অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে আসে শক্তির মন। তিনি চেয়ার টেনে টেবিলে রাখেন তাঁর লেখার খাতা। জানালার বাইরে চোখ যায় তাঁর। শক্তির মনে পড়ে, ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটক ‘ডক্টর ফস্টাস্’-এর শেষ অঙ্কে সূর্যাস্ত-রাঙা সেই আকাশ। শয়তান এসেছে ফস্টাস্-কে নরকে টেনে নিয়ে যেতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যাস্তরাঙা সেই বিপুল বিস্তারে ফস্টাস্ দেখতে পান ক্রাইস্টের রক্ত– তিনি লাফিয়ে ওঠেন সেই দিকে। কিন্তু শয়তানের টান তাঁর সেই প্রান্তজীবনের আরোহী বাসনাকে বাধা দেয়। ঈশ্বরের ডাক আসে ফস্টাসের কাছে। কিন্তু তার উত্তরণের পথ বন্ধ।
১৫.
কোনও এক ২৫ নভেম্বর, শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনন্ত অভিমানে নিজেকেই দিলেন নিজের জন্মদিনের এক উর্বর উপহার। টেবিলটা যেন বেশ জলজ্যান্ত এবং সৃজনে উজ্জ্বল আগ্রহী, একথা মনে হল শক্তির। এবং তাকে নিয়ে মহানন্দে বাড়ি ফিরে, ঈষৎ টলমল অবস্থায় যেই না শক্তি টেবিলটাকে ঘরের পশ্চিম কোণে সূর্যাস্তের আলোয় রাঙা জানালার ধারে অধিষ্ঠিত করেছেন, অমনি শক্তি শুনতে পেলেন এই সন্দেহাতীত ফিসফিস: অনেক দেরি করে ফেলেছ শক্তি, এবার কাজটা করে ফেল, এভাবে ফ্যালফেলে ভগবানকে অযথা অপেক্ষা করিয়ে রেখে হিউমিলিয়েট করা ঠিক হচ্ছে না। তোমার শরীরে কি এতটুকু মায়া-দয়া নেই?
মায়া-দয়া, না দয়া-মায়া? সামান্য খটকা লাগে শক্তির। বারদুয়ারিজাত ঝাপসামির মধ্যে এই খটকাটুকু স্বাভাবিক। তাছাড়া, টেবিলের বাংলার সঙ্গে বাঙালির বাংলার সামান্য গরমিল, ইডিয়মের নড়বড়েমি-ও স্বাভাবিক। কিন্তু টেবিলটা জানল কী করে তাঁর জন্মদিন ২৫ নভেম্বর? যাদের জন্য পদ্য লিখতে লিখতে শক্তি তাঁর জীবনটাকে খোলামকুচির মতো ব্যয় করছেন, তাদের মধ্যে ক’জন বাঙালি মনে রেখেছে এই তারিখটা, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই তারিখে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন বলে? এছাড়া আরও একটি বিশেষ জরুরি প্রশ্ন কম্পমান শিখার মতো মাথা তুলল শক্তির চেতনায়: টেবিলটা জানল কী করে ঈশ্বরের প্রতি কোন অবশ্য-কর্তব্যটি তিনি ক্রমাগত ঝুলিয়ে রেখেছেন কোহলবহ্নিত নানা অছিলায়?
অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে আসে শক্তির মন। তিনি চেয়ার টেনে টেবিলে রাখেন তাঁর লেখার খাতা। জানালার বাইরে চোখ যায় তাঁর। শক্তির মনে পড়ে, ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটক ‘ডক্টর ফস্টাস্’-এর শেষ অঙ্কে সূর্যাস্ত-রাঙা সেই আকাশ। শয়তান এসেছে ফস্টাস্-কে নরকে টেনে নিয়ে যেতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যাস্তরাঙা সেই বিপুল বিস্তারে ফস্টাস্ দেখতে পান ক্রাইস্টের রক্ত– তিনি লাফিয়ে ওঠেন সেই দিকে। কিন্তু শয়তানের টান তাঁর সেই প্রান্তজীবনের আরোহী বাসনাকে বাধা দেয়। ঈশ্বরের ডাক আসে ফস্টাসের কাছে। কিন্তু তার উত্তরণের পথ বন্ধ।
টেবিল শক্তির কানে কানে মনে করিয়ে দেয় ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অবশ্য-কর্তব্য। শক্তি লেখেন তাঁর পদ্যের খাতায়:
ঈশ্বর থাকেন জলে
তাঁর জন্য বাগানে পুকুর
আমাকে একদিন কাটতে হবে।
কত বছর আগে এই সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন শক্তি। কতবার টালমাটাল পায়ে বাগানে দাঁড়িয়েছেন তিনি, ঠিক সেখানে, যেখানে কাটবেন পুকুর– কিন্তু নানা কাজের ব্যস্ততায় আর কাটা হল না পুকুর। ভগবানকে এইভাবে অপেক্ষা করিয়ে রাখা মোটে ভালো কাজ নয়। বুঝতে পারেন শক্তি। অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয় তাঁর মন।
তিনি তাকান তাঁর টেবিলের পানে। জন্মদিনে এইভাবে অপরাধবোধে কষ্ট পাওয়া, সেটাও কোনও কাজের কাজ নয়। একা মানুষ তিনি। তেমন সবল নন। প্রায় সারাক্ষণ ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এর অনিকেত দোলাচলে। কীভাবে এই টালমাটাল অবস্থায় ঈশ্বরের জন্য কাটবেন প্রতিশ্রুত পুকুর? এই বাস্তব সমস্যাটুকু ঈশ্বরের বোঝা উচিত। শক্তির মনে হয়, টেবিলটা শক্তির এই ভাবনাকে সমর্থন করে। এবং তাঁর কলমের ডগায় নিয়ে আসে অনর্গল কয়েকটি অব্যর্থ শব্দ, বাক্য, সংকেত:
আমি একা…
এই দু’টি শব্দ লেখার পর, অসহায় শক্তি কলম গুটিয়ে তাকিয়ে থাকেন শব্দ দু’টির ক্লান্ত শরীরের দিকে। তাঁরই মতো ক্লান্ত ও দুর্বল শরীর। শব্দ দু’টির শেষে কয়েকটি ‘ডট্’ বসিয়ে দেন শক্তি, যারা ছুটে যায় অনন্তের পানে, যেখানে নাকি মিশে যেতে পারে পাশাপাশি-চলা দু’টি সমান্তরাল রেললাইন। এই ভাবনা মাতাল ইউক্লিডের, এই বিষয়ে শক্তি নিশ্চিত হন। এবং আরও একটি বিষয়ে সন্দেহ নেই শক্তির, অন্তত ট্রেনে করে অনন্তে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। প্যারালাল রেললাইন জুড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা নিশ্চিত সেখানে। তারপর হয়তো টেবিলটার অশেষ সৌজন্যে, অনন্ত থেকে শক্তি ফিরে আসেন, মুহূর্তে আলোকবর্ষের দূরত্ব পার হয়ে, এই সুধাশ্যামলীম যাচনায়:
ঈশ্বর থাকুন কাছে, এই চাই–
জলেই থাকুন!
‘জলেই থাকুন’– ঈশ্বরের বাসা জল, কেমন করে ভাবলাম আমি, ভাবেন অবাক শক্তি। কেন ভেবেছি আমি ঈশ্বরের জন্য বাগানে পুকুর-কাটার কথা? কেননা, আমার বিশ্বাস, ভাবেন শক্তি, ঈশ্বর আরাম পাবেন জলেই। ‘জলের শান্তিটি তাঁর চাই, আমি, এমনই বুঝেছি।’
এই বাক্যটি তো আমার! কিন্তু এমন বোধ, জলের শান্তিটি চাইছেন ঈশ্বর, এল কোথা থেকে? ঈশ্বর কি মাছ? অনেক গভীর জলের মাছ? যেখানে প্রবেশ করতে পারে না সূর্যালোক। কোনও দিন ঘুচবে না সেই আদিম আঁধার গভীর জলরাশি থেকে! তাই মাছেরা সেখানে জন্মান্ধ। ওই আদিম জলরাশির কৃষ্ণগহ্বরে, যেখানে পৌঁছবে না আলোর কণাটুকু, সেখানে চোখের কী প্রয়োজন? সেখানে অন্ধ মাছেরা নিবিড় সাঁতারে শুধু দৃষ্টিহীন অনুভব নিয়ে কেটে চলেছে সাঁতার, ভাবেন শক্তি। আর তখুনি বুঝতে পারেন, ঈশ্বর আসলে লিকুইড। তিনি আকারহীন অসীম তারল্য। কোনও চিন্তনীয় শরীর নেই তাঁর। এই কারণেই তাঁকে কাছাকাছি রাখতে বাড়ির বাগানে একটি পুকুরের বড়ই প্রয়োজন।
তবে ঈশ্বরকে কাছাকাছি রাখার একটি বড় সমস্যা আচমকা ঝাপটা মারে শক্তিকে। টেবিলটাও কেমন যেন ঘাবড়ে যায়। সামলাতে পারে না সেই ঝাপটা। ‘থ’ মেরে চুপ করে যায়। শক্তি টেবিলে রাখা পদ্যের খাতায় না লিখে পারেন না, ‘কাছাকাছি থাকলে শুনি মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পর্ক রাখাই দায়’।
কিন্তু পঙক্তিটি লেখার পরেও স্বস্তি নেই শক্তির মনে। আমবাতের মতো ক্রমাগত লাইনটা চুলকোতে থাকে। হঠাৎ টেবিলটা যেন মৃদু হেসে বলে ফেলে একটি গূঢ় সত্য:
তিনি তো মানুষ নন।
এই গূঢ় সত্য শক্তির মনে জাগল না কেন? কেন কাঠখোদাইয়ে ধরা দিল টেবিলের মনে?
কেমন যেন ‘হীনতা’ বোধ জাগে শক্তির চেতনায়। এমন একটি বাক্যবন্ধ তিনি লিখতে চান এখন তাঁর হীনতাবোধকে খতম করতে যে-বাক্যবন্ধের কোনও দিন পুরো নাগাল পাবে না বাঙালি।
লেখেন শক্তি: ‘তাছাড়া দূরের বাগানে থাকলে, শূন্য দূরত্বও আমাদের সম্পর্ক বাঁচাবে।’
কী আশ্চর্য শব্দের খেলা! ভাবেন শক্তি। এই শব্দের খেলা, চাতুর্য তাঁকে বাঁচাল কাছের বাগানে ঈশ্বরের জন্য পুকুর-কাটার কর্তব্য, দায়িত্ব ও পরিশ্রম থেকে। একা একা কাজটি করাও অসম্ভব।
কিন্তু আসল, খাঁটি, নিখাদ দার্শনিক এবং গাণিতিক গভীরতা ‘দূরের বাগানে থাকলে শূন্য দূরত্ব’– এই ভাবনাটার মধ্যে। এটা দেবতার দান, মনে হয় শক্তির। কিংবা প্রমত্ত প্রতিভার প্রদান?
না, না, এই ভাবটি কি টেবিলের শরীরের কাছে কোনওভাবে ঋণী নয়? টেবিলের বুকে রাখা কাগজের ওপরেই কি ফুটে ওঠেনি এই দার্শনিক ধাঁধা? ফিশফিশ শুনতে পান শক্তি কানে কানে! টেবিলের গায়ে মার্জার আদরে হাত বোলান শক্তি। তাছাড়া, ঈশ্বর শুধু কি কাছের বাগানে পুকুরের জলে জল হয়ে থাকতে আরাম পান? এই বোধ শক্তির চেতনায় কানায় কানায় উপচে ওঠে, ঈশ্বর আছেন কোহলের বহ্নিস্রোতে, কোহলে কোহল হয়েই, আলাদা করার উপায় নেই।
মদেও ঈশ্বরের বাস, মদে মদ হয়ে মিশে আছেন তিনি, পৃথক অস্তিত্বে নয়। এই ভাবটি গেঁথে নিয়ে ছিলেন বলেই শক্তি লিখতে পেরেছিলেন, ‘অহোরাত্র মদ খাই, অহোরাত্র পদ্য লিখি।’ পদ্য লেখার পর তাঁর অবস্থার কথা নিজেই জানিয়েছেন শক্তিদা: ‘পদ্য লেখার পর আমার আর কোনও কায়িক শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। তখন আমি শক্তির মড়া। যখন পদ্য লিখি, মনে হয়, আমি পাঁক জলে ডুবি। তখন আমার চেহারা, মনে হয়, বদলে যায়। মনে হয় কত গালমন্দ করি, কত ভালোবাসার কথা বলি, কত ক্ষমা করি চতুর্দিক– এইসব করি।’
.……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….
আর পদ্য লেখার পর সমস্ত কায়িক শক্তি নিংড়ে দিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় শক্তির মড়া হয়ে মাথা এলিয়ে দেন অকাতরে লেখার টেবিলেই।
কখন কি শক্তিদার মনে হয়েছে নিগূঢ় জাদু, অনির্ণেয় অবদান ও অভিশাপ ২৫ সংখ্যাাটির মধ্যেই? কখনও বৈশাখের ২৫ মধ্যরাতে হাতড়ে বেড়াচ্ছে জোড়াসাঁকোর প্রাসাদের ছাদে, নিঃসঙ্গ অন্ধকারের শরীর কিংবা একা ভাসছে পদ্মার জলে! কখনও নভেম্বরের ২৫, ঈশ্বরের সঙ্গে কলকাতার ট্রামলাইন ধরে মধ্যরাতে দিয়েছে উন্মত্ত দৌড়!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল
এই সহস্রাব্দীতে বিশ্বের যে তিনটি বড় সংঘর্ষ, ইরাক, ইউক্রেন এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন, সবক’টাই কূটনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ‘নিয়ন্ত্রিত’ভাবে যুদ্ধ জিইয়ে রাখা হয়েছে। আর তার জন্য বিশ্বজুড়ে নির্মিত হয়েছে বিপুলায়তন স্যাটেলাইট-টিভি নামক এক অ্যাম্ফিথিয়েটার।