Robbar

বঙ্গীয় সমাজে বোভেয়ার ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর ভাবনার বিচ্ছুরণ কতটুকু?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 5, 2025 8:16 pm
  • Updated:May 5, 2025 8:16 pm  

১৯৪৯-এ ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইটি লিখেছিলেন সিমোন। যে বইয়ের কেন্দ্রে এক নারী-মনের অনন্ত বিদগ্ধ বিচ্ছুরণ! সে আধুনিক মেয়ে বলছে, আমার জন্ম পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য নয়। আমার জীবনের সার্থকতা পুরুষের ঔরসে সন্তান ধারণের মধ্যে নয়। শরীরে শুধুমাত্র সন্তান ধারণের ক্ষমতার মধ্যেই সীমিত নয় আমার অন্তহীন সৃজনশীলতা। আমার মধ্যে আমার নিজস্ব একটা ভাবনার ঘর ও ঘোর আছে, যা শুধুই আমার। আমার সঙ্গে সেই পুরুষের সহবাস সম্ভব, যে পুরুষ মেনে নেবে আমার নিজস্ব ভাবনার ঘর।

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৮.

সিমোন দ্য বোভোয়ার মনে শান্তি নেই। তিনি বিশ্বাস করেন, নারীকে অর্জন করতেই হবে পূর্ণ স্বাধীনতা। কিন্তু ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ বলতে যা বোঝেন তিনি, তা কি বোঝে পৃথিবীর অন্য কোনও নারী?

প্যারিসে সূর্য ডুবছে। তিনি একা তাঁর লেখার ঘরে। তাঁর লেখার টেবিলে সূর্যাস্তের রাঙা আলো ম্লান হয়ে আসছে। সেই দিকে তাকাতেই এক বিহ্বল বিষাদ গ্রাস করল সিমোনকে।

What Simone de Beauvoir's 'Inseparable' Says About Freedom - The Atlantic
সিমোন দ্য বোভোয়া

নারী কি সত্যি কোনও দিন অর্জন করতে পারবে তার পূর্ণ স্বাধীনতা পুরুষের শাসন থেকে, সমাজের নিপীড়ন থেকে, অর্থনৈতিক চাপ এবং বঞ্চনা থেকে? নারী কি ছিনিয়ে নিতে পারবে তার পূর্ণ স্বাধীনতার শীর্ষ শর্ত? জরায়ুর অধিকার? নারী কার সন্তান ধারণ করবে, স্বামীর না প্রেমিকের, নারী নেবে সেই সিদ্ধান্ত! সম্ভব?

১৯৪৯ সাল। সমাজ বদলাচ্ছে। সংসার পাল্টাচ্ছে। পুরনো মূল্যবোধ, পুরনো ধর্মবিশ্বাস, পুরনো জীবন-দর্শন, নারী-পুরুষের সম্পর্কে পুরনো কুণ্ঠা ও সংশয়, সব গুঁড়িয়ে দিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসারিত ধ্বংস ও মৃত্যু। তবু কমেছে কী পুরুষের নারী-নিপীড়ন? ভালোবাসার নারীকে কি অধিকারবোধ ছাড়া ভালবাসতে পারে পুরুষ? কোনও স্বামী কি ভাবতে পারে আমার স্ত্রী কোনও ভাবেই আমার সম্পত্তি নয়? নয় সে আমার খেলা ও খেয়ালের পুতুল। নারীকে নিয়ে আমার সংসার পুতুলের গৃহ নয়! এমন একটি শরীরের সঙ্গে আমার সহবাস, যার একটা মন আছে। যে মন চিরদিন আমাকে ভালোবেসে মেনে নেবে বশ্যতা, এই সামাজিক ন্যাকামি-তে সেই মন প্রত্যয় হারাতেই পারে! পুরুষ কি কোনও দিন এভাবে ভাববে? এই তোলপাড় ভাবনায় আক্রান্ত সিমোনের মন, ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত, যখন তিনি তাঁর সামনে এই লেখার টেবিলে বসেই লিখলেন তাঁর পৃথিবী কাঁপানো ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ গ্রন্থ। এবং একেবারে নতুন ভাবনায় খোদাই করলেন নারী-পুরুষের সম্পর্ক!

সিমোন দ্য বোভোয়ার ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ গ্রন্থ

বিয়েতে বিশ্বাস করেন না সিমোন। সহবাস করেন ভুবন বিখ্যাত দার্শনিক, ইন্টেলেকচুয়াল সার্ত্রের সঙ্গে। কখনও তাঁরা পরস্পরকে জানিয়ে, কিংবা না জানিয়ে, স্বাদ বদলাতে চলে যান অন্য সহবাসে। আবার ফিরে আসেন পুরনো সহবাসে। নারী জীবনের সার্থকতা মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার মধ্যে, পুরুষশাসিত সমাজের এই মিথ্যা প্রচারে বিশ্বাস করেন না সিমোন। সুতরাং, তিনি মা হতে চাইলেন না। তবে জন্ম দিলেন একের পর এক গ্রন্থের। পিষে থেঁতলে দিলেন নারী-পুরুষ সম্পর্কের প্রাচীন-অর্বাচীন বোধ। সিমোনের নারী পুরুষের প্রেমে পড়ে বলতে পারল শেষ পর্যন্ত, আমাদের ব্যক্তিগত পরিসর কিন্তু আলাদা থাকবেই। পুরুষ, তুমি তোমার পরিসর আগলে রেখো। আমি আগলে রাখব আমার পরিসর। এবং এই পরিসরের মধ্যে এসে পড়ে তোমার-আমার নিজের নিজের শরীরের অধিকারের প্রশ্ন। মনে রেখো, দেহের সম্পর্কে আমরা পরস্পরের কাছে প্রার্থী। অধিকার ফলানোর কোনও জায়গা নেই সহবাসে, এমনকী, বিবাহিত সম্পর্কেও।

Jean-Paul Sartre & Simone de Beauvoir Loved the Jews - Jewish Telegraphic Agency
নিশানায় স্থির সিমোন দ্য বোভোয়া, সঙ্গী জঁ-পল সার্ত্র

‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইটি ২০২৫-এও আমাদের চমকে দেয়। এই প্রসঙ্গে বাঙালি মেয়েদের কথা একটু বলি।

১৯৪৯-এ এই অনন্য বইটি লিখেছিলেন সিমোন। যে বইয়ের কেন্দ্রে এক নারী-মনের অনন্ত বিদগ্ধ বিচ্ছুরণ! সে আধুনিক মেয়ে বলছে, আমার জন্ম পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য নয়। আমার জীবনের সার্থকতা পুরুষের ঔরসে সন্তান ধারণের মধ্যে নয়। শরীরে শুধুমাত্র সন্তান ধারণের ক্ষমতার মধ্যেই সীমিত নয় আমার অন্তহীন সৃজনশীলতা। আমার মধ্যে আমার নিজস্ব একটা ভাবনার ঘর ও ঘোর আছে, যা শুধুই আমার। আমার সঙ্গে সেই পুরুষের সহবাস সম্ভব, যে পুরুষ মেনে নেবে আমার নিজস্ব ভাবনার ঘর।

Paris: in the footsteps of Simone de Beauvoir

ঠিক তেমনই, পুরুষের সঙ্গে দেহের সম্পর্কে নারী-পুরুষের সমান ভূমিকা, সমান উপভোগ। কখনও নারী ওপরে। কখনও পুরুষ। ‘উইমেন অন টপ’, এই বিপ্লবের বীজ রোপণ করলেন সিমোন। কিন্তু সত্যি কি তাই? নারী-পুরুষ সম্পর্কে যে বিপ্লব গেয়েছিলেন সিমোন, তা কি সারা পৃথিবী গ্রহণ করেছে? না করেনি। ১৯৪৯-এর এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় বুঝতে পারলেন সিমোন। কী বিপন্ন বিষণ্ণতা! এবং নারী চায়নি তার পূর্ণ স্বাধীনতা, সিমোনকে ডুবিয়েছে নারী। নারী একই সঙ্গে চায় স্বাধীনতা এবং পুরুষের শাসন। একই সঙ্গে চায় স্বাধীনতা এবং বিয়ের রক্ষাকবচ। একই সঙ্গে চায় স্বাধীনতা এবং একই পুরুষের শাসনে পোষণে বেঁচে থাকার ঘেরাটোপ ও খাঁচা। কোথায় আমাদের সমাজে ‘সেকেন্ড সেক্স’ বইয়ের সেই পরমা, যার ভাবনার বিচ্ছুরণ তার একমাত্র সজ্জা, তার একমাত্র অলংকার, তার একমাত্র আলো, তার একমাত্র পরিচয় ও অভিজ্ঞান?

Simone De Beauvoir And A Brief Overview Of Her Life And Legacy | Rock & Art

এই মেয়ে বলছে, শোনো যুগ যুগান্তরের মেয়েরা, তোমরা কিছুই করবে না পুরুষের মন ভোলাতে। ঠোঁটে রং দেবে না। চোখ, ভুরু, চোখের পাতা, গালের আভা, ত্বকের জ্যোতি, চুলের নানাবিধ প্রসাধন বা স্তনের ইচ্ছাকৃত বন্ধনে নানা রকম প্রসার ও প্রকাশ, এসব কিছুই করবে না তোমরা। কারণ তোমাদের সৌন্দর্য, তোমাদের আবেদন, তোমাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি শেষ পর্যন্ত তোমাদের বুদ্ধিমত্তার এবং সৃজনের প্রবাহে। মনে রেখো, আর কিছুতে নয়। এই পথেই একদিন আসবে তোমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা। তোমাদের সামাজিক প্রবাহ ও প্রভাব এবং বৈভব। তোমাদের পৃথিবীব্যাপী জাগৃতি।

……………………………

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল

……………………………

সিমোন চুপ করে তাকিয়ে থাকেন সন্ধ্যার ছায়ায় তাঁর লেখার টেবিলের বুকে ফুটে ওঠা তাঁর মন থেকে উঠে আসা বাক্যটির পানে:
No one is more arrogant towards women, more aggressive or scornful than the man who is anxious about his virility. যে পুরুষ তার নিজের পৌরুষ নিয়ে সন্দিহান, সেই পুরুষই নারীকে সর্বগ্রাসী অহংকার ও ঘৃণার চোখে দেখে। নারী, তাকে চিনতে তোমাকে হবেই, যুগে যুগে।

…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব  ……………………

পর্ব ৩৭: ভক্তদের স্তাবকতাই পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র-কীর্তি স্থায়ী হতে দেয়নি, মনে করতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী

পর্ব ৩৬: একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে মারিও ভার্গাস লোসা যেন ছবি বিশ্বাস!

পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি

পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল

পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা

পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই

পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না

পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা

পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ

পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?

পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!

পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল

পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো

পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়

পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!

পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে

পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে

পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি

পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল

পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল

পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল

পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে

পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে

পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা

পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল

পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে

পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?

পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব

পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি

পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল

পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি

পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে

পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল

পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা

পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা

পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে

পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল