আমিও আরকিউল পয়রো থেকে পালানোর পথ খুঁজে পেলাম না আজও। আগাথা ক্রিস্টির লেখা আরকিউল পয়রোকে নিয়ে অজস্র উপন্যাস ও ছোটগল্প। তুলনাহীন গোয়েন্দা কাহিনি। যখনই সময় পাই ফিরে যাই পয়রোর গল্পে। প্যারিস থেকে দু’ঘণ্টার ট্রেন জার্নি করে আরকিউল পয়রোর টানেই চলে এসেছি পয়রোর দেশ বেলজিয়ামের ছোট্ট গ্রাম ‘ব্রুগ্’-এ। এবং উঠেছি এক প্রাচীন ডিউকের প্রাসাদে। যে-প্রাসাদে ঢুকলেই মনে হবে, এই প্রাসাদে পয়রো অন্তত বার দুয়েক এসেছেন খুনের মামলার সমাধান করতে!
–এখন কী করেন? অনেক বছর পরে দেখা হল, তা-ই প্রশ্নটা না করে পারলাম না।
–প্রশ্নটা আপনি না করলে অবাক হতাম। একই কাজ করে চলেছি। সংগ্রহ। তবে সংগ্রহের চরিত্রটা একটু বদলেছে।
–কী সংগ্রহ করছেন এখন?
–মার্ডারার্স! দ্বিতীয় শ্রেণির খুনিরা ধরা পড়ে, জেলে যায়। কিন্তু প্রথম শ্রেণির খুনিরা সব সমাজের মাথায় বসে আছে। তারা ধন-দৌলত-ক্ষমতায় তুলনাহীন। কাল সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে একটা পার্টি আছে। আমার সেই পার্টিতে যারা আসবে, তারা সবাই প্রথম শ্রেণির খুনি। কেউ ধরা পড়েনি। চলে আসুন সেই পার্টিতে।
–বেশ, আপনার নেমন্তন্ন গ্রহণ করলাম। নিশ্চয়ই আসব। কিন্তু এই সংগ্রহের ঝুঁকি আপনি জানেন তো?
পরের দিন পার্টি শুরু হওয়ার ঘণ্টা খানেক পরে। যিনি পার্টি দিয়েছেন, তিনি ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে পড়ে আছেন। ঘরের মধ্যে বেশ কিছু পুরুষ-মহিলা ভিড় করে। এরা প্রত্যেকেই জীবনের কোনও না কোনও সময়ে, কাউকে-না-কাউকে, খুন করেছে। কিন্তু ধরা পড়েনি।
এদের মধ্যে একজন, যিনি গতকাল রাত্রে আমন্ত্রিত হয়েছেন, আধো-আধো ইংরেজিতে বললেন, আমার অনুমতি ছাড়া আপনারা কেউ ঘর থেকে বেরবেন না। যিনি ইজি চেয়ারে শুয়ে আছেন, তিনি খুন হয়েছেন। আপনাদের মধ্যে কেউ একজন ওঁকে খুন করেছেন। আমি আপনাদের চ্যালেঞ্জ নিলাম। পৃথিবীর সেরা গোয়েন্দার সামনে আপনাদের মধ্যে কেউ একজন ওকে খুন করার হিম্মত দেখিয়েছেন। মনে রাখবেন, বেলজিয়ান গোয়েন্দা আরকিউল পয়রো সেই খুনিকে ধরবেই। তার পালানোর পথ নেই।
আমিও আরকিউল পয়রো থেকে পালানোর পথ খুঁজে পেলাম না আজও। আগাথা ক্রিস্টির লেখা আরকিউল পয়রোকে নিয়ে অজস্র উপন্যাস ও ছোটগল্প। তুলনাহীন গোয়েন্দা কাহিনি। যখনই সময় পাই ফিরে যাই পয়রোর গল্পে। প্যারিস থেকে দু’ঘণ্টার ট্রেন জার্নি করে আরকিউল পয়রোর টানেই চলে এসেছি পয়রোর দেশ বেলজিয়ামের ছোট্ট গ্রাম ‘ব্রুগ্’-এ। এবং উঠেছি এক প্রাচীন ডিউকের প্রাসাদে। যে-প্রাসাদে ঢুকলেই মনে হবে, এই প্রাসাদে পয়রো অন্তত বার দুয়েক এসেছেন খুনের মামলার সমাধান করতে! সবথেকে মজার ব্যাপার হল, এই মুহূর্তে এই প্রাসাদে, যে-বাড়ি এখন ব্রুগে “ডিউক’স প্যালেস হোটেল” বলে খ্যাত, সেখানে আমি আর পয়রো ছাড়া কেউ নেই। প্রাসাদের বাগানে পয়রো আর আমি লাল ওয়াইন, হ্যাম-স্যান্ডুইচ আর এক আকাশ মেঘ আর হিম বাতাস নিয়ে বসেছি। সবাই জানি, পয়রো পছন্দ করেন ড্রাই লাল বেলজিয়ান ওয়াইন। সঙ্গে হ্যাম-চিজ স্যান্ডউইচ। তার সঙ্গে চারধারে বাগান, আকাশে মেঘ, আর হিম বাতাস থাকলে তো কথাই নেই। সাহিত্যের হিরোদের মধ্যে পয়রোকে আমার সব থেকে পছন্দ, সেকথা বলতেও আমার আপত্তি নেই। পয়রো বলতে আমি অজ্ঞান একটিই কারণে– পৃথিবীর সবথেকে আকর্ষণীয় এবং সবচেয়ে বিখ্যাত বেলজিয়ান তো তিনিই। যেই শুনলাম, বেলজিয়ামের গ্রাম্য শহর ব্রুগ্-এ গেলে পয়রোর সবক’টি প্রিয় জিনিস চোখের সামনে এবং স্বাদকুঁড়িতে পেয়ে যাব, টিকিট কিনে চড়ে বসলাম ট্রেনে। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে বেলজিয়ামের ব্রুগে। পেলাম পয়রোর প্রিয় আইসক্রিমের দোকান। একেবারে ঠিক কথা, এমন আইসক্রিম পৃথিবীতে কোথাও পাওয়া যায় না। আর এমন চিজ? লাল ওয়াইন চাইতেই প্ল্যাটারে এল চিজ! এই চিজ খেয়েই তো আরকিউল পয়রোর অমন ধারালো বুদ্ধি আর অভিজাত বোধ! আর পয়রোর পাইপ এবং তামাক! পাইপ এবং তামাকের স্বর্গও তো বেলজিয়াম!
আরকিউল পয়রোর কথা লিখব, অথচ গলদা চিংড়ির এবং অয়স্টারের কথা আসবে না, তা কি হতে পারে? সেই স্বর্গীয় চিংড়ির স্বাদও গ্রহণ করলাম আরকিউল পয়রোর ‘শহুরে গ্রাম’ ব্রুগে।
একথা বলতে আমি দু’বার ভাবব না, ব্রুগে এসে আমি আরকিউল পয়রো এবং আগাথা ক্রিস্টিকে নতুন করে পেলাম। আরকিউল পয়রো ফরাসি বলেন। কিন্তু তিনি ফরাসি নন, তিনি বেলজিয়ান। তফাতটা কোথায়, প্যারিস থেকে বেলজিয়াম এসে বুঝতে পারলাম। পার্থক্যটা সূক্ষ্ম। কিন্তু বিশেষভাবে চিহ্নিত হওয়ার দাবি রাখে। আরকিউল পয়রো সর্বক্ষণ চেষ্টা করেন পারফেকশনে পৌঁছতে। তাঁর সমস্ত কাজ যেন নিখুঁত হয়। বেলজিয়ামে এসে প্রথম বুঝতে পারলাম, এই নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা কোন পর্যায়ে যেতে পারে। বেলজিয়াম পারফেকশনের চর্চা বাতিকে পরিণত হয়েছে। এবং আরকিউল পয়রোকে বুঝতে বেলজিয়ামে আসতেই হবে। বেলজিয়ামের পারফেক্ট প্রোডাক্ট আরকিউল পয়রো!
ব্রুগের সোনার দিন ছিল ১৪২০ থেকে ১৪৯০। জমজমাট বাণিজ্য। দেশ-বিদেশের ধনীরা সব এসে বাসা বাঁধছে ব্রুগে। পশম এল ইংল্যান্ড থেকে। সুরা এল ফ্রান্স থেকে। মশলা এল স্পেন থেকে। ব্রুগ্ হয়ে উঠল বিশাল বারগেন্ডিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ। এবং বারগেন্ডিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানীও হয়ে উঠল ছোট্ট ব্রুগ্। মেরি অফ বারগেন্ডিয়ান সেই সময়ের এক পরমা সুন্দরী, যিনি বহু পুরুষকে জ্বালিয়েছেন। যে হোটেলে আমি উঠেছি, সেই হোটেল ২৫০ বছর আগে ছিল ব্রুগের এক দুরন্ত দুর্গ। ১৮৮৮-তে এই দুর্গের রমরমা। কত অত্যাচার, কত খুন যে হয়েছে এই হোটেলে। তারপর একদিন সেই দুর্গ রূপান্তরিত হল আজকের রোম্যান্টিক হোটেল, “দ্য ডিউক’স প্যালেস”-এ।
কোনও না কোনও সময়ে এমন এক দুর্গে, কিংবা দুর্গ থেকে রূপান্তরিত হোটেলে থেকেছেন আগাথা ক্রিস্টি। সেই দুর্গে রক্তপাত, খুনের গল্পও শুনেছেন তিনি। সেই সঙ্গে শুনেছেন সেই দুর্গের আভিজাত্য ও অভিমানের গল্প। তা না জানলে, শুনলে, হৃদয়ে ধারণ না করলে, তিনি তৈরি করতে পারতেন না বেলজিয়ান গোয়েন্দা, বিশেষভাবে বারগেন্ডিয়ান, আরকিউল পয়রোকে। বাঙালিকে না জানলে যে ব্যোমকেশ সত্যান্বেষীকে ভাবা যায় না, তেমনি বেলজিয়ান চরিত্রকে নিখুঁতভাবে না চিনলে অসম্ভব পৃথিবীর অন্যতম বেলজিয়ান ডিটেকটিভ পয়রোকে ভাবা।
আগাথা ক্রিস্টি তাঁর আরকিউল পয়রোকে তাঁর ব্যবহারিক লাবণ্যে, তাঁর প্রাত্যহিক ভদ্রতায়, তাঁর মাথার টুপি থেকে পায়ের জুতোয়, তাঁর খাওয়াদাওয়ায়, এমনকী, তাঁর টেবিলে স্যান্ডউইচ সাজানোর ভঙ্গিতে, তাঁর ওয়াইন গ্লাস ধরার স্টাইলে, বুনে দিলেন এমন এক অবিকল্প আভিজাত্য, তা আজও বেঁচে আছে। বেলজিয়ামের অতি প্রাচীন শহর ব্রুগ্-এ না এলে কিছুতেই বোঝা যাবে না কোথায় এবং কেন আরকিউল পয়রো ফরাসি নন, তিনি বেলজিয়ান!
১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির মধ্যে ঘোড়ার গাড়িতে করে সক্কালবেলা বেরিয়ে পড়লাম আরকিউল পয়রোর সময় ও শহর আবিষ্কার করতে। এমন ঘোড়ার গাড়িতেই চড়তেন পয়রো। তাঁর ঘোড়ার গাড়ির চালকেরও কি নাম ছিল গ্রেগরি? আমার গ্রেগরি হলিউডের নায়ক হওয়ার মতো সুদর্শন। সে ঘুরিয়ে দেখাল সমস্ত ব্রুগ্। যার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে আরকিউল পয়রোর সমস্ত অচেনা কৈশোর, অজানা যৌবন।
আমি, আমার হুইলচেয়ার সমেত, উঠে পড়লাম গ্রেগ্রির ঘোড়ার গাড়িতে। গ্রেগ্রি বলল, সে সারাদিনের জন্য আমার। যেখানে প্রয়োজন আমার হুইলচেয়ারও সে ঠেলবে!
বেশ লাগল আমার গ্রেগ্রির এই সুভদ্র বাণিজ্যবাক্য। আমি তো সত্যিই বেলজিয়ামের বিশ্ববিখ্যাত আরকিউল নই। আমি বেলতলার সামান্য ‘হারকিউল’। জিততে পারিনি কোনওকালে। হেরেছি শুধুই!
(চলবে)
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved