হাত বাড়িয়ে রাখা মানুষকে হাত দিতে প্রত্যাখ্যান করা ছেলেবেলার ভিলেনদের মতো, প্যালেস্তাইনের অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট জিব্রিল রাজৌব ঘোষণা করে দিলেন ইজরায়েলের সঙ্গে অলিম্পিক মঞ্চে কোনও অবস্থাতেই হ্যান্ডশেক করবেন না তিনি। তারপর একফালি ছোট্ট সংযোজন– ইজরায়েল আগে স্বীকার করুক আমাদের স্বাধীন-স্বতন্ত্র অস্তিত্ব– তারপর হাত মেলাব।
হাত বাড়াও। হাত ধরো। হাতের সঙ্গে হাতের যে অদৃশ্য কানেকশান আমরা জন্মলগ্ন থেকে বয়ে বেড়াচ্ছি, এমনকী ‘হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ না’– বলে শঙ্খ ঘোষ যে হাতে-হাত বিষয়টার একটা হায়ারার্কি দিয়ে দিয়েছেন কিংবা সুমন ‘বেঁচে থাক সব্বাই হাতে হাত রাখা থাক’– বলে সে উঁচু-নিচু, এবড়োখেবড়ো মানুষকে এক ছাঁটে সমান-মসৃণ করে দিচ্ছেন, সাম্যবাদের অ-আ-ক-খ শেখানো সেইসব তত্ত্ব সবকিছুই যেন আচমকা হাত থেকে পড়ে দুম করে ভাঙল; আর দোদুল্যমান এক বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে দুলতে থাকল সংশয়ের পেন্ডুলাম। হাত বাড়িয়ে রাখা মানুষকে হাত দিতে প্রত্যাখ্যান করা ছেলেবেলার ভিলেনদের মতো, প্যালেস্তাইনের অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট জিব্রিল রাজৌব ঘোষণা করে দিলেন ইজরায়েলের সঙ্গে অলিম্পিক মঞ্চে কোনও অবস্থাতেই হ্যান্ডশেক করবেন না তিনি। তারপর একফালি ছোট্ট সংযোজন– ইজরায়েল আগে স্বীকার করুক আমাদের স্বাধীন-স্বতন্ত্র অস্তিত্ব– তারপর হাত মেলাব।
অবশ্যি, এই জিব্রিল রাজৌব অলিম্পিক শুরুর অনেক আগে থেকেই গাজার ঘটনা নিয়ে সরব হয়ে ইজরায়েলি অ্যাথলিটদের অলিম্পিক থেকে ব্যান করার দাবি তুলেছিলেন– তাঁর স্পষ্ট দাবি ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের তিনশোরও বেশি অ্যাথলিটকে যুদ্ধের নামে হত্যা করেছে; শুধু তো স্পোর্টসপার্সন নয়, ইজরায়েলি সেনার আক্রমণে গুঁড়িয়ে গিয়েছে প্যালেস্তাইনের একাধিক স্টেডিয়াম, স্পোর্টস সেন্টারও। অলিম্পিকের আইনবিরুদ্ধ কাজ বারবার করেছে ইজরায়েল– তাই জিব্রিলের বক্তব্য ছিল অলিম্পিক কমিটিরই উচিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে ইজরায়েলকে অলিম্পিক থেকে ব্যান করা।
‘হাত মেলাব না’– জোরদার সওয়াল; ছেলেবেলা অলিগলির সেই চেনা স্লোগান– ‘কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’– এই কালো হাত যে রেসিজমের তরজায় মুখ্য ভূমিকা নেবে না, তা বুঝতে কৈশোর ডিঙোতে হয়েছে বটে; কিন্তু ইজরায়েলি কালো হাতের সঙ্গে প্যালেস্তাইনের হাত মেলাতে না চাওয়ার পিছনে এই কালোর একটি হাতেগরম নিদর্শন পেশ করে দিয়েছেন জিব্রিল। ইজরায়েলের জনপ্রিয় জুডো প্লেয়ার পিটার পলচিক গাজা ওয়ারের সময়ে নিজের সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট করেন, যেখানে তিনি ইজরায়েলের সই করা কিছু মিসাইলের ছবি পোস্ট করেন এবং ইজরায়েলি সেনাদের উদ্দেশ্য করে লেখেন, ‘From me to you with pleasure.’
প্যালেস্তাইনের শিশু-বৃদ্ধ-আমজনতার প্রতি ইজরায়েলি ক্রীড়াবিদের এ তোফাটি প্রেস কনফারেন্সেই তুলে ধরেছিলেন প্যালেস্তাইনের অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট। আর সেই পলচিকই আবার ইজরায়েল অলিম্পিক টিমের পতাকা-বাহক।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি কিংবা ইজরায়েলের অলিম্পিক কমিটি থেকে অবশ্য বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, প্যালেস্তাইন শুধু শুধু খেলার সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে– যেমনটা হয়ে থাকে সর্বত্র– বিশ্বজোড়া ‘খেলার সঙ্গে রাজনীতি মিশিও না গো’ জাতীয় ফ্যাসিবাদী কুম্ভীরাশ্রুর মতোই শোনায় এই তোতাপাখি বুলি। আর একইসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির আরও একটি দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে যায়। কেমন সে দ্বিচারিতা? মনে করে দেখুন, গত বছর উইম্বলডনে ইউক্রেনিয়ান টেনিস প্লেয়ার আনহেলিনা কালিনিনা তাঁর রাশিয়ান প্রতিপক্ষ ভেরোনিকার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে অসম্মত হন এবং প্রেস বিবৃতিতে পরিষ্কার জানান যে, ভেরোনিকা সেই দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে যে দেশ তাঁর দেশকে আক্রমণ করেছে তাই তিনি হাত মেলাবেন না।
এই ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ন হয়, যেখানে খেলা ও রাজনীতির বিভাজনরেখা কিঞ্চিৎ অস্পষ্ট হয়ে পড়ে– এবং বিশাল সংখ্যক জনতা আনহেলিনার সমর্থনে দাঁড়িয়ে একথা বলে ও দেন, যে হাত না মেলাতে চাওয়া খুব স্বাভাবিক এক প্রতিক্রিয়া– কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের মন রাখা আশু প্রয়োজন যে, এই মেনে নেওয়ার পিছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধটিকে স্বীকার করে নেওয়ার বিষয়টি লুকিয়ে আছে– আর এই ইউক্রেন যুদ্ধকে পুরোমাত্রায় স্বীকার করে নিয়েছে অলিম্পিক কমিটিও, যে কারণে রুশ এবং বেলারুশের অ্যাথলিটদের স্বতন্ত্র যোগদান বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে তারা, এবং শুধু স্বতন্ত্র যোগদানই নয় এই প্রত্যেক অ্যাথলিটকে অলিম্পিক কমিটির কাছে লিখিত চিঠি দিয়ে জানাতে হবে যে, তাঁরা ইউক্রেন যুদ্ধকে সমর্থন করেন না। অথচ, ইজরায়েলের অ্যাথলিটদের জন্য এমন কোনও নির্দেশনামা দেওয়া হয়নি আইওসি-র তরফে। অর্থাৎ, বারবার ইজরায়েল শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন করে যুদ্ধ ঘোষণা করার পরেও গাজা ওয়ারকে কার্যত স্বীকারই করছে না অলিম্পিক কমিটি।
……………………………………………………………………
রাষ্ট্রপুঞ্জ স্বীকৃত, অলিম্পিক কমিটি অনুমোদিত অলিম্পিক ট্রুসের কথা আমরা কমবেশি জানি। কী সেই ট্রুস? প্রাচীন গ্রিক ঐতিহ্য মেনে এক শান্তি চুক্তি যেখানে বলা থাকে অলিম্পিক শুরুর সাতদিন আগে থেকে অলিম্পিক শেষ হওয়ার সাতদিন পর অবধি বিশ্বব্যাপী কোথাও কোনও যুদ্ধ করা যাবে না। এই সোনার পাথরবাটির মতো ট্রুসটি, যাকে কি না আজকাল কেবলই গ্রিক ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে টিকিয়ে রেখেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ সেই ট্রুস যেমন রাশিয়া ভেঙেছে, তেমনই ভেঙেছে ইজরায়েলও কারণ প্যালেস্তাইন এখনও সম্পূর্ণ যুদ্ধ-পরিস্থিতির মধ্যে– কিন্তু অলিম্পিক কমিটির নির্দেশনামায় স্বীকৃতি পাচ্ছে কেবল ইউক্রেনের ওপর আক্রমণের বিষয়টি, প্যালেস্তাইন সেখানে আলোচনাতেই নেই।
……………………………………………………………………
এই এক যাত্রায় পৃথক ফলটি নিয়ে কিন্তু হইচই হচ্ছে কম– কারণ প্যালেস্তাইন রাশিয়া নয়, পুতিনের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার চোখরাঙানি কিংবা বেলারুশের লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে পুতিনের হাত মেলানোর ঠান্ডা সমীকরণ কিংবা পাশ্চাত্যের সামনে প্রধান শত্রু হিসেবে রাশিয়াকে চিহ্নিতকরণের সুবর্ণ সুযোগ এখানে নেই। ফলে, করমর্দনকে যে সাম্যের স্মারক হিসেবে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়, সে সাম্য তো লঙ্ঘন করছে খোদ অলিম্পিক কমিটিই– তাই জিব্রিলের হাত মেলাতে না চাওয়ার ঘোষণা আরও বেশি করে বহুমাত্রিক হয়ে যায়!
অলিম্পিক শুরুর পরও থেমে থাকেননি রাজৌব, তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন ইজরায়েলের আক্রমণের কারণেই প্যালেস্তাইন গাজা থেকে একজন অ্যাথলিটকেও আনতে পারেনি– কয়েক হাজার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে গাজাতে, যারা ভবিষ্যতে প্যালেস্তাইনের পতাকা হাতে অলিম্পিক মঞ্চে দাঁড়াতে পারত!
যদিও জিব্রিল রাজৌবের রাজনৈতিক ইতিহাসটিও যে খুব একরৈখিক ও সরল তেমন না, এর আগে আর্জেন্টিনা-ইজরায়েল ম্যাচে লিওনেল মেসির পোস্টার ও ছবি পোড়ানোতে ইন্ধন দিয়ে তিনি ফিফার ব্যানও খেয়েছিলেন– কিন্তু ওয়ার্ডস বিফোর ম্যান– তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর ইজরায়েলের সঙ্গে অলিম্পিক মঞ্চে হাত না মেলাতে চাওয়ার সিদ্ধান্তের একাধিক স্তর উন্মোচন করা যেতে পারে– যেমন খেলা এবং রাজনীতি যদি আলাদাই হয় তবে ইজরায়েলের পতাকা বাহক পলচিক হতে পারেন না, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্মারক হিসেবে গাজার বুকে একাধিক ভেঙেচুড়ে যাওয়া স্টেডিয়াম পড়ে থাকে না– আর যদি তা না হয়– অর্থাৎ খেলা ও রাজনীতির শিকড় যদি মাটির গভীরে কোথাও গিঁট বাঁধা হয়ে থাকেই তবে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের অলিম্পিক মঞ্চে করমর্দন প্রত্যাহারও তো একপ্রকার রাজনৈতিক স্টান্স– যা নেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে ক্রীড়া প্রশাসকের।
রাষ্ট্রপুঞ্জ স্বীকৃত, অলিম্পিক কমিটি অনুমোদিত অলিম্পিক ট্রুসের কথা আমরা কমবেশি জানি। কী সেই ট্রুস? প্রাচীন গ্রিক ঐতিহ্য মেনে এক শান্তি চুক্তি যেখানে বলা থাকে অলিম্পিক শুরুর সাতদিন আগে থেকে অলিম্পিক শেষ হওয়ার সাতদিন পর অবধি বিশ্বব্যাপী কোথাও কোনও যুদ্ধ করা যাবে না। এই সোনার পাথরবাটির মতো ট্রুসটি, যাকে কি না আজকাল কেবলই গ্রিক ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে টিকিয়ে রেখেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ সেই ট্রুস যেমন রাশিয়া ভেঙেছে, তেমনই ভেঙেছে ইজরায়েলও কারণ প্যালেস্তাইন এখনও সম্পূর্ণ যুদ্ধ-পরিস্থিতির মধ্যে– কিন্তু অলিম্পিক কমিটির নির্দেশনামায় স্বীকৃতি পাচ্ছে কেবল ইউক্রেনের ওপর আক্রমণের বিষয়টি, প্যালেস্তাইন সেখানে আলোচনাতেই নেই– বিশ্বের অলিখিত কেষ্টবিষ্টু মার্কিন রাষ্ট্রনায়কদের দক্ষিণহস্ত ইজরায়েলের মাথায়, ফলে এ ঘটনা যে খুব অস্বাভাবিক এমনও তো নয়।
………………………………………………..
আরও পড়ুন বোরিয়া মজুমদার-এর লেখা: অলিম্পিকের মঞ্চে রাজনৈতিক প্রতিবাদ, পথ দেখিয়েছিল ভারতীয়রাই
………………………………………………..
তাহলে আশাবাদের বিরাট ফানুসের গায়ে যে হাসি হাসি হ্যান্ডশেকের হ্যাপি হ্যাপি ছবিখানা ছেপে দিতে চায় বিশ্ব, যেখানে ওই ‘হাতে হাত রাখা থাক’-এর সৎ আবেদন তার কলোসাস ইমেজ দিয়ে ঢেকে দিতে চায় যাবতীয় ফুটিফাটা, অলিম্পিকের মূল স্লোগান Games wide open-ও এর থেকে ভিন্ন না; এমনকী, এই সবকিছুরও আগে হাতে হাত মেলানোর যৌথতার ধারণা, আমাদের শৈশব-কৈশোরের সহজপাঠের সারল্যও কোথাও গিয়ে ধাক্কা খেয়ে যায় জিব্রিল রাজৌবের এই সিদ্ধান্তের সামনে– ইজরায়েলের হাতে যে রক্ত লেগে আছে, যে হাত স্বীকারই করে না উল্টোদিকের হাতটির অস্তিত্ব– সেই হাতছানিকে প্রত্যাখ্যান করা যদি বিশ্বজোড়া যৌথতার মেকি অবয়বকে কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান করে দেয়, তবে সে দোষে দুষ্ট প্যালেস্তাইনের কী শাস্তি হওয়া উচিত?
ভাবুন, ভাবুন, আমাদের ভাবা প্র্যাকটিস করার সময় এসে গিয়েছে!
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….