
অনিলদার সঙ্গে চেনাশোনার শুরু তালতোড়ে, ওঁর শুটিংয়ে, আমাদের আউটডোর স্কেচ ছিল সেখানেই। তারপর কলকাতায় ওঁর ১৪/১০ গলফ ক্লাব রোডের বাড়িতে একাধিক বার গিয়েছি। আর উনি শান্তিনিকেতনে এলে কলাভবনে এসে নিজেই খুঁজে নিতেন আমাদের। শুধু তাই নয়, লিখেছেন একগুচ্ছ চিঠি। সেই চিঠিতে মাঝে মাঝে আঁকা থাকত অপূর্ব স্কেচ, তার মধ্যে পাহাড়ই বেশি। তবে হারিয়ে যাওয়া সেই শেষ চিঠি– যা সেদিন হঠাৎ খুঁজে পেলাম– সেখানে আঁকা ছবি ছিল না। ছিল বাংলা ছবির সংকট নিয়ে একরাশ উদ্বেগ– যা আরও বুঝি প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষের আবহে এক বিশিষ্ট অভিনেতার কথা বারবার মনে পড়ছে। তাঁর নাম অনিল চট্টোপাধ্যায়। ঋত্বিকের প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ থেকে একাধিক চলচ্চিত্রে যিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। ‘নাগরিক’ যেমন সেই আশ্চর্য পরিচালকের প্রথম ছবি, তেমনই সেই ছবিতেই অনিল চ্যাটার্জির অভিনয় জীবনের শুরুয়াত। তারপর ‘অযান্ত্রিক’-এ ছোট হলেও এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, আর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘কোমল গান্ধার’-এর মতো ছবি অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়কে নতুন করে চিনিয়েছে।

রীতিমতো সুদর্শন তিনি। তবু নায়কোচিত গ্ল্যামারের মোহময় আলোক সরিয়ে চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠার দিকে ছিল তাঁর বিশেষ পক্ষপাত। বাস্তবিকই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম সম্পদ। মনে হতে পারে, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্মরণ করার কারণ কী, তাঁর জন্মশতবর্ষ আসতে বোধ করি আরও বছর তিন-চার বাকি আছে! সে কথা ঠিক, তবে ক’দিন ধরে একটা ছোট ঘটনা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বহু দিন আগে, আমার ছাত্রজীবনে একগোছা চিঠি লিখেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। সেই চিঠিপত্র ছাপা হলেও, তাঁর লেখা শেষ চিঠিটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। অধিক যত্নে কোথায় রেখেছিলাম, তার হদিশ ছিল না। হঠাৎ সেদিন পুরনো বইয়ের ভাঁজে তাকে আবিষ্কার করা গিয়েছে। আমার কাছে সে বড় আনন্দের মুহূর্ত! শুধু ফিরে পাওয়া নয়, চিঠিখানা ফিরে পেয়েছি ঋত্বিক শতবর্ষের আবহে।

ভাবলে অবাক লাগে, আমার মতো সাধারণ মফস্সলের এক ছেলের কাছে রুপোলি পর্দার অভিনেতা তো রূপকথার রাজপুত্তুরের শামিল। সেই ছোটবেলায় ওঁর ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’ দেখে কেমন মুগ্ধ গয়ে গিয়েছিলাম, তখন চিনতাম না। বড়দের মুখে শুনেছিলাম ‘ইনি অনিল চট্টোপাধ্যায়, খুব বড় অভিনেতা’ ইত্যাদি। তার বেশ কিছু পরে এক আশ্চর্য ঘটনার মধ্য দিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ হল।

আমি তখন শান্তিনিকেতনে পড়ি, ছবি আঁকা শিখতে ভর্তি হয়েছি কলাভবনে। আমাদের পরের ব্যাচে এসেছে শ্যামলা রোগাটে গড়নের হাসিখুশি এক মেয়ে। তার নাম শুচিস্মিতা, ডাক নাম বুলবুলি। তবে সেই ডাকনামেই তার খ্যাতি। শুনলাম সে ঋত্বিক ঘটকের মেয়ে। শুনে চমকিত হয়েছিলাম, তা বলাই বাহুল্য। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের সুতো খানিকটা সেই বেঁধে দিয়েছিল। আর তা দীর্ঘায়িত হয়েছিল অনিলদার নিজের সহজাত গুণে। তবে আলাদা করে বলতে হবে, চিত্রকলার প্রতি অভিনেতার বিশেষ টান তাঁর সঙ্গে আলাপের ভিতটাকে পাকা করে তুলেছে। সজীব সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর ছবিভাবনার মধ্যে দিয়ে, ছবি ভালোবাসার আর তা দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি নিজে অসম্ভব ভালো ছবি আঁকতেন, সেইটিই ছিল আমাদের অসমবয়সি বন্ধুত্বের সত্যিকার চাবিকাঠি। সাধারণ কলমের ঘনবুনোট দিয়ে আঁকা ছবিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বিশেষ করে ল্যান্ডস্কেপ, আর পাহাড়ি নিসর্গে তিনি অনন্য। এখানে সেই আলাপের গল্পটা বলি।

সেদিন সকালে কলাভবনে আমাদের শিক্ষক সুহাস রায়কে ধরে বসলাম, আজ আমরা আউট-ডোর স্কেচ করতে যাব। তখন আমাদের সুহাসদার ক্লাস চলছে। তিনি খুব ভালোমানুষ, আমাদের আবদারে সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। ফলে আমরা কয়েকজন মিলে স্টুডিয়োয় ক্লাসের বদলে হই হই করে চললাম গোয়ালপাড়ার পথে, সেখান থেকে তালতোড়ের দিকে। সেদিন আউট-ডোরে যাওয়ার আড়ালে আরেকটা গল্প ছিল। আমাদের ক্লাসের কোয়েলার বাড়ি বোলপুরে টুরিস্ট লজের আশপাশে। সে খবর এনেছে, আজ নাকি তালতোড় অঞ্চলে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের শুটিং আছে। সেখানে যাওয়ার জন্য সেই নাচিয়েছে আমাদের। ফলে সকালবেলায় আমাদের এমন অ্যাডভেঞ্চার। অবশেষে ধানের খেত, তালখেজুরের সারি, কাশবন আর পলাশ-শিমূলের পথ ধরে আমরা পৌঁছে সেখানে গেলাম। শুটিং চলছে তালতোড় গ্রামের একটা স্কুলের কাছে। বারান্দার শেডের তলায় মোড়ায় বসে আছেন অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়। দেখে কেমন অনেক দিনের চেনা মানুষ বলে মনে হল। মুখমণ্ডলে কী এক হাসিমাখা স্নেহময় ভাব। আমরা ক’জন গুটিগুটি এগিয়ে অটোগ্রাফ চাইতে গেলাম। কলাভবনের ছাত্রছাত্রী শুনে মজা করে বললেন, ‘বেশ আগে তোমাদের স্কেচখাতা দেখি, তারপরে অটোগ্রাফ দেব।’ সবার শেষে আমি স্কেচখাতা এগিয়ে দিলাম। মনে হল, উনি খুব খুশি হয়েছেন। নাম জিজ্ঞেস করে বললেন, ‘বিকেলে টুরিস্ট লজে এসো, দোতলার একেবারে পূবদিকের কোণার ঘরটায় আমি থাকি’। তখন সবাই পেলেও আমার কপালে তাঁর অটোগ্রাফ জুটল না, বোধহয় শট দিতে উঠলেন। তবে যাওয়ার আগে অর্থপূর্ণ হেসে একটা শর্ত দিয়ে গেলেন– ‘বিকেলে যদি টুরিস্ট লজে আসতে পারো তবেই অটোগ্রাফ দেবো’। একটু মনমরা হয়েই হস্টেলে ফিরে এলাম। বিকেলে যাব, সে ঠিক। কিন্তু ওঁকে কী দেওয়া যায় ভাবতে গিয়ে দুপুরবেলা বসে মোটা ব্রাউন পেপার কেটে কার্ড তৈরি হল। তার ওপরে তুলির দ্রুত আঁচড়ে এঁকে নিলাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এক সাঁওতাল ছেলে। নন্দলালের ‘টাচ-ওয়ার্ক’ ধরনে শুকনো তুলির টানে গড়ে উঠল সেই ছবি। মেটে-হলুদ, গাঢ় বাদামি আর সাদার ছোঁয়া দিয়ে তা শেষ হল। কেবল ছেলেটির কোমরের কাছে যেখানে গামছা বেঁধে দিয়েছি, সেখানে সামান্য সিঁদুরে-লালের স্পর্শ। ব্যাস, ছবি শেষ, দেখতেও নেহাত মন্দ হল না। এবারে অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের জন্য আমার উপহার একেবারে তৈরি।

কিন্তু সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। কখন টুরিস্ট লজের দোতলার সেই কোণের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াব, তাই ভাবছি! অবশেষে সেই মুহূর্ত, দোতলায় তাঁর ঘরের দরজা আলগোছে ভেজানো। একটু টোকা দিতেই সাদর আহ্বান এল। ভিতরে ঢুকে দেখি, কলাভবনের আরও অনেকে, তার মধ্যে বুলবুলি অন্যতম। অনিলদা ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন, তার সঙ্গে বাকিরা এসেছে। আমার অপ্রস্তুত ভাব তিনি দ্রুত কাটিয়ে দিলেন। মাঝারি মাপের ঘরে সকলেই প্রায় খাটের ওপরে বসেছে। আমারও ঠাঁই হল ওখানেই। থতমত খেয়ে খাটের একধারে গিয়ে বসেছি, খেয়াল করিনি সেখানে ধোপার কাছ থেকে আসা ওঁর পাজামা-পাঞ্জাবি রাখা। তা লক্ষ করে কপট রাগ দেখিয়ে উনি বলে উঠলেন, ‘সুশোভন, ওই জামাকাপড় আমাকে কাল পরে বেরতে হবে। সদ্য ধোপা দিয়ে গিয়েছে, আর বোধহয় ইস্তিরি করে দেওয়ার দরকার নেই।’ আমি তো বন্ধুদের সামনে লজ্জায় কাঠ, আর এই ফাঁকে সবাই মিলে খানিক রসিকতা করে নিল। অনিলদাও দেখি পুরো ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছেন। ব্যাপারটা আর বাড়তে না-দিয়ে দুপুরবেলায় আঁকা ছবিটা ওঁর হাতে দিয়ে বললাম, ‘এই আপনার উপহার, দুপুরবেলা এঁকেছি’। আমার ওই সামান্য উপহারে উনি কী অসম্ভব খুশি হয়ে উঠলেন, ছবির প্রশংসা যেন আর থামে না! আমার চোখ পড়ল খাটের পাশে আয়নার নিচে রাখা বাঁধানো এক ফোটোগ্রাফের দিকে। বোধ করি, ওঁর স্ত্রী আর কন্যার ছবি। আমার কার্ডের জায়গা হল তার পাশেই। এবার তো আমার খাতায় অটোগ্রাফ দেওয়ার পালা। কিন্তু বন্ধুদের সামনে সে আর নেওয়া হল না। ফেরার তাড়াও ছিল, সেকথা বলতে উনি বারান্দার কাছে একটু এগিয়ে দিতে এসে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আজ ভালো করে কথা হল না, পারলে কাল আবার এসো।’ অটোগ্রাফের লোভে পরদিন আমি আবার হানা দিয়েছি। সেদিন অবশ্য আর কেউ ছিল না, উনি পাতা জুড়ে কবিতার মতো লাইন ভেঙে ভেঙে আমার খাতায় লিখে দিলেন– ‘আমি চাই,/ আমার ছোট্ট ভাই/ সুশোভন আমাকে মনে রাখুক’, নিচে লিখলেন ‘তোমার দাদা অনিল চট্টোপাধ্যায়’।

অনিলদার সঙ্গে চেনাশোনার সেই শুরু। তারপর কলকাতায় ওঁর ১৪/১০ গলফ ক্লাব রোডের বাড়িতে একাধিক বার গিয়েছি। আর উনি শান্তিনিকেতনে এলে কলাভবনে এসে নিজেই খুঁজে নিতেন আমাদের। শুধু তাই নয়, লিখেছেন একগুচ্ছ চিঠি। সেই চিঠিতে মাঝে মাঝে আঁকা থাকত অপূর্ব স্কেচ, তার মধ্যে পাহাড়ই বেশি। তবে হারিয়ে যাওয়া সেই শেষ চিঠি– যা সেদিন হঠাৎ খুঁজে পেলাম– সেখানে আঁকা ছবি ছিল না। ছিল বাংলা ছবির সংকট নিয়ে একরাশ উদ্বেগ– যা আরও বুঝি প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওঁর প্যাডের কাগজে লেখা সেই অপ্রকাশিত চিঠিখানা রইল এখানে–

স্নেহের সুশোভন,
১০ই এপ্রিল ’৮৪
তোমার চিঠি পেয়ে শুধু আমি নয় শান্তু মামনি ছড়া পড়ে আনন্দে ভরপুর। ছড়া আমারও খুব ভালো লেগেছে। এবার একটা ছোট ছবি পাঠিও। তোমাদের চিত্র-প্রদর্শনী কিভাবে শেষ হল অর্থাৎ বিক্রি হল কিনা জানার জন্য এখনও উৎসুক আছি। জানিও।
আপাতত এই অসহ্য গরমের মধ্যে শান্তিনিকেতনে যাবার কোনো বাসনা নেই। গত বছর ওখানকার গরমে প্রায় মারা যাচ্ছিলাম! ‘হিটস্ট্রোক’ হয়েছিল। বর্ষার সময় একবার যাবার ইচ্ছা আছে কারণ একজন এই দরিদ্র ব্রাহ্মণকে সস্তায় কিছু জমি দিতে ইচ্ছুক। একটা ছোট্ট মাটির বাড়ি বানানোর ইচ্ছা আছে।
বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। খুব কম কাজ হচ্ছে। এরকম আর্থিক সংকটে কখনও পড়িনি। আমি তো যাত্রা থিয়েটার করি না সুতরাং আমার পক্ষে সমস্যা সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই। কেবল মাত্র বাঁচার তাগিদে এই বয়সে বম্বে কিম্বা মাদ্রাজ যেতে বাধ্য হলে খুবই খারাপ লাগবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত আছি।
তাড়াতাড়ি উত্তর দিও।
প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে
তোমার
অনিলদা
––––––––––
১. শান্তু মামনি– আমার চিঠিতে ছবি এবং সেই সঙ্গে কখনও মজার ছড়া লিখে দিতাম, সেসব নিতান্তই ছেলেমানুষি। শান্তু হল অনিল চট্টোপাধ্যায়য়ের একমাত্র কন্যা।
২. তোমাদের চিত্র-প্রদর্শনী– সেবারে একাডেমি অফ ফাইন আর্ট-এ আমাদের চিত্র-প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন।
৩. একটা মাটির বাড়ি– শেষ পর্যন্ত এই বাড়ি করা আর হয়ে ওঠেনি।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved