জানি না আজ থেকে, ইউরো-ইউফোরিয়ার একক সংজ্ঞার নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো হয়ে যাবে কি না? এটাও জানি না, শেষ পর্যন্ত সিআরের শপথ-রক্ষা হবে কি না? সমর্থকরা ধরে রেখেছেন, নিদেনপক্ষে ইউরো সেমিফাইনাল। সিআর স্বয়ং চাঁদমারি রেখেছেন আরও উঁচুতে। সে হোক বা না হোক। পারলেও তা কায়িক। না পারলেও। শুধু অবিনশ্বর হয়ে থেকে যাবে ফুটবলের প্রতি ‘ওল্ড ম্যান’-এর প্রেম, তার নিটোল ভালোবাসাখানি।
প্রতিটা দেশের এক জীবন্ত জ্যোতি থাকে। যে দেখার, সে দেখে। যে জানার, সে জানে। সুখ। দুঃখ। প্রেম। রাগ। বৈভব। দুর্দশা। মানবজীবনের সূক্ষ্ম ও চড়া, বিবিধ অনুভূতির অণু-পরমাণু দিয়ে সৃষ্টি হয় সে জ্যোতি। প্রথমে সে থাকে নিরাকার, উদভ্রান্তের মতো ঘুরপাক খায় উচ্ছৃঙ্খল হাওয়া-বাতাসে। যতক্ষণ না সে উপযুক্ত জ্যোতির্ময় পাচ্ছে। পেলে সুবিধে যে বড়। অনন্ত ছুটোছুটির আর দরকার পড়ে না। এক শরীরে, এক অবয়বে, তখন বুলিয়ে দেওয়া যায়, দেশ-জ্যোতির পরশ। তার গায়ে তখন নিশ্চিন্তে এঁকে দেওয়া যায় মানচিত্রের অলিগলি। হৃদয় থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া যায় দেশের অদৃশ্য ঝান্ডা। পৃথিবীর দরবারে সে-ই তখন সাক্ষাৎ দেশ-দূত!
জার্মানির হার্সেউইঙ্কলের দুই খুদে কি অপার বিস্ময়ে তা-ই দেখছিল? আল-নাসেরের পিঙ্গল জার্সি পরে? যাদের ছবি দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়েছে গত দু’দিন যাবৎ, সোশাল মিডিয়ার ‘জনপদে’? আচ্ছা, কী করছিল ওরা? ওরা দুই? ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ঘর্মাক্ত ফুটবল-প্র্যাকটিস করা শরীরে দেশের জ্যামিতি খুঁজছিল? উৎসুক চোখমুখ নিয়ে হাতড়াচ্ছিল হৃদয়ের সেই বারান্দা, যেখান থেকে ঝুলে আছে পর্তুগালের অদৃশ্য পতাকা?
ওরা দেশ-দূত দেখে থাকতে পারে। দেবদূতও দেখে থাকতে পারে। যা-ই দেখুক, অমন ব্যাকুল দু’খানি চোখ, ইহজীবনে কখনও দেখিনি। হয়তো দেখবেও না। নিকটতম তুলনা পাচ্ছি, ২০২২ বিশ্বকাপে এএফপি ফোটোগ্রাফারের তোলা এক ছবি। আর্জেন্টিনা তখনও বিশ্বকাপ জেতেনি। ফাইনাল বাকি।
রোসারিও-র এক টিনের বাড়ির অজ্ঞাতপরিচয় বাসিন্দার ছবি তুলেছিলেন এএফপি ফোটোগ্রাফার। দৈন্যের সৈন্যরা দীর্ঘদিন ‘মার্চপাস্ট’ করেছে যাঁর গালে। দ্রষ্টব্য ছিল, ভদ্রলোকের হাসি। সে হাসিতে বেদনা নেই, কষ্ট নেই, এক বরং আকাশ নির্মল আনন্দ আছে। যে আনন্দ বিভোর হয়ে শুনছে বিশ্বজয়ের আগমনী। লিখলাম না, দেশ-দূত। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লিওনেল মেসি– এঁরা প্রত্যেকে তাই। দেবদূত এবং দেশ-দূত। ছেলে থেকে বুড়ো, সাত থেকে সত্তর, যাঁদের অপলক দেখতে থাকে। দেখতেই থাকে!
…………………………………………………………………………………….
জার্মানির হার্সেউইঙ্কলের দুই খুদে কি অপার বিস্ময়ে তাই দেখছিল? আল-নাসেরের পিঙ্গল জার্সি পরে? যাদের ছবি দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়েছে গত দু’দিন যাবৎ, সোশাল মিডিয়ার ‘জনপদে’? আচ্ছা, কী করছিল ওরা? ওরা দুই? ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ঘর্মাক্ত ফুটবল-প্র্যাকটিস করা শরীরে দেশের জ্যামিতি খুঁজছিল? উৎসুক চোখমুখ নিয়ে হাতড়াচ্ছিল হৃদয়ের সেই বারান্দা, যেখান থেকে ঝুলে আছে পর্তুগালের অদৃশ্য পতাকা?
…………………………………………………………………………………….
তবে কখনও কখনও এঁদের নিয়ে বড় বিপদে পড়তে হয়। উপযুক্ত বিশেষণ পাওয়া যায় না। যোগ্য কোনও গান লেখা যায় না। এই যেমন, ভাবছি এখন, রোনাল্ডো নিয়ে নতুন লিখব কী? তাঁকে নিয়ে লেখার মতো নতুন কী আর জীবজগতে পড়ে আছে? যা আগে কেউ কখনও ভাবেনি, কেউ কখনও লেখেনি? ইউরোর রোনাল্ডো নিয়ে লিখতে বসার আগে পুঁথি-নথি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মনে হল, তাঁর ‘রিভার্স এজিং’ লেখার বিষয় হতে পারে। অপসারিত ফের্নান্দো স্যান্টোসের জায়গায় পর্তুগাল কোচ হওয়ার পর রবার্তো মার্টিনেজ উপলব্ধি করেছিলেন যা। দায়িত্ব নেওয়ার পর স্পেনীয় কোচ রিয়াধ গিয়েছিলেন ফুটবল-মহামানবের সঙ্গে কথা বলতে। তা, বৈঠক শেষে মার্টিনেজের মনে হয়েছিল, ফুটবল জীবনের প্রান্তিক স্টেশনে দাঁড়িয়ে ধুঁকতে থাকা কোনও চরিত্রের সঙ্গে এই মাত্র কথা বলে বেরোলেন না তিনি। বেরোলেন, ১৮ বছর বয়সি এক উদীয়মান ফুটবলারের সঙ্গে কথা বলে! যে কি না নিজের গনগনে দর্শন দিয়ে কোচকে বুঝিয়ে দিয়েছে, সুযোগ পেলে মাঠে যেকোনও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ে নিতে প্রস্তুত। পরে একখানা অসামান্য কথা বলেছিলেন মার্টিনেজ। বলেছিলেন, ‘বয়স হলে একজন ফুটবলারের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সর্বপ্রথম বিদ্রোহ করে। মগজ তখন মেনে নিতে বাধ্য হয়, আর নয়। থামতে হবে এবার। কিন্তু যা দেখলাম, রোনাল্ডোর ক্ষেত্রে উল্টো। যতক্ষণ না ওর মগজ কোনও বার্তা পাঠাচ্ছে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবসর নেবে না!’
ঝামেলা হল, ‘রিভার্স এজিং’-কেও লেখার পূর্ণাঙ্গ বিষয় করা যাবে না। এটা ঘটনা যে, মঙ্গলবার চেক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গে একটা রেকর্ড করে ফেলবেন সিআর। রেকর্ড ষষ্ঠ ইউরোয় অংশগ্রহণ করে ফেলবেন তিনি। এটাও নিশ্চিত, চলতি টুর্নামেন্টে তাঁর ১৩০ আন্তর্জাতিক গোলের সুউচ্চ মিনার ফুটবলার-প্রজাতির ধরাছোঁয়ার বাইরে আরও চলে যাবে। কিন্তু একই সঙ্গে যে ক্রিশ্চিয়ানো বলে রেখেছেন, সময় ফুরোচ্ছে তাঁর। খুব বেশি ফুটবল তাঁর মধ্যে বেঁচে নেই আর। ইউরো জয়ের দীপ্ত শপথ নেওয়ার ফাঁকে যা বলে রেখেছেন রোনাল্ডো। তা সে যতই গত মরশুমে আল-নাসেরের হয়ে পঞ্চাশখানা গোল করে ইউরোপের টগবগে এর্লিং হালান্ড-কিলিয়ান এমবাপেদের পিছনে ফেলে দিন না কেন। ক্রিশ্চিয়ানো অনুচ্চারে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি এখন ফুটবলের ‘ওল্ড ম্যান’। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রখ্যাত উপন্যাস-চরিত্রের মতো তিনিও এখন ফুটবল সমুদ্রে নেমে পড়েছেন, শেষ বড় মাছকে বড়শিতে গাঁথতে। নাম যার ইউরো! আর একটা বিশ্বকাপ হবে কি না, কেউ তো জানে না।
আর ক্রিশ্চিয়ানোর সে ঘোষণার পর যে কথা ও কাহিনি প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটে স্রোতস্বিনী নদীর মতো ধেয়ে আসছে, তার সঙ্গে ক্রীড়া বিশ্বের আর এক সাত নম্বরকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া পুরনো প্রেক্ষাপটের প্রভূত মিল পাওয়া যায়! মহেন্দ্র সিং ধোনি। গত বছর আইপিএলের সময় সমগ্র ভারত ধরে নিয়েছিল যে, এবারই শেষ। আর খেলবেন না ধোনি। তাই সেবার আসমুদ্রহিমাচলে যেখানেই খেলতে গিয়েছেন ধোনি, ক্রিকেট জনতা তাঁকে শিরা ফাটানো শব্দব্রহ্মে ‘গান স্যালুট’ দিয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানোর ক্ষেত্রে যেমন হচ্ছে এখন, একই অবিকল। তাঁর প্র্যাকটিস দর্শনের বিনা পয়সার টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে আটশো ইউরোয়! প্রতিদিন পর্তুগাল ট্রেনিংয়ে তাঁকে একবার ছুঁয়ে দেখতে পুলিশি ‘কর্ডন’ ভেঙে ঢুকে পড়ছে জনতা। ‘পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম’-এর শ্রান্ত বার্তাকে ন্যূনতম আমল না দিয়ে। কেউ সেলফি নিচ্ছে, কেউ বা আবার তাঁকে জড়িয়ে ধরছে পরম ভালোবাসায়। পৃথিবীর পবিত্রতম বস্তু যা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর লেখা: শতায়ু হও, হে দ্বিতীয় শ্রেণির কামরার দেবতা
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সবচেয়ে বড় কথা, এঁরা কিন্তু সবাই পর্তুগিজ নন। এঁরা ইউরোপের বিবিধ ভাষাভাষী বিভিন্ন দেশের ফুটবল জনতা। যাঁরা সব ভুলে, সমবেতভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এক জ্যান্ত ফুটবল বিগ্রহকে তাঁর বিদায়ী ‘মেঘমল্লার’ শোনাতে। যে সংগীত-রাগে মেঘ ভাঙবে, ভেঙে দুঃখের বৃষ্টি নামবে।
জানি না, আজ থেকে কী হবে। জানি না আজ থেকে, ইউরো-ইউফোরিয়ার একক সংজ্ঞার নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো হয়ে যাবে কি না? এটাও জানি না, শেষ পর্যন্ত সিআরের শপথ-রক্ষা হবে কি না? সমর্থকরা ধরে রেখেছেন, নিদেনপক্ষে ইউরো সেমিফাইনাল। সিআর স্বয়ং চাঁদমারি রেখেছেন আরও উঁচুতে। সে হোক বা না হোক। পারলেও তা কায়িক। না পারলেও। শুধু অবিনশ্বর হয়ে থেকে যাবে ফুটবলের প্রতি ‘ওল্ড ম্যান’-এর প্রেম, তার নিটোল ভালোবাসাখানি। না জেনেও বেশ জানি, সে ‘ওল্ড ম্যান’ তার প্রাণাধিক প্রিয় চর্মগোলককে একখানা কথা আজও বলে। এবং আমৃত্যু বলবে, অনবরত বলবে।
ফুটবল, আই উইল স্টে উইথ ইউ, আনটিল আয়্যাম ডেড!
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved