আমার এই লেখা, এই চাপানউতোরে ঘি ঢালতে নয়। লালদার নিবন্ধে বেশ কিছু জরুরি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে– আমি সেসবেই বিশেষ আগ্রহী। প্রথমত, লালদার অকপট স্বীকারোক্তিতে পরিষ্কার বোঝা যায় নাট্যচর্চায় মেয়েদের ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের অবস্থান ও সুরক্ষা নিয়ে নাট্যজগতে যথেষ্ট সচেতনতা নেই। যৌন নিগ্রহ বিষয়ে লালদার মতো সচেতন ব্যক্তি যখন মনে মনে ভেবে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে বিবৃতি দেন– তখন বোঝাই যায়– সুরক্ষা কী, কেন এবং কার জন্য– কাজ শুরু করতে হবে সেখান থেকেই। চর্চা ও চর্যা পাল্টাতে হবে।
সত্যি কথা বলতে কী, সুমন মুখোপাধ্যায়, তথা লালদা-র ‘আত্মপক্ষ সমর্থন নয়, খোলামেলা স্বীকারোক্তি’ পড়া শুরু করেছিলাম বেশ খানিকটা আশা নিয়ে। ২ মার্চ ‘টিনের তলোয়ার’-এর অভিনয় দেখে বন্ধুরা যখন ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলেন, তারপর থেকেই ‘বিচারাধীন’ ধর্ষককে মঞ্চে তোলার যুক্তিগ্রাহ্য সদুত্তর (অর্থাৎ সোনার পাথরবাটি) না হোক– কোনও একটা প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলাম। অবশেষে যখন সরাসরি আলোচনা বা উত্তর দেওয়ার সমস্ত উপায় অতিক্রম করে তিনি সংবাদমাধ্যমকেই বেছে নিলেন– ভাবলাম হয়তো খানিক ভরসার কথা পাব। পড়তে গিয়ে দেখি, তাঁর স্বীকারোক্তিতে বেশ কিছু প্রশ্ন আছে। সহজ প্রশ্ন, জানা উত্তর– অথচ তিনি তা জানতেন না দেখে আমি ভারি অবাক হলাম। লালদা চার দশকের থিয়েটার জীবনের উল্লেখ করলেন, অথচ এতখানি ব্যাপ্ত সময়ে এতকিছু অজানা কী করে রয়ে গেল তাঁর কাছে? তা কি তিনি পুরুষ বলে? নাটকের পরিবার থেকে উঠে এসেছেন বলে? দীর্ঘদিন খ্যাতির শীর্ষে থেকে থিয়েটারের একদম নীচুতলার (এই আমার মতো) নাট্যশ্রমিকদের খবর রাখার দরকার হয়নি বলে? না কি এসব কিছুই জানতে চাননি বলে?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সুমন মুখোপাধ্যায়ের লেখা: এই লেখা কোনও আত্মপক্ষ সমর্থন নয়, একটি খোলামেলা স্বীকারোক্তি
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এই নিবন্ধেই জানলাম– তিনি ‘নিগ্রহের কাণ্ডকে’ সমর্থন করেন না। কিন্তু নিগ্রহকারীকে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দিতে তাঁর বাঁধছে না। হয়তো তাঁরা পুরনো বন্ধু বলে; কিংবা অভিযুক্ত অর্থাৎ সুদীপ্ত যোগ্য গায়ক বলেই হবে হয়তো! আচ্ছা, তার মানে কি যোগ্যতা এবং যৌননিগ্রহ মাফ হয়ে যাওয়ার সময়সীমা ব্যস্তানুপাতিক?’ যত বেশি যোগ্য, তত তাড়াতাড়ি মাফ! যাই হোক, আমিও ধরেই নিচ্ছি যে, নিজের শৈল্পিক উদারতায় লালদা সত্যি সত্যি ভেবে নিয়েছিলেন যে, অভিযোগকারীরা ক্ষমা করে দিয়েছে সুদীপ্তকে, সব চুকে বুকে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর কাউকে না হলেও অভিযুক্তকে ডেকে তো জিজ্ঞাসা করাই যেত– ‘তোমার কেসটার কী হল, ফল বেরিয়েছে না বেরয়নি; সব চুকে বুকে গেছে তো!’ তাঁকে যেসব তরুণ প্রজন্মের মানুষরা বারবার নাকি সুদীপ্তকে নিয়ে কাজ করার কথা বলছিলেন (তাঁরা কারা?) তাঁদেরও জিজ্ঞেস করা যেত না কি– তোমরা যে ওকে নিতে বলছ, ও তো ধর্ষণে অভিযুক্ত– তাহলে? জানার ইচ্ছে হলে লালদার মতো মেধাবী মানুষকে যে ভেবে নিতে হয় না, তা কি বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দামিনী বেণী বসুর লেখা: তোমার শেখানো পথেই প্রশ্ন করছি, প্রতিবাদ করছি, তোমার তো খুশি হওয়া উচিত লালদা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এখনও আমার বিস্ময় এমন একটা ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে তাঁর নির্বিকার উদাসীনতা দেখে। এমন একটা জঘন্য অপরাধ– তার ওপর শিক্ষক হয়ে ছাত্রীদের ভুল বুঝিয়ে নাট্যচর্চার অজুহাতে নিগ্রহ– এরকম অভিযুক্তকে তিনি অভিনেতা নির্বাচন করলেন ‘ধরে নেওয়ার’ ওপর ভিত্তি করে? আর তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি– ২ তারিখের অভিনয়ের পর জানতে পারলেন যে, ‘বেশ কিছু মানুষ এখনও সেই ঘটনায় যন্ত্রণাদগ্ধ এবং দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অবসাদে আক্রান্ত’! এই স্বীকারোক্তি যদি পৌরুষের জেদ নাও হয়, পৌরুষের অজ্ঞানতা তো বটেই! যৌন নিগ্রহের শিকার যাঁরা হয়েছেন, ও তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন; তাঁরা সহমত হবেন যে, এই ধরনের অত্যাচারের প্রভাব শরীরে ও মনোজগতে সুদূরপ্রসারী। নিগ্রহের পর থেকে শুরু হয় এক অন্য যাপন। প্রথমে নিজের শরীরটা নিজের কি না, তাই নিয়ে সন্দেহ হয়। তারপর ভুলে যেতে না পারা সেই অবাঞ্ছিত স্পর্শ, অপমান আর লাঞ্ছনার সঙ্গে সহাবস্থান করা শিখতে হয় সারাজীবন ধরে। এটা দায়িত্ব নিয়ে বলছি– কারণ এইটা আমাকেও যাপন করতে হয় প্রতিদিন। সুদীপ্ত-র প্যাটার্নেই আমার সঙ্গে একই ঘটনা ঘটিয়েছিল বাংলা নাটকের আরেক কর্ণধার। আমার সঙ্গে ঘটা সেই অপরাধের বয়স চোদ্দো পেরিয়ে পনেরো বছর হতে চলল– অপরাধীকে ক্ষমা করার ভাবনা অবধি আমি এখনও পৌঁছতে পারিনি। এই ঘটনার উল্লেখ এখানে অভিযোগের তির ঘোরাতে নয়, একেবারেই জনস্বার্থে, অর্থাৎ কিনা ‘উদাহরণস্বরূপ’। এইরকম হয় লালদা। তোমরা যারা কোনওভাবে এই অভিজ্ঞতার হাত থেকে (হয়তো) বেঁচে গেছ; কারণ সব ছেলেরাও যে বেঁচে যায় এমনটা তো না; তারা এই অভিজ্ঞতাগুলো জানতে চাও না। জানতে চাও না বলেই এত সহজে ‘ধরে নিতে’ পারো। যা কারও কারও জীবনকে বরাবরের মতো ওলটপালট করে দিয়েছে, সেটা তোমাদের কাছে এতটাই তুচ্ছ যে, তা সম্পর্কে ‘ধরে নিয়েই’ কাজ চালিয়ে যাও, সংবেদনশীলতার দাবিও করো!
২০১৯ থেকে ‘সমূহ’ নামের কুয়্যার ও নারীবাদী দলের সঙ্গে কাজ করার সূত্রে অজস্র এমন অভিজ্ঞতার কথা শুনে চলেছি। থিয়েটার স্পেসেই এইভাবে নিগৃহীত মানুষদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা। তাঁদের অধিকাংশই এখনও অভিযোগ করে ওঠার সাহস করে উঠতে পারছেন না কেবলমাত্র কেউ শুনবে না বলে। শুনলেও নাট্যজগতে একঘরে করে দেবে ভয়ে। মাত্র গত পাঁচ বছরেই এত এত হেনস্তার কথা জানতে পেরেছি– শুধু চুপ করে শুনেছি বলে। কথার শুরুতেই– ‘উনি জিনিয়াস, কিন্তু একটু আলুর দোষ আছে’ বলে থামিয়ে দিইনি বলে। তোমার চার দশকের ব্যাপ্ত থিয়েটার জীবনে এইসব না জানাগুলো কি সংগত, লালদা?
একজন ‘প্রতিবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করছি– ‘প্রথম দিনের দুটি অভিনয়ের পর যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়কে বিলু দত্ত নিবেদিত ও সুমন মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত মুখোমুখি নাট্যদলের প্রযোজনা টিনের তলোয়ার থেকে অপসারিত করা হয়েছে’। আশা করি, এবার আর অভিমানের অবকাশ নেই! আজকের আগে এভাবে উল্লেখ করার উপায় ছিল না, কারণ নাট্যদলের তরফে বিবৃতি এসেছে ৬ এপ্রিলে। অভিনয় তালিকায় সুদীপ্তর উপস্থিতি নিয়ে প্রতিবাদ উঠেছে ২ মার্চ রাতেই, তারপরে মাসাধিক কাল সময়ের মধ্যে আরও ৩টি অভিনয় হয়ে গেছে নাটকের। কিন্তু যার উপস্থিতি নিয়ে প্রতিবাদের ঝড়, তার অনুপস্থিতি ও অপসারণ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া বা বিবৃতি দেননি প্রযোজক, নিবেদক বা নির্দেশক। দামিনী বেণী বসুর নিবন্ধ একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম থেকে উধাও হওয়ার পর সর্বস্তরে প্রতিবাদের ঝড় না উঠলে এই ঘোষণা কি আদৌ হত? যদি প্রতিবাদী আর সারভাইভারদের নিয়ে তিনি/তাঁরা এতটাই সংবেদনশীল ছিলেন, তাহলে সারভাইভারদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে তৃতীয় অভিনয়ের আগেই সেই ঘোষণা হল না কেন? এই যে অভিযোগ করার পরে নীরবে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মতো সুদীপ্তর অনুপস্থিতি ও তা নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখেও কোনও মন্তব্য না করা– এটাকেই বলে ‘চুপিচুপি নিভৃতে’ সরিয়ে দেওয়া। তার উল্টোটা কীভাবে করতে হয়, তা যে লালদা ও তাঁর প্রযোজকেরা জানেন, ৬ এপ্রিলের বিবৃতিই তার প্রমাণ। অলমিতি…
ঔদ্ধত্যের প্রশ্ন উঠেছে এখান থেকেই। দিনের পর দিন দেখেছি প্রতিবাদীদের সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্যে সুমন মুখোপাধ্যায় বা ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের নিবেদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কেউ না কেউ। মাসাধিক কালের প্রতিরোধের ফসল যে অনুতাপ আজ সংবাদমাধ্যমে জ্বলজ্বল করছে, সে সময় তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি তাঁদের কারও মধ্যে। কোনও মন্তব্য ছিল না। আমরা বাংলা থিয়েটারের চা ঢেলে দেওয়া, বোতাম সেলাই করে দেওয়া, থালি গার্ল মেয়েরা। শুনতে না চাওয়া আর পাত্তা না পাওয়ার নীরবতা আমরা নাট্যচর্চার ‘ঐতিহ্যে’ পেয়েছি। তাঁদের এই উদাসীনতার মানে আমাদের অভিধানে তো ক্ষমতার ‘পুরুষোচিত ঔদ্ধত্যই’, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে আমাদের নাট্যচর্চায়! যদি অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েও থাকেন, তাঁদের ব্যবহারে তার প্রকাশ দেখতে পেলাম না তো! পেলাম তো সেই চির-চেনা নৈঃশব্দ্য আর উদাসীনতা! বেণীর কাজের গুণে তাঁর গুণমুগ্ধ দর্শক অনেক। তাঁর লেখা বহু দর্শককে বিষয়টি জানিয়েছে। তাঁর যুক্তি সকলকে সচেতন করেছে। নাট্য জগতের বাইরের দর্শকরাও কৌতূহলী হয়েছেন। এই নড়েচড়ে বসা সে জন্যই নয় কি? যতই ব্যঙ্গোক্তি উঠুক প্রতিরোধের বিচ্ছিন্নতাবাদ নিয়ে, নির্ঘোষ যথেষ্ট জোরালো বলেই না মাস খানেক পরে হলেও, বিবৃতি এল! জানা গেল, অনুতাপ আছে! নাটকের নিবেদকের সামাজিক মাধ্যমের ব্যঙ্গে অপমানিত বোধ করে যখন একের পর এক নাটকের মেয়েরা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন, তখন তো তা আমরা জানতেই পারিনি! উদ্ধত না হলে, এঁরা তখনই সেই ভুল বোঝাবুঝির নিরসন ঘটাননি কেন?
যাই হোক; আমার এই লেখা, এই চাপানউতোরে ঘি ঢালতে নয়। লালদার নিবন্ধে বেশ কিছু জরুরি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে– আমি সেসবেই বিশেষ আগ্রহী। প্রথমত, লালদার অকপট স্বীকারোক্তিতে পরিষ্কার বোঝা যায় নাট্যচর্চায় মেয়েদের ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের অবস্থান ও সুরক্ষা নিয়ে নাট্যজগতে যথেষ্ট সচেতনতা নেই। যৌন নিগ্রহ বিষয়ে লালদার মতো সচেতন ব্যক্তি যখন মনে মনে ভেবে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে বিবৃতি দেন– তখন বোঝাই যায়– সুরক্ষা কী, কেন এবং কার জন্য– কাজ শুরু করতে হবে সেখান থেকেই। চর্চা ও চর্যা পাল্টাতে হবে। লালদা উল্লেখ করেছেন এর আগেও সুদীপ্ত কাজ করেছে– প্রতিবাদ তাঁর চোখে পড়েনি। সত্য হল, প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু গুটিকতক মেয়ে ও তাঁদের বন্ধুদের ক্ষীণস্বরে উদ্যোক্তাদের কিছু যায় আসেনি– যেমন একজন মহিলা নির্দেশকের নির্দেশনায় ‘বাসভূমি’ নাট্যপাঠ বা ‘দৃষ্টিকন্যা’ নাটকে অভিনয়ের সময় দেখা গেছে। আবার সম্মিলিত প্রতিবাদের ফলে মধ্যমগ্রামের একটি নাট্যদল নিজেদের কর্মশালা থেকে সুদীপ্তকে অপসারিত করতে বাধ্য হয়।
সার কথা হল– প্রতিবাদ হলেও নাট্য পরিসরে যৌন হেনস্তার বিষয়টি ‘গৌণ’ সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে– কারণ বাংলা নাট্যচর্চা গুণগতভাবে পুরুষ-কেন্দ্রিক। এদিকে হেনস্তা হওয়া নিগৃহীতের অধিকাংশই মেয়েরা। তাই না জেনে, ধরে নিয়ে, গুরুত্ব না দিয়েই চর্চা চলছে। ফল হিসেবে সুদীপ্তকে কাজে ফেরাতে যতটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, ততটাই অবহেলা তার করা যৌন নিগ্রহের ন্যায়বিচার সম্পর্কে। #metoo আন্দোলনের সময় বলা হত, তোমরা সামাজিক মাধ্যমে না কপচে আইনের সাহায্য নাও– এখন আইন যাদের ধরেছে, তাদের বিচার শেষ হওয়ার আগেই তাদের পুনর্বাসনের দাবিও উঠে যাচ্ছে। এর ফলে প্রান্তিক লিঙ্গের ও কম ক্ষমতার নাট্যকর্মীদের জন্য এই কর্মস্থল আরও অসুরক্ষিত হয়ে পড়ছে। না লালদা, এর জন্য তুমি একা দায়ী বলে আমরা কেউ মনে করছি না, কিন্তু যারা এই ব্যবস্থাটার মধ্যে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছে পাল্টানোর চেষ্টা না করে, এই নিগ্রহ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়ে– তারা সকলেই দায়ী। ‘No one can be good for long, if goodness is not in demand’ – Bertolt Brecht.
লালদা নাম না করে সাম্প্রতিক POCSO কেসে অভিযুক্ত রাজা ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গও তুলেছেন। অত্যন্ত সঙ্গত প্রসঙ্গ। রাজা এক নাবালিকাকে দিনের পর দিন যৌন হেনস্তা করে বলে অভিযোগ। মেয়েটির অভিযোগ মেনে নিয়ে, মেয়েটিকে সামাজিক মাধ্যমে তা প্রকাশ না করার অনুরোধ করে রাজার বার্তা সামাজিক মাধ্যমে বহু মানুষই দেখেছেন। আইনের মারপ্যাঁচে সেও জামিনে মুক্ত। প্রতিবাদীদের ‘কুকুর’ বলেও উল্লেখ করেছে। রাজার এইভাবে বুক ফুলিয়ে নাটক করা নিয়েও প্রতিবাদ জারি আছে, থাকবেও। লালদা প্রশ্ন তুলেছেন– রাজাকে বলা হল না কেন? বুঝলাম তিনি সেই প্রতিবাদের কথাও জানেন না, আশা করছি এবার জানবেন। কিন্তু আমি তাঁর কাছ থেকে এই whataboutery সত্যিই আশা করিনি। বাংলার আপামর নাট্যকর্মী কাছে, নাট্যপ্রিয় দর্শকদের কাছে, ও বাংলা থিয়েটারের চুপ করে বসে থাকা এই সমস্ত গুণীজনের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন– নিগ্রহ সম্পর্কে সকলের এই উদাসীনতা আর অভিযুক্তদের এইসব দাম্ভিক আস্ফালন কি আপনাদের যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে মনে হয় না? মনে হয় না নাট্যচর্চার কর্মক্ষেত্রে এইসব বন্ধ করার জন্য কিছু প্রশাসনিক ও পদ্ধতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে?
আমার নিগ্রহের কথা আমি সেসময়ে প্রকাশ্যে আনতে পারিনি। কারণ তখন আমি সদ্য কৈশোর পার করেছি, নাটককে পেশা করতে চাই জেনে পরিবারে যথেষ্ট প্রতিকূলতা ছিল। আমি তো সেই অর্থে নাটকের বাড়ির মেয়ে নই, মফসসলের উদ্বাস্তু কলোনিতে আমার বেড়ে ওঠা। যখন বুঝলাম নিগৃহীত হয়েছি, সবার আগে ভয় হয়েছিল– এসব জানালে নাট্যজগৎ নিয়ে বাড়িতে খারাপ ধারণা হবে, প্রশ্ন উঠবে আমার পছন্দের পেশা নিয়ে, আমার প্রকাশের শিল্প নিয়ে। আমি নাট্যকর্মী হতে চেয়েছিলাম। সেটা ‘লোভ’ কি না জানি না, কিন্তু মঞ্চ ছেড়ে যাব না বলেই দীর্ঘদিন চুপ ছিলাম। কিন্তু কতজনই তো ছেড়ে যায় শুধুমাত্র যৌননিগ্রহ আর তাই নিয়ে হর্তাকর্তাদের উদাসীনতায় হতাশ হয়ে। আমার মতো দীর্ঘদিন মুখ বুজে সয়ে যায় অনেকে! কেউ কেউ তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় নাটক বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছেন বলে লালদা দুঃখ পেয়েছেন– আর রোজদিন কতজনকে নিজের পছন্দের শিল্পচর্চাই ছেড়ে দিতে হয় জীবনের মতো এইসব নিগ্রহের ও তার আফটার-ম্যাথের জ্বালায়! কেউ জানতেও পারে না! এত এত বুক-ভাঙা হতাশার ভার নিয়ে, গায়ে অবাঞ্ছিত ছোঁয়ার অপমান নিয়ে আমরা এত এত মেয়েরা, কুয়্যার মানুষেরা, অনেক ছেলেরাও থিয়েটার করে যাচ্ছি, অবস্থা পাল্টানোর চেষ্টা করছি– আর কেবলমাত্র কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে লালদা কলকাতায় আর থিয়েটারই করতে চাইছেন না? বলছেন তা স্বৈরতন্ত্র? লালদা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী বলেই ওঁর মর্যাদা কি আমাদের যৌননিগ্রহের অপমানের থেকে বেশি মূল্যবান?
বিনোদিনীর অজ্ঞাতে ‘বি থিয়েটার’-কে ‘স্টার থিয়েটার’ নামে রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার ইতিহাস বাংলার পাবলিক থিয়েটারের। কিন্তু দেড়শো বছর পরের এই সময়টা আমাদের। এই সময়ে দাঁড়িয়ে নারীবাদকে, সমানাধিকারের প্রশ্নকে যতই ‘সুবিধাবাদ’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন– নিগৃহীতরা কথা তো বলবেই। কতদিন আর চুপ করে থাকবে? অনেক অনেক প্রজন্ম ধরে যেসব বৈষম্যের কথা শোনা হয়নি বা চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেইসব কথা কখনও না কখনও তো শুনতে হবেই! রবীন্দ্রনাথ, উৎপল দত্ত, ব্রেখটের সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীলতা কিন্তু সেইসব আখ্যানগুলোর অন্তর্ভুক্তিতেও, সে যতই অনভ্যাসের হোক না কেন। ‘Because things are the way they are, things will not stay the way they are.’ – Bertolt Brecht
এই সম্মিলিত প্রতিরোধকে ‘নাটকের পরিবারের দাদা ও বোনের খুনসুটির’ রাংতা মুড়িয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাবে না। নাট্য পরিসরে সেফ স্পেসের দাবি, সুরক্ষার স্বার্থে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের দাবি নিয়ে এই আন্দোলন চলবেই। আর এই ‘সুবিধাবাদী’, ‘অবিবেচক’, ‘সমবেদনাহীন’ বা ‘শ্রদ্ধাহীন’ তকমা পাওয়া আমরা নাট্যচর্চার কর্মক্ষেত্রে পাওয়া নিগ্রহের ট্রমা মাথায় নিয়েই নাট্যজগৎকে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাব– কারণ নিষ্কলুষ নাট্যজগতের স্বপ্নটুকু ছাড়া আমাদের হারানোর মতো আর কিছুই নেই। এমনকী, পূর্বজদের থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার মতো যথেষ্ট সম্মানও নয়।আমাদের মনে হয়, বাংলা থিয়েটারে লিঙ্গ ও শ্রম বৈষম্য মুছিয়ে দিতে পারলে, তা যে ‘লোকশিক্ষে’ দেবে, তা এই অসময়ে আমাদের নিদারুণ প্রয়োজন। তার জন্য কিছু গতানুগতিকতাকে ভাঙতে হবে বইকি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ন্যায্য সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে, আমাদের চর্চা ও চর্যায় সচেতন পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টার এ কেবল মুখবন্ধ মাত্র।
এক মাসের বেশি সময় ধরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পর সারভাইভারদের কথা বিবেচনা করে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য এবং অভিযুক্তকে অপসারিত করার জন্য কাউকেই বিশেষ ‘কুর্নিশ’ করে ‘আপনিই পারেন’ বলতে পারছি না। এই ন্যূনতম সম্মান আর স্বীকৃতিটুকু অভিযোগকারী ও অভিযোগ করে উঠতে না পারা মেয়েগুলির প্রাপ্যই ছিল।
প্রচ্ছদের শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
এই লাল অবশ্য, দেশে দেশে, মুক্তির রং হিসেবে, ছড়িয়ে পড়লেও, তার রং, ফ্যাকাশে হতেও সময় লাগেনি। ঘন লাল, মাঝারি লাল, হালকা লাল, গোলাপি লাল, আগ্রাসী লাল, একসময় সাম্রাজ্যবাদী লালও হয়ে ওঠে, একনায়ক লাল, ফ্যাসিস্ট লাল– এমনভাবেই লাল তার এক ধরনের রাজনৈতিক চেহারা নিল, আমরা দর্শক বনে গেলাম।