
এই ‘ছায়ানট’ কেবলই একটি সংগীত প্রতিষ্ঠান নয়, শুধু বাংলাদেশের নয়, বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং আত্মপরিচয়ের চিহ্ন। যে আত্মপরিচয়কে বাংলাদেশের বাঙালিরা অনেক লড়াই করে, বহু অত্যাচার-খুন-ধর্ষণের বিনিময়ে আদায় করেছে। ছায়ানট তার প্রতীক। আজ যদি শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহ আঘাত পায়, আমি মনে করি, ঠিক তেমনই আঘাত পেয়েছে ছায়ানট। গানের একটি পবিত্র তীর্থকেই আঘাত করা হল। যে-তীর্থ অনেক প্রাণের বিনিময়ে আমাদের অর্জিত অহংকার।
রবীন্দ্রনাথের গান ‘কাব্যসংগীত’। রবীন্দ্রনাথের গান অন্য বাংলা কাব্যসংগীতের মতোই শুধুমাত্র ‘কলাবিদ্যা’ নয়। যেমন, লালন ফকিরের গান কেবলই ‘কলাবিদ্যা’ নয়, তার অন্য উদ্দেশ্য আছে। একই গোত্রে পড়বে ‘কীর্তন’। নিধুবাবুর টপ্পা গোছের কিছু গানের কথা বাদ দিলে, বাংলা গান কলাবিদ্যার থেকে সবসময়ই অধিকতর কিছু। সাধনচর্চা এবং জীবনদর্শনের সঙ্গে বাংলা গানের ইতিহাসের একটা দীর্ঘকালীন সম্পর্ক রয়েছে। সরস্বতীর বীণাকে লাঠিতে রূপান্তর করা কোনও কাজের কথা নয়– রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন একথা, অন্যরকম আবহে। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই মনে করতেন– গান মহৎ বদল আনতে পারে। ‘রক্তকরবী’তে যা আমরা বারবার দেখছি। দেখছি ‘মুক্তধারা’তেও। রাজার দেউড়িতে রাজার প্রহরীরা তোমায় মারবে ঠাকুর, বলা হচ্ছে ধনঞ্জয় বৈরাগীকে। তখন ধনঞ্জয় বৈরাগী ভয় পাচ্ছেন না মোটে, গাইছেন, ‘আরো, আরো, প্রভু,আরো,আরো।/ এমনি করেই মারো, মারো।’ এই গানে, এই ভাষ্যে আমরা ছায়া পাচ্ছি মহাত্মা গান্ধীর, ছায়া পাচ্ছি এক অহিংস প্রতিবাদের। ধনঞ্জয় বলছে, ‘আসল মানুষটি যে, তার লাগে না, সে যে আলোর শিখা। লাগে জন্তুটার, সে যে মাংস, মার খেয়ে কেঁই কেঁই করে মরে।’ অর্থাৎ ভেতরে যিনি, সে-অবধি মার এসে পৌঁছয় না। বাংলাদেশে ‘ছায়ানট’-এর শরীরে আঘাত করে মারটা কি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত পৌঁছল? রবীন্দ্রনাথের আত্মাতে পৌঁছল? কিন্তু এ-ও ঠিক যে, মারটা রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার একটা চেষ্টা করা হল। এবং চেষ্টাটাকে উপেক্ষা করার কোনও কারণ নেই।

সন্জীদা খাতুন জন্মেছিলেন ১৯৩৩ সালে। তিনি যে-শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছিলেন, সেই শান্তিনিকেতন আশ্রমের হিন্দু-মুসলমান সংহতির এক বৈপ্লবিক ইতিহাস আছে। সেসময় যখন হিন্দুদের মধ্যে উচ্চবর্ণ এবং নিম্নবর্ণর একাসনে বসে খাদ্যগ্রহণের ব্যাপারটি প্রায় অচল ছিল, তখন সৈয়দ মুজতবা আলীর দাদা এসে একবার পড়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। সমস্যা তৈরি হয়, তিনি তো ধর্মে মুসলমান– তিনি খাবেন কোথায়! এদিকে রবীন্দ্রনাথও তখন আশ্রমে অনুপস্থিত। বিধুশেখর শাস্ত্রী মুজতবা আলির দাদাকে সমস্ত রীতি ভেঙে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে তরিবত করে খাইয়েছিলেন। অনেকে আপত্তি করেছিলেন। পরে এই আপত্তির কথা জানতে পারেন রবীন্দ্রনাথ। সেই থেকে আশ্রমে হিন্দু-মুসলমান বিভেদটা ঘুচতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত একজন মানুষ হিসেবে যখন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার পর তিনি যে বাণী বাকি সকলের মধ্যে ছড়াতে চান, তা মনুষ্যত্বের বাণী, মানবধর্মের বাণী। তিনি হজরত মহম্মদ নিয়ে লিখছেন, তিনি খ্রিস্ট নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, কথা বলছেন সমানাধিকার নিয়ে। আশ্রম প্রতিষ্ঠার ঠিক চার বছর পর, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় গানকে হাতিয়ার করে খালি পায়ে রাস্তায় নামছেন তিনি, রাখিবন্ধনের অভিপ্রায়ে! এই গান কীরকম ‘হাতিয়ার’? ‘রক্তকরবী’ নাটকে যখন কিশোর বলে, ‘ওদের মারের মুখের উপর দিয়েই রোজ তোমাকে ফুল এনে দেব।’ এই গান সেই মারের মুখের ওপর দিয়ে গাওয়া গান। বিশুপাগল যে গান শোনায় এ নাটকে, সে তার নিজের গান। ‘আমি হেথায় থাকি কেবল শুধু গাইতে তোমার গান, দিও তোমার জগৎসভায় এইটুকু মোর স্থান’ কিংবা রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি’– তিনি একজন শিল্পী হিসেবে এক দায়বদ্ধতার কথা বলেন। ‘ভার’-এর কথা বলেন। এই ভারের তাগিদেই তিনি ‘নাইট হুড’ ছুড়ে দেন। এই ভারের তাগিদে তিনি ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গাইতে পথে নামেন। এই ভার-ই তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে আশ্রমিকদের দিয়ে যান।

সন্জীদা খাতুন ১৯৫৪-’৫৫ নাগাদ এই আশ্রমেই আসেন। এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে বলেছিলেন, সেই সময় বাংলাদেশে ইসলামিকরণের প্রক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল খানসেনাদের দ্বারা। এমনকী, টিপ পরাতেও ছিল নিষেধাজ্ঞা। সন্জীদা কিন্তু এর বিরোধিতা করেছিলেন। জোর করে, টিপ পরেই তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে যাচ্ছিলেন নানা জায়গায়। সাংঘাতিক বিরোধিতা এসেছিল তখন, সেই ছয়ের দশকে। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, টিপ ‘হিন্দুচিহ্ন’ নয়, বাংলার মাটির সংস্কৃতির চিহ্ন হিসেবে ধারণ করেছিলেন তিনি। ‘তোমায় সাজাব যতনে কুসুমে রতনে/ কেয়ূরে কঙ্কণে কুঙ্কুমে চন্দনে।’– রবীন্দ্রনাথের এই গান মনে রেখে গ্রহণ করা। ‘টিপের বদলে বাংলাদেশ এখন হিজাবে ছেয়ে যাচ্ছে’– বলেছিলেন একথাও। সন্জীদা বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া কেবলমাত্র কণ্ঠে কী গাইছি, সেটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়। যিনি গাইছেন সাজ-পোশাক, আচরণ, সামাজিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস মিলিয়ে গড়ে ওঠে নিজস্ব রবীন্দ্রগানের বোধ।

কীরকম সেই ‘রাজনৈতিক চিন্তা’? ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুনের স্বামী– সাংবাদিক হিসেবে যখন মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন করছেন, তখন সন্জীদা খাতুন আন্দোলনে যুক্ত করে নিয়েছেন নিজেকে। রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন। তৈরি হয়েছে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’। এই পরিষদ তৈরি হচ্ছে ‘মারের মুখের ওপর দিয়ে’। তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল নিরন্তর। তাঁকে গাইতে না-দেওয়াই যখন মৌলবাদের একমাত্র কূটচাল, তিনি তখন আকাশবাণীতে, কলকাতায় এসেও গাইছেন। শুধুই গাইছেন না, কলকাতায় এসে শিল্পীদের সংঘবদ্ধও করছেন। কলিম শরাফি থেকে দেবব্রত বিশ্বাস– কথা বলছেন সকলের সঙ্গেই। ওপারে তৈরি করলেন ‘ছায়ানট’।

মজার ব্যাপার, ‘ছায়ানট’– এই রাগটা রবীন্দ্রনাথ নিজের গানে যে খুব ব্যবহার করেছেন, তা নয়। আজ একটা রবীন্দ্র-নজরুল বিরোধ তৈরি করা হচ্ছে বাংলাদেশে, তারা কি জানেন যে, ‘ছায়ানট’ নজরুলের একটি চিরস্থায়ী কাব্যগ্রন্থ? ‘ছায়ানট’ শব্দের মধ্যে ‘নট’– অর্থাৎ, নাট্য রয়েছে। পারফর্মিং আর্ট। এবং তার ছায়া। এই ‘ছায়ানট’ কিন্তু তৈরি হয়েছে বটগাছের মতোই। তার অপূর্ব সুন্দর দালান।
এই ‘ছায়ানট’ কেবলই একটি সংগীত প্রতিষ্ঠান নয়, শুধু বাংলাদেশের নয়, বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং আত্মপরিচয়ের চিহ্ন। যে আত্মপরিচয়কে বাংলাদেশের বাঙালিরা অনেক লড়াই করে, বহু অত্যাচার-খুন-ধর্ষণের বিনিময়ে আদায় করেছে। ছায়ানট তার প্রতীক। আজ যদি শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহ আঘাত পায়, আমি মনে করি, ঠিক তেমনই আঘাত পেয়েছে ছায়ানট। গানের একটি পবিত্র তীর্থকেই আঘাত করা হল। যে-তীর্থ অনেক প্রাণের বিনিময়ে আমাদের অর্জিত অহংকার।

অশনি সংকেত কি আমরা পাচ্ছিলাম না? সন্জীদা খাতুনের মরদেহের সামনে যখন রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হচ্ছে তখন সোশাল মিডিয়ায় মৌলবাদীদের কুৎসিত, কদর্য মন্তব্যগুলি কি ভেসে আসছিল না? বর্তমানে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা প্রবাসী হয়ে রয়ে গিয়েছেন, তাঁর মাটিতে ফিরতে পারছেন না। তাঁর অবদানও তো কম নয়। সোশাল মিডিয়ায় ধেয়ে আসা মৌলবাদীদের মন্তব্যে ভবিষ্যতের কালো দিন আঁচ করা যাচ্ছিল।
সমস্যাটা কি শুধুই বাংলাদেশের? উত্তর: না। ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া এবং সারা পৃথিবীতে উগ্রবাদের যে উদ্যাপন এবং পুঁজির করমর্দন শুরু হয়েছে– এ ঘটনা তারই বহু কীর্তির একটি।

এই সমস্ত উগ্রতার বিরুদ্ধেই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথই তো শ্রীনিকেতন তৈরি করেন। রবীন্দ্রনাথই তো ভদ্রলোকের পোশাক– ধুতি-পাঞ্জাবি-কোট-প্যান্ট প্রায় সরিয়ে রেখে বাউল-ফকির-মুরশেদদের পোশাক– জোব্বা, আলখাল্লা পরা শুরু করেছিলেন। তা এক সাংঘাতিক বিপ্লব! পৌষমেলার মাঠে, পিছনে নাগরদোলা, রবীন্দ্রনাথের পর লুঙ্গি, টুপি আর কুর্তা– এমন ছবিও তো দেখতে পাওয়া যায়। তাহলে ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’– রবীন্দ্রনাথ সংশ্লেষের রসায়নটাই শুধু বলে ক্ষান্ত হননি। দেখিয়েছেন নিজের জীবনচর্যা দিয়েই। তাঁর বাউল-ফকির-মুরশেদদের পোশাক পরা, প্রান্তিকের গান লালন সাঁইয়ের গানকে গুরুত্ব দেওয়া– প্রান্তরের প্রাণে নিজে পৌঁছে যাওয়া, কেন্দ্র থেকে প্রান্তে পৌঁছে, সেখানে প্রান্তেবাসীর কথাটা বলে ওঠা, এ কাজ রবীন্দ্রনাথ করেছেন। যা অবিকল্পভাবে সমস্ত উগ্রবাদের ঘোরতরভাবে বিপক্ষে।

ছায়ানট-এর ওপর আক্রমণে, সবথেকে কেলেঙ্কারি হল ‘ছায়ানট’ এবং ‘হিন্দুয়ানি’কে সমার্থক করে দেওয়া। এই দেগে দেওয়ার রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘মার্কা দেওয়ার কল’– সোশাল মিডিয়া থেকে হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটি– সর্বত্রই চলছে। যতক্ষণ না আমরা এই মার্কা দেওয়ার কলকে ভেঙে ফেলে মনুষ্যত্বের শিক্ষাকে আমাদের সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক স্তরে নিয়ে না আসব, ততদিন পর্যন্ত এই বিপদ আমাদের গায়ে এসে পড়বে। গৃহযুদ্ধ, হানাহানি, জাতিগত ধ্বংসের ভয়ংকর ইশারা বারবার তাক করে থাকবে আমাদের শরীর, আমাদের গানকেও।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved