তাঁর লেখার টেবিলের মনের কথা ইদানীং গিয়েছিল বদলে। যতবার বসতেন লিখতে, ততবার একটি বাক্য ফুটে উঠত লেখার টেবিলের বুকে, খোদাই করা অক্ষরে। ভার্গাস, কী হবে লিখে? তুমি কি এখনও বোঝোনি, তোমার লেখা পড়ার মতো মানুষ আর নেই? আমাদের নতুন সভ্যতা তাদের মেরে ফেলেছে! সময় নেই পড়ার। সময় আর শান্ত হয়ে দাঁড়ায় না। সময় ছুটছে। কীসের পিছনে এই ছুট? জানে না সময়।
৩৬.
এসেছিলেন ১৯৩৬-এর ২৮ মার্চ। চলে গেলেন ৮৯ বছরের জন্মদিন পেরিয়ে ২০২৫-এর ১৩ এপ্রিল। জন্ম-মৃত্যু পেরুতে। তবু তিনি আন্তর্জাতিক। এবং তিনি বাঙালির লোসা। কিছুতেই ওসা নন। ইংরেজ যেমন কোনও দিন প্যারিসকে ‘পারি’ বলেনি, বাঙালিও পেরুর নোবেলজয়ী লেখক Mario Vargas Llosa-কে ‘জোড়া এল’-এর তর্জন তাচ্ছিল্য করে ‘ওসা’ ডাকেনি, ডাকবেও না।
‘লোসা’ বাঙালির ন্যাকা জিভের পক্ষে বেশি আরামের। মারিও ভার্গাস লোসা যদি বাঙালি হতেন, তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ছবি বিশ্বাসের জায়গাটা নিতে পারতেন। তিনি কাঁটায় কাঁটায় অভিজাত বাঙালি, এতটাই মিল। অথচ পেরুর রাজধানী লিমায় কাটালেন শেষজীবন, নোবেলজয়ী একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে!
তাঁর লেখার টেবিলের মনের কথা ইদানীং গিয়েছিল বদলে। যতবার বসতেন লিখতে, ততবার একটি বাক্য ফুটে উঠত লেখার টেবিলের বুকে, খোদাই করা অক্ষরে। ভার্গাস, কী হবে লিখে? তুমি কি এখনও বোঝোনি, তোমার লেখা পড়ার মতো মানুষ আর নেই? আমাদের নতুন সভ্যতা তাদের মেরে ফেলেছে! সময় নেই পড়ার। সময় আর শান্ত হয়ে দাঁড়ায় না। সময় ছুটছে। কীসের পিছনে এই ছুট? জানে না সময়।
এই যে আমার একলা শোবার ঘর। আমার একলা জীবন। আমার খাটের পাশে খোলা র্যাকে ভার্গাস, আপনার চারটে বই ক্রমিক ধুলোর আচ্ছন্নতা আদরে গায়ে মেখে। তারা ‘দ্য নেবারহুড’, ‘দ্য ডিসক্রিট হিরো’, ‘দ্য স্টোরিটেলার’, আর আপনার বিপুল বই, মন্থর মাস্টারপিস– ‘দ্য ওয়ার অফ দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড।’ যার হলদে হয়ে যাওয়া পাতায় আপনার অমোঘ কিছু লাইন আমাদের জীবনের মতো:
You have three choices left to you. The first is to present a formal complaint accusing me of abuse of authority. The second is to come ask me for satisfaction, whereupon you and I will settle this matter man to man, with revolvers, or knives or whatever other weapon you like. And the third is to try to kill me from behind. So then what is your choice?
ভার্গাস, যতবার পড়ি আপনার লেখা এই ক’টি বাক্য, গা শিউরে ওঠে। জীবন কী নির্মম কৃপণ! এই তিনটি বিকল্প ছাড়া আমাদের আর সত্যিই কোথাও পালাবার জায়গা নেই। তবু কী ব্যর্থ প্রচেষ্টায় আরও সহনীয় কোনও বিকল্পের আশায় ছুটেই চলেছি! কিছুতেই এই নিষ্ঠুর বাস্তবের মুখোমুখি হতে পারি না।
‘দ্য ওয়ার অফ দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর উৎসর্গপত্রের পরের পাতায় শুধু একটি বাক্য। চারটি লাইন। ১৭টি শব্দ। এবং কবিতার গঠনে লেখা হাজার সূর্যের থেকে জ্বলন্ত গদ্য:
The Antichrist was born
To govern Brazil
But the Counselor is come
To deliver us from him.
এই মুহূর্তে আমাদের চারপাশের ছবিটা ঠিক এইরকম। এর বেশি আর একটি শব্দও খরচ করা এই বিষয়ের চর্চায় অর্বাচীন কাজ হবে। বরং অন্য একটি রোচক বিষয়ে যাই, যে তাপন গেরস্ত বাঙালির ভালো লাগবেই। এবং আমি তাদেরই একজন। ভার্গাস, আপনার লেখায় রক্তমাংসের যৌনতা থেকে বাঙালির বাপের সাধ্য নেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি চেটেপুটে খেয়েছি। আপনার গম্ভীর লেখা যে বাজারে খেয়েছে, তার একটা বড় কারণ তো অকপট দেহবাদ!
লেসবিয়ান সম্পর্ক লেবুর মতো নিংড়ে রতি রসে বিছানা সপসপে করেছেন আপনি। বাঙালির মনে উসকেছেন মৈথুনমন্থন। আপনার ‘দ্য নেবারহুড’ উপন্যাসের শুরু। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না, আপনি কী করে আরম্ভেই সমান আকর্ষণে পাঠক ও পাঠিকাকে আঁকড়ে ধরবেন, বিশ্বজুড়ে। কারণ আপনি জানেন, আপনার যে কোনও লেখা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে অনূদিত হয় অন্তত ৩০টি ভাষায়। ১৯১০ সালে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরে লেখার আগেই দুর্বার দামে তা বিক্রি হয়ে যায় প্রকাশকের কাছে। তারপর তো বিশ্বজোড়া ফাঁদ পাতেন আপনি।
কেমনে দিই ফাঁকি!
‘দ্য নেবারহুড’ উপন্যাসের আরম্ভে এই ফাঁদের নির্ভুল জ্যামিতি:
চাবেলা আর মারিসা, দুই মহিলা বিছানায়। পাশাপাশি। ঘুমোনোর চেষ্টায়। মারিসা বুঝতে পারে তার ডান পায়ের চেটোতে বন্ধু চাবেলার পায়ের ঈষৎ চাপ। আস্তে বাড়ে চাপ। ইঙ্গিত। ইশারা। কিছু যেন চাইছে সেই ছোঁয়া। দু’জনের মধ্যে একজন ঘুমের আড়ালে অন্যজনের কাছে কয়েক ইঞ্চি সরে এসেছে, যাতে পায়ে পা ঠেকে। কে কাছে সরেছে?
মারিসা একেবারে নড়ছে না। নিশ্বাস বন্ধ করে আছে। পাছে চাবেলা সাবধান হয়ে পা সরিয়ে নেয়। বন্ধুর পায়ের চাপ ও চাওয়া মারিসার ভালো লাগছে। সারা শরীর তার শিউরে সাড়া দিচ্ছে। মারিসা হঠাৎ অনুভব করে তার দেহ ইতিমধ্যে পুরোপুরি জেগে উঠেছে। বন্ধুর পা তার পায়ের চেটোতে হালকা চাপ দিয়ে আগুন ধরিয়েছে। ‘হ্যাড সেট ফায়ার টু হার স্কিন অ্যান্ড সেন্সেস।’
মারিসা বুঝতে পারে, এখন যদি সে তার দুই ঊরুর মাঝখানে হাত দেয়, তার হাত রসে ভিজবে। তোমার হল কি মারিসা? বিছানায় তুমি আর একটা মেয়ের ছোঁয়ায় উত্তেজিত হচ্ছ? এটা কী রকমের পাগলামি? ‘গেটিং এক্সসাইটেড বাই আ উওম্যান?’
মারিসা আরও একটু গভীরভাবে ভাবে। নাগাল পায় ভেতরের সত্যির। স্বমেহনের সময়, সে কতবার মাস্টারবেশনকে তাড়াতাড়ি চরম বিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে চাবেলার শরীর ভেবে। তাহলে, তার মধ্যে তো এই ব্যাপারটাও আছে। অথচ কত পুরুষের সঙ্গেও তো সে শুয়েছে এই বিছানায়। নারী হোক, পুরুষ হোক, তার শরীর চায় উভকাম। একই উত্তেজনা। একইরকম তৃপ্তি। না, না, ভুল। মারিসা তার মাস্টারবেশনের কথা আরও একবার ভাবে। কোথাও কোনও নারী নেই। সে তো মাস্টারবেট করে বালিশ নিয়ে। বালিশের সঙ্গেই তার সব কাজ হয়। ‘শি হ্যাড মাস্টারবেটেড রাবিং আ পিলো বিটুইন হার লেগস। বাট অলওয়েস থিংকিং আবাউট মেন। নেভার আ উওম্যান। নেভার!’
কিন্তু এই মুহূর্তের মারিসা পাগলের মতো চাইছে তার সমস্ত শরীরে আর এক নারীকে। শুধু পা নয়। তার সমস্ত শরীরে সেক্সের চিৎকার। সমস্ত শরীর জুড়ে, দেহের সর্বত্র, লটকে যাক, এঁটে যাক তার বন্ধুনি, ‘দ্য ক্লোজনেস অ্যান্ড ওয়ার্মথ্ অফ হার ফ্রেন্ড অলঅ্যালং হার বডি।’
মারিসা খুব সাবধানে পাশ ফেরে। যেন ঘুমোতে ঘুমোতে পাশ ফেরে। এবার চাবেলার পিঠ, নিতম্ব, পা তার থেকে মিলিমিটার দূরে। মারিসা খুব আস্তে বন্ধুনির ঊরুতে ডান হাত রাখল। চাবেলার ঊরুটা ভিজে ভিজে। বোধহয় নাইট ক্রিম মাখার জন্য। বন্ধুনির নিতম্ব থাই– সব কী টাইট। কে বলবে দুটো বাচ্চার মা! নিজেকে দারুণ রেখেছে কিন্তু। মারিসা হঠাৎ বুঝতে পারে চাবেলার দেহ কাঁপছে। তার নিতম্ব, তার ঊরু কাঁপছে। চাবেলা জেগে! মারিসা এবার নিজেও কাঁপছে। এবার সব নিজে থেকে হচ্ছে। কারও কিছু করার নেই। দু’জনের দুটি দেহ কাঁপতে কাঁপতে মিলিত হচ্ছে, এক হয়ে যাচ্ছে। তারপর দু’জন দু’জনকে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল। প্রথমে ঠোঁটে। তারপর মুখের মধ্যে। তারপর জিভের সঙ্গে জিভ। তারপর চুমু নামল পরস্পরের স্তনে। উত্তেজনা এমন তীব্র ওরা ছিঁড়ে ফেলল নাইটি। সম্পূর্ণ উলঙ্গ, ‘ক্যারেসিং ইচ আদার্স ব্রেস্টস, কিসিং দেম, অ্যান্ড দেন আর্মপিট্স অ্যান্ড বেলিস হোয়াইল দে রাবড ইচ আদারস সেক্স।’ তারা পরস্পর যৌনাঙ্গে রগড়ে রগড়ে কম্পন ধরিয়ে দিল। মনে হল, এমন কম্পন যা কোনওদিন থামবে না। দু’জনের। একসঙ্গে। চলছে তো চলছেই। ‘সো ইনফিনিট অ্যান্ড ইন্টেন্স।’
দু’জনেই জানে, পুরুষের সঙ্গে এটা হয় না।
মারিও, এই আপনার মায়াবি ম্যাজিক। যতই গভীর গম্ভীর হোক আপনার বিষয়। আপনার লেখার টেবিল আপনাকে দিয়েছে, আদিরসের আদিম মন্ত্রশুদ্ধি! কত ভাষা, ভঙ্গি ও ভরসা যে আপনি রোপণ করেছেন আমার মধ্যে, দিয়েছেন পথ ও প্রত্যয়। আমি নতজানু কৃতজ্ঞতায়। আপনাকে রুখবে কে? আপনি যুগ যুগান্তরের বেস্ট সেলার। আপনি জানেন পাঠক পাকড়াতে। জানেন সাহিত্যের মর্যাদা ও বাজার একই সঙ্গে ধরে রাখতে।
আপনার লেখার টেবিল নিলামে কত দামে বিকোবে, কে জানে! কোনও বাঙালি লেখক নাগাল পাবেন কি?
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি
পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল