কচ্ছপগিরির মাধ্যমে নিজেকে দুধে-ভাতে রাখার ও থাকার বুদ্ধিজীবী রাজনীতিই এখনকার বাঙালির নাগরিক সমাজের রাজনীতি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রক্তকরবী’ নাটকে রাজাকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘এই ব্যাঙ একদিন একটা পাথরের কোটরের মধ্যে ঢুকেছিল। তারই আড়ালে তিন হাজার বছর ছিল টিকে। এইভাবে কী করে টিকে থাকতে হয় তারই রহস্য ওর কাছ থেকে শিখছিলুম; কী করে বেঁচে থাকতে হয় তা ও জানে না। আজ আর ভালো লাগল না, পাথরের আড়াল ভেঙে ফেললুম, নিরন্তর টিকে-থাকার থেকে ওকে দিলুম মুক্তি।’ ব্যাঙের টিকে থাকাকে মেরে ফেলে বেঁচে থাকার দিকে এগিয়েছিল রাজা। নিজের স্থিতাবস্থাকে ভাঙতে পেরেছিল। তার নিজেরই ব্যবস্থাকে টান মেরে খানখান করে দেওয়ার কাজে নেমেছিল। বলেছিল নন্দিনীকে, ‘ভালো করিনি?’
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের স্টেট-স্পনসর্ড (State-sponsored) সেই ধর্মগুরুর কথা মনে আছে? ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষের ন্যায়-সংগত ক্রোধকে প্রশমিত করাই ছিল তাঁর কাজ। খোদাইকর শ্রমিকরা নীরবে সব বঞ্চনা যাতে সহ্য করে, সে জন্য কৌশলে তোল্লাই দেওয়াই উদ্দেশ্য। গোঁসাই বলে, ‘‘আহা, এরা তো স্বয়ং কূর্ম-অবতার। বোঝার নীচে নিজেকে চাপা দিয়েছে বলেই সংসারটা টিকে আছে। ভাবলে শরীর পুলকিত হয়। বাবা ৪৭ফ, একবার ঠাউরে দেখো, যে মুখে নাম কীর্তন করি সেই মুখে অন্ন জোগাও তোমরা; শরীর পবিত্র হল যে নামাবলিখানা গায়ে দিয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেখানা বানিয়েছ তোমরাই। এ কি কম কথা! আশীর্বাদ করি, সর্বদাই অবিচলিত থাকো, তা হলেই ঠাকুরের দয়াও তোমাদের ’পরে অবিচলিত থাকবে।” গোঁসাইয়ের কথায় ভুলে নীরবে যদি ওরা কাজ করে যায়, নিজেদের পাওনা-গণ্ডা দাবি যদি না-চায় তাহলেই শাসকের লাভ। এই লাভের জন্যই কথার ফেরে ভুলিয়ে রাখা। কূর্ম অবতারের মহীয়ান রূপ তাদের উপর আরোপ করা। এই রাজনৈতিক ধর্ম-কৌশলের বিরোধিতা রবীন্দ্র-নাটকে ছিল। বিশু বলেছিল, ‘গোঁসাইজি এদের কূর্ম-অবতার বললেন, কিন্তু শাস্ত্রমতে অবতারের বদল হয়। কূর্ম হঠাৎ বরাহ হয়ে ওঠে, বর্মের বদলে বেরিয়ে পড়ে দন্ত, ধৈর্যের বদলে গোঁ।’
কূর্ম, বরাহ হয়ে উঠলে রাষ্ট্রের বিপদ। বর্মের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা না-করে বরাহ দাঁতালের শক্তি নিয়ে আক্রমণে যায়। ছিন্ন-ভিন্ন করে দিতে চায় শক্তিশালী বঞ্চনাপ্রদায়ী ব্যবস্থার পেট। তবে অবতার বদল তো একদিনে হয় না, সহজে হয় না। তার জন্য প্রস্তুতি লাগে। সেই প্রস্তুতির অন্যতম শর্ত চেতনার জাগরণ। ‘চেতনার জাগরণ’ পুরনো শব্দ। নজরুলের ভাবানুবাদে বাংলা গানে দোলা লাগিয়েছিল সেই ডাক। ‘জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত!/ … আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র আচার/ মূল সর্বনাশের, এরে ভাঙিব এবার।’ স্বাধীনতার বছরে সত্য চৌধুরীর গলায় এ-গান যেভাবে বেজেছিল পরে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের পরিবেশনায় এই স্বদেশি গান বেজেছিল আরেকভাবে। ‘ভেদি দৈত্য-কারা আয় সর্বহারা;/ কেহ রহিবে না আর পর-পদ-আনত।।’ এক সময় এই আহ্বান বাঙালিদের জাগিয়ে তুলত, স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসত।
দিন বদলায়। সমূহের মধ্যে স্পন্দিত হওয়ার রাজনীতি কি এখন বাঙালিকে আর স্বপ্ন দেখায়। দাঁতাল-একগুঁয়ে বিদ্রোহের স্বপ্ন কি বাঙালি আর দেখে নাকি তারা ফিরেছে তাদের কূর্মবৃত্তিতে নতুনভাবে?
কূর্মবৃত্তি এই সমাসবদ্ধ পদটি বাঙালি জীবনে ফিরে ফিরে আসে। প্রাগাধুনিক পর্বে বহিরাগতদের আগমন ঘটলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ীরা নাকি কূর্মবৃত্তি অবলম্বন করতেন। সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে নিজেদের আচার ও অভ্যাস বজায় রাখার জন্য ঢুকে পড়তেন কঠিন আবরণের ভিতর। ইংরেজিতে যাকে ক্লোজড-কমিউনিটি (closed community) বলে এ-হল সেরকম। ধর্মীয় বা সামাজিক জনগোষ্ঠী অপর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনওরকম সংযোগ বা বিনিময়ের পথে যেতে নারাজ। যোগীরা যেমন কূর্মমুদ্রা গ্রহণ করে শ্বাসবায়ুর গমনাগমন নিবারণ করেন এ-ও তেমন। আত্মরক্ষার, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার বিশেষ উপায় হল কূর্মবৃত্তি গ্রহণ।
তবু কিন্তু তো একটা থেকেই যায়। কূর্মবৃত্তি গ্রহণ কি একরকম পলায়নপরতা নয়? প্রতিকূলতার মুখোমুখি না-হয়ে আত্মরক্ষার এই খোলসে ঢুকে পড়াকে কি বেঁচে থাকা বলে?
অর্থনৈতিক জীবনে বিভূতিভূষণের ক্যানভাসার কৃষ্ণলাল এই কূর্মবৃত্তিকে শেষ অবধি অস্বীকার করেছিল। বিভূতিভূষণের গল্পটি নিও লিবারেল অর্থনীতি লাঞ্ছিত এই সমাজে নতুন করে ভাবতে শেখায়। ক্যানভাসার কৃষ্ণলালের চাকরি গিয়েছিল। নৃত্যগোপালবাবু তাঁর চাকরি খেলেন– একালের ভাষায় ‘ফায়ার’ করলেন। বললেন, ‘আপনার কথার ওপর বিশ্বাস করা যায় না আর। বড়োই দুঃখের কথা। আপনি আমাদের পুরোনো ক্যানভাসার বলে আপনার অনেক দোষ সহ্য করেছি আমরা। কিন্তু এবার আর নয়। আপনি এ মাসের এই ক-দিনের মাইনে নিয়ে যাবেন অফিস খুললে– কমিশনের হিসেবটাও সেই সঙ্গে দেবেন। যান এখন।’
…………………………………….
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রক্তকরবী’ নাটকে রাজাকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘এই ব্যাঙ একদিন একটা পাথরের কোটরের মধ্যে ঢুকেছিল। তারই আড়ালে তিন হাজার বছর ছিল টিকে। এইভাবে কী করে টিকে থাকতে হয় তারই রহস্য ওর কাছ থেকে শিখছিলুম; কী করে বেঁচে থাকতে হয় তা ও জানে না। আজ আর ভালো লাগল না, পাথরের আড়াল ভেঙে ফেললুম, নিরন্তর টিকে-থাকার থেকে ওকে দিলুম মুক্তি।’
…………………………………….
কৃষ্ণলাল, নৃত্যগোপালবাবুকে এমনকী, তাঁর বুড়ো কর্তাকে ধরেও চাকরি রাখতে পারলেন না। ইন্ডিয়া ড্রাগ সিন্ডিকেটের মালিকের কথাই শেষ কথা। ক্যাশ ভাঙার অপরাধে বহু বছরের চাকরিটি খোয়াতে হল। চাকরি গেলে আরও অনেক কিছু যায়। মেসবাড়ির আশ্রয়, ধরা-বাঁধা মেয়েমানুষ সব কিছু হারিয়ে কলকাতার ক্যানভাসার কৃষ্ণলাল পৈতৃক গ্রাম ইলশেখালিতে আশ্রয় নিল। সেখানকার অলস কর্মহীন হাত-পা গোটানো কচ্ছপের জীবনযাপন। সে যেন ঠিক বেঁচে থাকা নয়। বিভূতিভূষণ কৃষ্ণলালের অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে ব্যবহার করেছিলেন ‘কূর্মবৃত্তি’ শব্দটি। লিখেছিলেন, ‘আর চলে না। এ অলস জীবন তাহার অসহ্য। কখনো পা গুটাইয়া কূর্মবৃত্তি অবলম্বন করিয়া এভাবে সে থাকে নাই। বেশিদিন এভাবে থাকিলে সে পাগল হইয়া যাইবে, নয়তো মরিয়া যাইবে।’ সুতরাং কূর্মবৃত্তির খোলস থেকে বাইরে আসতেই হল কৃষ্ণলালকে। পুনশ্চ কলকাতা। কিন্তু ক্যাশভাঙা কৃষ্ণলালকে চাকরি দেবে কে? শেষে নিজেই নিজের উপায় করতে হল। হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে কলকাতার পথে চাকরি-থেকে-বের করে দেওয়া কোম্পানির পাবলিসিটি অফিসারের মিথ্যে পরিচয় দিয়ে ওষুধের গুণাগুণ বিষয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করা। এবার হাতে হাতে ফল। ‘ডাল সিজনে’ কৃষ্ণলালের বক্তৃতার গুণে পাঁচ-ছয় দিনে দেড়শো ওষুধ বিক্রি। তাই শেষ অবধি পুনরায় চাকরি জুটল কোম্পানিতে। বসু মশাই বললেন, ‘আপনাকে আজ থেকে হেড ক্যানভাসার অ্যাপয়েন্ট করলাম। ষাট টাকা মাইনে পাবেন আর কমিশন, শুধু তদারক করে বেড়াবেন কে কেমন কাজ করছে, আর ছোকরাদের একটু তালিম দিয়ে দেবেন, বুঝলেন না?’ কূর্মবৃত্তি ত্যাগ করেই কৃষ্ণলালের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন জীবন লাভ। পুনরায় নবীন কুণ্ডু লেনে ধরা-মেয়েমানুষ গোলাপীর বাসায় প্রবেশ। এই তো জীবন– কচ্ছপ হলে চলে! অর্থনীতি চনমনে করে তোলার জন্য কচ্ছপের খোলা ভাঙতেই হয়।
তবু বাঙালি, একালের বাঙালি, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আরেক রকমভাবে কচ্ছপ হয়ে ওঠে। তাকে বলি কচ্ছপের রাজনীতি। খোলার ভেতরে ঢুকে পড়ে, নিজেকে বাঁচানো। খাব-দাব রোজগার করব। মাঝে মাঝে টিভিতে কিংবা সমাজমাধ্যমে উত্তেজনার প্রশমন করব। কিছুতেই কিন্তু পথে নেমে নিঃস্বার্থভাবে নৈতিকতার রাজনীতিতে যোগ দেব না। চুরি হবে, দুর্নীতি হবে, মানুষ মরবে কিন্তু পিঠে বেঁধেছি কচ্ছপের খোলা। এমন কিছু বলার দরকার নেই যা স্থিতাবস্থাকে বিঘ্নিত করবে। এই কচ্ছপগিরির মাধ্যমে নিজেকে দুধে-ভাতে রাখার ও থাকার বুদ্ধিজীবী রাজনীতিই এখনকার বাঙালির নাগরিক সমাজের রাজনীতি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রক্তকরবী’ নাটকে রাজাকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘এই ব্যাঙ একদিন একটা পাথরের কোটরের মধ্যে ঢুকেছিল। তারই আড়ালে তিন হাজার বছর ছিল টিকে। এইভাবে কী করে টিকে থাকতে হয় তারই রহস্য ওর কাছ থেকে শিখছিলুম; কী করে বেঁচে থাকতে হয় তা ও জানে না। আজ আর ভালো লাগল না, পাথরের আড়াল ভেঙে ফেললুম, নিরন্তর টিকে-থাকার থেকে ওকে দিলুম মুক্তি।’
ব্যাঙের টিকে থাকাকে মেরে ফেলে বেঁচে থাকার দিকে এগিয়েছিল রাজা। নিজের স্থিতাবস্থাকে ভাঙতে পেরেছিল। তার নিজেরই ব্যবস্থাকে টান মেরে খানখান করে দেওয়ার কাজে নেমেছিল। বলেছিল নন্দিনীকে, ‘ভালো করিনি?’ এই ভালো খবর কি এই দেশে এই রাজ্যে কখনও এসে লাগবে? না কি কূর্মাবতার হয়ে নাগরিক সমাজ ও নাগরিক সমাজের বুদ্ধিজীবী অবতারেরা টিকে থাকাকেই জীবনের ব্রত বলে বেছে নেবেন? উত্তর মেলে না। জয় কচ্ছপতন্ত্রের জয়! জয় টিকে থাকার জয়! আলো কি ক্রমে আসিতেছে? ‘এ নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ।’
চিরকাল নগ্নপদ ছিলেন। অনেকের অনুরোধ সত্ত্বেও কোনওদিন জুতো পরেননি। কারণ তিনি ‘জুতোস্থ’ না হয়ে ‘পদস্থ’ থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। মজা করে বলতেন– বাগদাদের রাজারা খালিফা আর তিনি হলেন ‘খালি পা’। ‘দাদাঠাকুর’ শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের জন্ম ও মৃত্যুদিন আজ। সেই উপলক্ষে রোববার.ইন-এর বিশেষ প্রতিবেদন।