তাঁকে দ্বিতীয়বার দেখা, আরেকটু বিশদে, এইবারের ভাবটি কিন্তু আরও তীব্রভাবে বিরোধাভাসে আকীর্ণ হল। ইনি জগতের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের একজন, আমার সেই কৈশোরোচিত ইম্প্রেশনটি দেখলাম আন্তর্জাতিক। কিন্তু ইনি পৃথিবীর সবচেয়ে অ্যাবিউজড মানুষ, যাঁর মৃত্যু হয়েছিল নির্মমভাবে, মৃত্যুতেও তিনি ধোঁয়াশা এবং ষড়যন্ত্রের পঙ্কিলে নিমজ্জিত ছিলেন– এ-ও জানলাম। এত সুন্দর মানুষ! তার সঙ্গে এইসব ঘটে কী করে? একে তো আহ্লাদে মুড়ে রাখার কথা! কিশোর মন জানল, এত সুন্দর বলেই এইসব ঘটে। এত সুন্দর বলেই অকালে মৃত্যু হয় কলঙ্কের রঙে রাঙানো। এই হল পুরুষচরিত্র, যা সুন্দর, তাকে ছিবড়ে করে দেওয়া, এবং অনেকে মিলে।
আটের দশকের শুরুর দিকে কোনও এক দুপুরে, স্কুল থেকে ফিরে খবরের কাগজ খুলে বসেছিলাম। সিনেমার পোকাটা সেই বয়সে মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে, এইবার আস্তে আস্তে সর্বস্বকে গ্রাস করবে। তখনই আমি জানি সিনেমার খোঁজ-খবর করতে গেলে একটি পত্রিকার বা সংবাদপত্রের কোন পাতাটা দেখতে হবে। হাতে ছিল ‘দ্য স্টেটসম্যান’। তখনও নিউ এম্পায়ার বা লাইটহাউজে পুরনো ছবি মুক্তি পেত; এবং তার নাতিদীর্ঘ রিভিউও বেরত। তৃতীয় পাতাতেই একটি ছবি, অবধারিতভাবে সাদা-কালো, একজন সোনালি চুলের শ্বেতাঙ্গ মহিলার। তাঁর ঘাড়ের কাছে একজন পুরুষ উঁকি মারছেন, ঠিক নায়োকোচিত নয় তাঁর চেহারা। আর এই মহিলার উর্ধাঙ্গের ক্ষীণ পোশাকটি প্রায় ফসকে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাঁর মুখে হাসি, একটা ‘এই যাঃ এ কী হল!’ ভাব।
কৈশোরের দ্বারপ্রান্তে এই সামান্য আমি, স্পষ্ট মনে আছে, সেই মহিলার সৌন্দর্যে একেবারে হিপনোটাইজড হয়ে গেছিলাম। কিন্তু তখনই মনের মধ্যে যেসব ভাবনার বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে গেছিল, তা তৈরি করেছিল স্পষ্ট পাপবোধ। এবং কিছুক্ষণ পরে আমি কাগজটি গুটিয়ে স্থিরপ্রত্যয়ে স্থিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম– আমি আর সিনেমা নিয়ে উৎসাহকে আশকারা দেব না, আমি আর মেরিলিন মনরোর ছবির সন্ধান করব না। ইহা ঠিক নেহি আছে।
…………………………………
মেরিলিনের মৃত্যুর প্রায় এক দশক পরে আমার জন্ম। এরপর যেন পরপর আমার হার্টথ্রবদের এইরকম পরিণতি হতে থাকবে আগামী দুই দশক ধরে। নাজিয়া হাসান, অকালে ঝরে যাবেন। এরকম সম্ভ্রম এবং মাদকতা যাঁর কণ্ঠে এবং অবয়বে, তিনি কেন বৈবাহিক অবহেলা এবং কর্কটের শিকার হবেন? মহুয়া রায়চৌধুরী, এরকম বীভৎস মৃত্যু কারও হয় কী করে? কেন সেই অকালমৃত্যুর পরও তাঁকে ছাড়ে না এরকম গুজব যে তিনি কত মাতাল ছিলেন এবং খুঁতে মানুষ ছিলেন? স্মিতা পাতিল, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কারও এভাবে মৃত্যু হয়? প্রিন্সেস ডায়না, তিনিও বিবাহে অবহেলিত এবং শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যাবে অ্যাক্সিডেন্টে?
………………………………….
আমার শৈশব কেটেছিল কলকাতা থেকে বহুদূরে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপে। প্রথম প্রত্যয়ে বেশিদিন স্থিত থাকতে পারিনি। কিন্তু দ্বিতীয় প্রত্যয়ে কিছুদিন সম্ভব হয়েছিল। এই মেরিলিন মনরো যে কে, তার সন্ধান করার কোনও উপায়ই ছিল না সেই সময়ে। না, আমার কোনও বন্ধু তার নাম শোনেনি। রিভিউটিতে ‘সেক্স সিম্বল’ একটি শব্দবন্ধ ছিল, তার অর্থ কী হতে পারে, সেটা নিয়ে জিজ্ঞেস করাতে এক একজন বন্ধু খুবই সৃজনশীল উত্তর দিয়েছিল– যেগুলো একটাও সঠিক নয়। বেশ কিছুদিন পরে সেই শব্দবন্ধটিই যেহেতু জিনাত আমনকে নিয়ে একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, কিঞ্চিত আন্দাজ পেলাম। কিন্তু কিছুদিন বাদে বিনোদ খান্নাকে নিয়েও একই শব্দ ফিরে আসায় কিছুদিনের জন্য আবার সবকিছু গেল গুলিয়ে! কিন্তু সেই উজ্জ্বল আলোকছটাময় ছবিটা মাথা থেকে যায়নি, যেমন যায়নি মনের মধ্যে তীব্র আকর্ষণ ও তীব্র পাপবোধের যুগপৎ উদ্রেকের স্মৃতি। আমার বাড়িতে গত দু’-তিন দশকের নানা রকমের ইংরেজি-বাংলা পত্রিকার আর্কাইভ ছিল। সেগুলো থেকে সিস্টেমেটিকালি সিনেমা-সংক্রান্ত পাতাগুলো খুঁজে বের করার স্কিল ততদিনে আমি অর্জন করেছিলাম।
এবং আবার আমি মেরিলিনের সম্মুখীন হয়েছিলাম। এইবার একাধিক ছবি, সঙ্গে একটি নাতিদীর্ঘ জীবনী। এই যে তাঁকে দ্বিতীয়বার দেখা, আরেকটু বিশদে, এইবারের ভাবটি কিন্তু আরও তীব্রভাবে বিরোধাভাসে আকীর্ণ হল। ইনি জগতের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের একজন, আমার সেই কৈশোরোচিত ইম্প্রেশনটি দেখলাম আন্তর্জাতিক। কিন্তু ইনি পৃথিবীর সবচেয়ে অ্যাবিউজড মানুষ, যার মৃত্যু হয়েছিল নির্মমভাবে, মৃত্যুতেও তিনি ধোঁয়াশা এবং ষড়যন্ত্রের পঙ্কিলে নিমজ্জিত ছিলেন– এ-ও জানলাম। এত সুন্দর মানুষ! তার সঙ্গে এইসব ঘটে কী করে? একে তো আহ্লাদে মুড়ে রাখার কথা! কিশোর মন জানল, এত সুন্দর বলেই এইসব ঘটে। এত সুন্দর বলেই অকালে মৃত্যু হয় কলঙ্কের রঙে রাঙানো। এই হল পুরুষচরিত্র, যা সুন্দর, তাকে ছিবড়ে করে দেওয়া, এবং অনেকে মিলে।
কিন্তু সৌন্দর্যের প্রতিকৃতির অবতলে থাকে অপচয়ের দলিল– এই কন্ট্রাডিকশনের তো সেই শুরু। যেন আমার কৈশোরোচিত মোহই অভিশপ্ত, এরকম বোধের সেই ছিল শুরু। মেরিলিনের মৃত্যুর প্রায় এক দশক পরে আমার জন্ম। এরপর যেন পরপর আমার হার্টথ্রবদের এইরকম পরিণতি হতে থাকবে আগামী দুই দশক ধরে। নাজিয়া হাসান, অকালে ঝরে যাবেন। এরকম সম্ভ্রম এবং মাদকতা যাঁর কণ্ঠে এবং অবয়বে, তিনি কেন বৈবাহিক অবহেলা এবং কর্কটের শিকার হবেন? মহুয়া রায়চৌধুরী, এরকম বীভৎস মৃত্যু কারও হয় কী করে? কেন সেই অকালমৃত্যুর পরও তাঁকে ছাড়ে না এরকম গুজব যে তিনি কত মাতাল ছিলেন এবং খুঁতে মানুষ ছিলেন? স্মিতা পাতিল, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কারও এভাবে মৃত্যু হয়? প্রিন্সেস ডায়না, তিনিও বিবাহে অবহেলিত এবং শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যাবে অ্যাক্সিডেন্টে? এবং সবার যে মৃত্যুতে শেষ হতে হবে এভাবে তা না হলেও, পারভিন বাবির শেষজীবন এইভাবে অতিবাহিত হবে কেন? কেন এতগুলো স্বপ্নের নায়িকা বেশ ধীরেসুস্থে হাসিমুখে বুড়িয়ে যাবেন না? আমার মতো একটি বিসমকামী পুরুষের হয়ে ওঠা মনকে এঁরাই জানিয়ে গেলেন যে আকর্ষণীয় নারীর প্রতিকৃতিটা কেমন, এবং সেই ছবির উল্টোদিকে থাকে কীরকম বিভীষিকা!
সত্যি বলতে কী, আমি এরপরও যখন মেরিলিনকে দেখেছি, স্থির ও চলমান চিত্রে, এই দু’রকম বিপ্রতীপ ভাবের নিষ্পত্তি ঘটিয়ে দেখতে পারিনি। তিনি একইসঙ্গে প্রাণপ্রাচুর্যের ছবি, আবার সেই ছবিই শবদেহের ছবি। শবদেহ তাঁর নয়, শবদেহ এই সভ্যতার স্বপ্নের ও সম্ভাবনার। যেন এই প্রতিকৃতিগুলি আলেয়া, যার তলায় পাঁকের চোরাবালি আছে। যেন তারা চিরকালই প্রেতাত্মা, অনেক না বলা কথার সমষ্টি, যা তাদের বলা হল না। তাঁকে যদি জিজ্ঞেস করা হত, প্ল্যানচেটে– মেরিলিন, আপনি কী বলতে চান? তাহলে আমাদের কৌতূহল থাকবে, তিনি হয়তো বলবেন যে, দুই কেনেডি ভাইয়ের সঙ্গে অ্যাফেয়ারের ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে তিনি ঠিক কী কী জেনে ফেলেছিলেন। তার বদলে তিনি হয়তো বলতেন– জীবনে এরকম ঘটতে থাকে কেন? থামে না কেন? আমি প্রকৃতির মতো লুণ্ঠনযোগ্য বলে কি হানাদার বারবার আসে?
ইন্টারনেট না এলে জানতামই না যে তিনি কবিতা লিখতেন। একসময়ে আমি রীতিমতো খুঁড়ে খুঁড়ে সেইসমস্ত কবিতা একত্র করেছিলাম। তখন ভাবতাম যাহা কিছু ডিজিটাল তাহাই অমর। না, সেইসবই নশ্বর। অনেক জিবি জিবি ফাইলের মধ্যে সেই ওয়ার্ডফাইলটিও হার্ড ডিস্ক ক্রাশ করার পর হারিয়ে গেছিল। যাহা কিছু মেরিলিন যেমন হয় আর কি।
যিনি এরকম নিখুঁত অবয়ব, আমাদের মনে হয় তাঁর কণ্ঠ থাকতে নেই। যদি কণ্ঠ থাকে এবং তাতে বেজে ওঠে গান, তাতে অভিব্যক্তি থাকতে নেই। আমাদের মতো পুরুষদের কাছে এঁরা তো কেবলই মিউজ, আমাদের লেখা কাব্য উদ্রেক করবেন, তাঁর নিজের কাব্যিক কীই-বা বলার থাকতে পারে? বনলতা সেনরা লেখেন না, তাঁরা লেখায় অমর হন, তাঁরা পুরুষের আখরে বন্দি থাকেন। সেইজন্যই পিয়ের পাওলো পাসোলিনি যখন মেরিলিনকে নিয়ে কবিতা লেখেন, সেই কবিতা আমাদের মতো হেটেরোসেক্সুয়ালদের মতো হয় না।
কিন্তু আমি পাসোলিনির কবিতা উদ্ধৃত করব না; সে আপনি খুঁজে নিন। মেরিলিন মনরো মানে কী, তার জন্য না হয় একবার পুরুষদের উদ্ধৃত নাই করলাম। এই লেখায় যদি কবিতা থাকে, তা থাকবে শুধুই মেরিলিনের। যেমন ধরুন ব্রুকলিন ব্রিজকে নিয়ে এই কবিতাটি। আশ্চর্যের কী, যে তা শুরু হচ্ছে আত্মহননের ভাবনা থেকে? শেষ হচ্ছে এক অপ্রত্যাশিত সৌন্দর্য দিয়ে–
Oh damn I wish that I were
dead— absolutely nonexistent—
gone away from here— from
everywhere but how would I
There is always bridges— the Brooklyn bridge—
But I love that bridge (everything is beautiful from there and the air is so clean) walking it seems
peaceful even with all those
cars going crazy underneath. So
it would have to be some other bridge
an ugly one and with no view— except
I like in particular all bridges— there’s some-
thing about them and besides I’ve
never seen an ugly bridge
তার চোখে সব ব্রিজই ছিল সুন্দর।
অথবা সময়ের প্রতি এই আকুতি–
O, Time
Be kind.
Help this weary being
To forget what is sad to remember.
Loose my loneliness,
Ease my mind,
While you eat my flesh.
তার পরের কবিতাটার আগে ও পরে কিছুই বলার থাকে না– মেরিলিনের উক্তি থেকে কতদূরেই বা থাকবে বিভীষিকা বা প্রেতভাব? এবং অপরিসীম স্নেহ আর মায়া?
Don’t cry my doll
Don’t cry
I hold you and rock you to sleep
Hush hush I’m pretending now
I’m not your mother who died.