাষণের কথা লিখেছিলাম, আজও প্রথমে সেখান থেকেই কিছু কথা উদ্ধৃত করছি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শান্তিনিকেতন গ্রন্থে ‘নববর্ষ’ অভিভাষণের পরবর্তী ভাষণটির শিরোনাম ‘বৈশাখী ঝড়ের সন্ধ্যা’। তারিখ ৬ বৈশাখ ১৩১৮। উন্মত্ত ঝড়বৃষ্টির পর উপাসনাগৃহে সান্ধ্য উপাসনায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘এই পরিপূর্ণতার প্রকাশ যে কেমন– সে যে কী বাধাহীন, কী প্রচুর। কী মধুর, কী গম্ভীর– সে আজ এই বৈশাখের দিবাবসানে সহসা দেখতে পেয়ে আমাদের সমস্ত মন আনন্দে গান গেয়ে উঠেছে। আজ অন্তরে বাহিরে এই পরিপূর্ণতারই সে অভ্যর্থনা করছে।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘তোমার পৃথিবী আমাকে ধারণ করেছে, তোমার সূর্য আমাকে জ্যোতি দিয়েছে, তোমার সমীরণ আমার মধ্যে প্রাণের সংগীত বাজিয়ে তুলেছে, তোমার মহামনুষ্যলোকে আমি অক্ষয় সম্পদের অধিকার লাভ করে জন্মগ্রহণ করেছি; তোমার এত দানকে এত আয়োজনকে আমার জীবনের ব্যর্থতার দ্বারা কখনোই উপহসিত করব না। আজ প্রভাতে আমি তোমার কাছে আরাম চাইতে শান্তি চাইতে দাঁড়াই নি। আজ আমি আমার গৌরব বিস্মৃত হব না। মানুষের যজ্ঞ-আয়োজনকে ফেলে রেখে দিয়ে প্রকৃতির স্নিগ্ধ বিশ্রামের মধ্যে লুকোবার চেষ্টা করব না। যতবার আমরা সেই চেষ্টা করি ততবার তুমি ফিরে ফিরে পাঠিয়ে দাও, আমাদের কাজ কেবল বাড়িয়েই দাও, তোমার আদেশ আরো তীব্র আরো কঠোর হয়ে ওঠে। কেননা, মানুষ আপনার মনুষ্যত্বের ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে থাকবে তার এ লজ্জা তুমি স্বীকার করতে পার না। দুঃখ দিয়ে ফেরাও-পাঠাও তোমার মৃত্যুদূতকে, ক্ষতিদূতকে। জীবনটাকে নিয়ে যতই এলোমেলো করে ব্যবহার করেছি ততই তাতে সহস্র দুঃসাধ্য গ্রন্থি পড়ে গেছে– সে তো সহজে মোচন করা যাবে না, তাকে ছিন্ন করতে হবে। সেই বেদনা থেকে আলস্যে বা ভয়ে আমাকে লেশমাত্র নিরস্ত হতে দিয়ো না।… বারে বারে কত মিথ্যা সংকল্প আর উচ্চারণ করব। বাক্যের ব্যর্থ অলংকারকে আর কত রাশীকৃত করে জমিয়ে তুলব। জীবন যদি সত্য হয়ে না থাকে তবে ব্যর্থ জীবনের বেদনা সত্য হয়ে উঠুক– সেই বেদনার বহ্নিশিখায় তুমি আমাকে পবিত্র করো।’
জীবনকে নিয়ে যথেচ্ছাচার করতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, ব্যর্থতার বেদনা অনুভব করার সুযোগটুকুও কোথাও রাখছি না। সেইজন্যই হয়তো ‘বেদনার বহ্নিশিখা’ প্রকাশ পাচ্ছে প্রকৃতির দীর্ঘনিশ্বাসে। কোনও এক প্রলয়লীলা আমাদের জীবনবীণার সমস্ত আলস্যসুপ্ত তারগুলোকে কঠিনবলে আঘাত করলে তবেই হয়তো আমাদের মধ্যে সৃষ্টিলীলার আনন্দসংগীত বিশুদ্ধ হয়ে বেজে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আসবে কালবৈশাখী ঝড়, তার ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী রূপকে ভয় করলে চলবে না। সে বয়ে নিয়ে আসুক পরিপূর্ণতারই প্রকাশ।
শান্তিনিকেতন গ্রন্থে ‘নববর্ষ’ অভিভাষণের পরবর্তী ভাষণটির শিরোনাম ‘বৈশাখী ঝড়ের সন্ধ্যা’। তারিখ ৬ বৈশাখ ১৩১৮। উন্মত্ত ঝড়বৃষ্টির পর উপাসনাগৃহে সান্ধ্য উপাসনায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘এই পরিপূর্ণতার প্রকাশ যে কেমন– সে যে কী বাধাহীন, কী প্রচুর। কী মধুর, কী গম্ভীর– সে আজ এই বৈশাখের দিবাবসানে সহসা দেখতে পেয়ে আমাদের সমস্ত মন আনন্দে গান গেয়ে উঠেছে। আজ অন্তরে বাহিরে এই পরিপূর্ণতারই সে অভ্যর্থনা করছে।’
রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছেন, পরিপূর্ণতা আমাদের ছোট ছোট সংকীর্ণ চেষ্টার ওপর নির্ভর করে না। তাকে মৌচাকে মধু সঞ্চয় করার মতো একটু একটু করে জমিয়ে তোলা যায় না। বাড়ি তৈরির মতো একটু একটু করে গেঁথে তোলার বিষয় পরিপূর্ণতা নয়। কঠোর শুষ্কতা অত্যন্ত অভাবের মধ্যেও আমাদের অগোচরে পূর্ণস্বরূপের শক্তি কাজ করেই চলে। সময় হলে তবেই তার আবির্ভাব হয় অকস্মাৎ, বসন্তের এক নিশ্বাসে সমস্ত বনে ফুল ফোটানোর মতো। বহুদিনের জমে থাকা ঝরাপাতার স্তূপ এক নিমেষে ঝেঁটিয়ে ফেলে নৈরাশ্যের সমস্ত ধুলোর রাশিকে সে এক নিমেষে সবুজ করে তোলে।
দিকদিগন্ত পূর্ণ করা নিবিড় বৃষ্টিধারার রূপে সেই পরিপূর্ণতার স্পর্শের জন্য, গাছের সমস্ত পাতাদের সঙ্গে ঘাসেদের সঙ্গে ধুলিকণাদের সঙ্গে আজ সমস্ত আকাশের মধ্যে সমস্ত হৃদয়কে মেলে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসি।
(চলবে)
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব