দিমিত্রি-র ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’ এমন একটা সময় হয়েছে যখন দরজায় কড়া নাড়ছে ডার্বি। আইএসএলের খেতাবি লড়াইয়ে ম্যাচটা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মনেপ্রাণে চাই, জিতুক মোহনবাগান। আর সেই মূল্যবান তিন পয়েন্টের পাশাপাশি যদি গোল করে দিমিত্রি। যদি হয় আবার, আরও একবার ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’– তাহলে তো সোনায় সোহাগা!
গোল সেলিব্রেশনের আলাদা একটা মাধুর্য রয়েছে। পক্ষ-বিপক্ষ মিলিয়ে সেই উদযাপন গ্যালারিতে উপস্থিত দর্শক কিংবা টিভির পর্দায় চোখ রাখা ফুটবল অনুরাগীর মনের দাগ কেটে যায়। আবার অনেক সময় উসকে দেয় পুরনো কোনও মধুর স্মৃতি। মোহনবাগানের দিমিত্রি পেত্রাতোসের ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’টাও অনেকটা সেইরকম।
‘স্টেনগান’ সেলিব্রেশন, বললেই চোখের সামনে একটা মুখই ভেসে ওঠে। সনি নর্ডি। আমার অত্যন্ত প্রিয় ফুটবলার। শিল্পী-প্লেয়ার বলতে যা বোঝায়, সনি তাই। মোহনবাগান জার্সিতে অনেক সাফল্যের মুহূর্ত উপহার দিয়েছে হাইতিয়ান-ম্যাজিশিয়ান। হ্যাঁ, সমর্থকরা ওকে ম্যাজিশিয়ানই বলত। শিলিগুড়ি ডার্বিতে ফ্রি-কিক থেকে ওর সেই অনবদ্য গোল, তারপর গ্যালারির দিকে ছুটে এসে ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’ এখনও চোখের সামনে ভাসে। জামশেদপুর এফসি ম্যাচে দিমিত্রি হয়তো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’ করেছে, কিন্তু আমাদের কোথায় মনে পড়ে যাচ্ছিল সনিকেই। ২০১৭-র সেই ডার্বি ম্যাচে সনি ছাড়াও একটা অনবদ্য গোল করেছিল আজহারউদ্দিন মল্লিক। কিন্তু সমর্থকরা সেই বড়ম্যাচটাকে মনে রেখেছেন সনির ‘স্টেনগান’ সেলিব্রেশনের জন্য। আর মনে রাখবেনই বা না কেন, ম্যাচটা যে ছিল ইস্টবেঙ্গলের ডেরা, শিলিগুড়িতে। সেবার ধারে-ভারে ইস্টবেঙ্গলও যথেষ্ট শক্তিশালী টিম ছিল। কিন্তু একাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল সনি নর্ডি।
শুধু শিলিগুড়িতে ডার্বি বলে নয়, মোহনবাগানকে বহু ম্যাচ সনি জিতিয়েছে। নিজে গোল করেছে, গোল করিয়েছে। পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে এই আমাদের, সবুজ-মেরুন জনতার হৃদয়ে। এর আগে আমরা ব্যারেটোকে দেখেছি, এভাবে জনতার নয়নের মণি হয়ে উঠতে। পরবর্তীতে সনির মধ্যে সেই একাত্মবোধ লক্ষ্য করেছিলাম। যাই হোক, স্টেনগান সেলিব্রেশন আর সনি নর্ডি– নাম দু’টো সমার্থক মোহনবাগান সমর্থকদের কাছে। আমার কাছেও তাই।
আসলে গোল সেলিব্রেশন এমন একটা ব্যাপার, যার মধ্যে দিয়ে ফুটবলার ও সমর্থক একাত্ম হয়ে যায়। সামান্য একটা মুহূর্ত হলেও এর গভীরতা বিশাল। সমর্থকরা তো মাঠে নেমে খেলতে পারেন না, মাঠে ফুটবলারদের উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে নিজের ভিতরের উচ্ছ্বাস, চাওয়াপাওয়াকে প্রকাশ করতে চান সমর্থকরা। ফলে গোলের পর যখন একজন ফুটবলার উল্লাস দেখান, গোল সেলিব্রেশনে বিশেষ কিছু করেন, তখন সেটা শুধু ওই প্লেয়ারের নয়, সামগ্রিকভাবে সাপোর্টারদের সেলিব্রেশন হয়ে ওঠে। একটা ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। ফলে সময় এগিয়ে গেলেও সমর্থকদের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকে সেই গোল-সেলিব্রেশন। দিমিত্রি-র ‘স্টেনগান’-এ সেই নস্ট্যালজিয়াই ফিরে এসেছে নতুন করে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাঙালিদের মধ্যে তো প্রচুর ব্রাজিল সাপোর্টার আছে। তারাও নিশ্চয় ভোলেননি রোনাল্ডিনহোর সেই ‘সাম্বা ড্যান্স’! সেটা আরও ভালো লাগে যখন গোলদাতার সঙ্গে তাঁর সতীর্থরাও এসে যোগ দেয়। মনে হয়, চর্মচক্ষে যেন আস্ত একখানা কোরিওগ্রাফি দেখছি। তবে শুধু সেলিব্রেশনের মধ্যে দিয়ে আনন্দের প্রকাশ ঘটে তা বলব না। অনেক সময় দেখেছি, ফুটবলাররা সেলিব্রেশনের মধ্যে দিয়ে কোনও ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক বার্তা দেন। সুনীল ছেত্রীকে দেখেছি, গোলের পর সেলিব্রেশনের মধ্যে দিয়ে বাবা হওয়ার সুখবর দিচ্ছেন সমর্থকদের। ক্রিকেটে শিখর ধাওয়ান থেকে ডেভিড ওয়ার্নার, রবীন্দ্র জাদেজা থেকে শুভমান গিল– প্রত্যেকের আলাদা সেলিব্রেশন ভঙ্গি রয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সেলিব্রেশনের কথাই যখন উঠল তখন একজনের কথা না বললেই নয়। সে হল, রজার মিল্লা। ’৯০ বিশ্বকাপে ‘বুড়ো ঘোড়া’ মিল্লার খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেইসময় দারুণ ফর্মেও ছিলেন। গোলের পর কর্নার ফ্ল্যাগের সামনে গিয়ে মিল্লার সেই নাচ, এখনও মনে পড়ে। তারপর ’৯৪-এর বিশ্বকাপে বেবেতোর সেই ‘বেবি ড্যান্স’, সে তো জগৎ-বিখ্যাত বলা চলে। আসলে গোলের পর প্লেয়ারদের এই উচ্ছ্বাস, এই আবেগের বিস্ফোরণ নতুন কিছু নয়। আগেও ছিল। কিন্তু তখন এত ক্যামেরা ছিল না। যখন থেকে মাল্টি-ক্যাম ফুটবলে এল, এই মুহূর্তগুলো আরও বেশি করে ক্যামেরাবন্দি হতে শুরু করল, তখন থেকেই কিন্তু গোল-সেলিব্রেশন ব্যাপারটা সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করল। এখন তো ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ‘সিইউ সেলিব্রেশন’ নিয়ে রীতিমতো চর্চা হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: রেফারি মানেই পিঠে বেঁধেছি কুলো, কানে দিয়েছি তুলো
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শুধু অন্যান্য ফুটবলাররা নয়, অন্য স্পোর্টসের ক্রীড়াবিদদেরও দেখি সিআর সেভেনের গোল সেলিব্রেশনকে অনুকরণ করেন। বাঙালিদের মধ্যে তো প্রচুর ব্রাজিল সাপোর্টার আছে। তারাও নিশ্চয় ভোলেননি রোনাল্ডিনহোর সেই ‘সাম্বা ড্যান্স’! সেটা আরও ভালো লাগে যখন গোলদাতার সঙ্গে তাঁর সতীর্থরাও এসে যোগ দেয়। মনে হয়, চর্মচক্ষে যেন আস্ত একখানা কোরিওগ্রাফি দেখছি। তবে শুধু সেলিব্রেশনের মধ্যে দিয়ে আনন্দের প্রকাশ ঘটে তা বলব না। অনেক সময় দেখেছি, ফুটবলাররা সেলিব্রেশনের মধ্যে দিয়ে কোনও ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক বার্তা দেন। সুনীল ছেত্রীকে দেখেছি, ও যে বাবা হতে চলেছে সেই সুখবরটা সমর্থকদের দিয়েছে গোলের পর অভিনব সেলিব্রেশনের মধ্য দিয়ে। ক্রিকেটে শিখর ধাওয়ান থেকে ডেভিড ওয়ার্নার, রবীন্দ্র জাদেজা থেকে শুভমান গিল– প্রত্যেকের আলাদা সেলিব্রেশন ভঙ্গি রয়েছে। বাংলার ক্রিকেটার অনুষ্টুপ মজুমদারের কথাও এপ্রসঙ্গে মনে পড়ছে। রনজিতে ভাঙা আঙুল নিয়ে ব্যাট করে সেঞ্চুরি করেছিল। সেদিন ছিল ওর ছেলের জন্মদিন। সেঞ্চুরি পর অনুষ্টুপ পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে দেখায়, যেখানে ছেলের জন্য লিখে রেখেছিল জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা। আসলে এই মুহূর্তগুলো মনে থেকে যায় সারাজীবন।
যেমনভাবে থেকে গিয়েছে ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’, এবং সনি নর্ডি। মজার বিষয়, দিমিত্রি-র ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’ এমন একটা সময় হয়েছে যখন দরজায় কড়া নাড়ছে ডার্বি। আইএসএলের খেতাবি লড়াইয়ে ম্যাচটা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মনেপ্রাণে চাই, জিতুক মোহনবাগান। আর সেই মূল্যবান তিন পয়েন্টের পাশাপাশি যদি গোল করে দিমিত্রি। যদি হয় আবার, আরও একবার ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’– তাহলে তো সোনায় সোহাগা!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved